Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাজার নিয়ন্ত্রণে যা করা যেতে পারে

Icon

আবুল কাশেম উজ্জ্বল

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুবছর ধরে যারা নিয়মিত বাজার করেন বা বাজার নিয়ে ধারণা রাখেন, নিত্যপণ্যের মূল্য তাদের ভালোই জানা আছে। প্রতি সপ্তাহে বাজার করতে গেলে দেখা যায় পণ্যের মূল্য বদলে গেছে। আর রমজানে বাজার যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির কবলে পড়ে। ফলে বাজার হয়ে ওঠে অস্থির আর নাকাল হয় সাধারণ ক্রেতা। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নতুন কোনো ইস্যু নয়, বরং বছরের পর বছর আমরা এভাবেই নাকাল ও নাজেহাল হচ্ছি। কেবল রমজানেই নয়, অনেকদিন ধরেই বাজারের চিত্র খুবই হতাশার, কখন কোন পণ্যের দাম হঠাৎ করে বাড়বে তা বলা মুশকিল। সাধারণ ভোক্তার দৌড় সীমিত, তাদের প্রশ্ন করার এখতিয়ার ও সুযোগ দুটিই কম বা নেই। বেশি হলে দোকানিকে প্রশ্ন করতে পারেন এবং উত্তর খুবই পরিচিত। অথচ আমাদের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য ভিন্ন। সময় সময় তাদের হুংকারে কেবল আমাদের কর্ণের ব্যথা বাড়ে, কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কমে না।

মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানিকৃত ও দেশীয় পণ্য-কোনোটি পিছিয়ে নেই। আর বৃদ্ধির হার কেবল অস্বাভাবিকই নয়, কোনো যুক্তিতেই তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। প্রায় প্রতিটি আমদানি পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কিন্তু এর কারণ জানার সুযোগ নেই। যদি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়, তাহলে এ সময় ডলারের মূল্য কি এতটাই বেড়েছে যে পণ্যের মূল্য দ্বিগুণের বেশি হবে? তাই স্বাভাবিকভাবেই আমদানিকারকরা যে মূল্য নির্ধারণ করেন, সেটা কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার একই সময়ে দেশীয় পণ্যের দামও বেড়েছে দফায় দফায় এবং সেটা এখনো অব্যাহত আছে। দেশীয় কারখানার কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা, তাও বিবেচ্য হওয়া দরকার।

আমদানি করা সব পণ্যের গায়ে মূল্য দেওয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ পচনশীল পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে। ফলে ক্রেতাকে বাজারে বিদ্যমান মূল্যে ওইসব পণ্য কিনতে হয়। এখানেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে থাকেন। বিগত কয়েক মাস ধরে এবং অতীতেও লক্ষ করা গেছে, সময় সময় ওইসব পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশে বা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের বাজারে এর প্রভাব পড়ে, অথচ নতুন দামে পণ্য আমদানি করা হয় অনেক পরে।

ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির জন্য ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটকে দায়ী করছেন। এটা একটা যৌক্তিক কারণ; কিন্তু একমাত্র কারণ কি? সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ডলারের সংকট সমাধানের প্রচেষ্টা নিয়েছে। ডলারের মূল্যও নির্ধারণ করে দিয়েছে। যদিও ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হচ্ছে, তাদের এর চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। কোনটা কতটা সত্য, তা জানা আমাদের মতো সাধারণ ভোক্তাদের জন্য অসম্ভব; কিন্তু দিনশেষে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

সময় সময় দেখা যায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার নিয়ে তাদের অবস্থান অবহিত করে, এমনকি নিত্যপণ্যের মূল্যও নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তাতে বাজারের অবস্থার পরিবর্তন হয় কমই। এমনকি বিভিন্ন অভিযানে সতর্ক ও জরিমানা করার পরও বাজারে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেখা যায় না। বরং অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা উপায়ে বাজারে প্রভাব তৈরি করে বাড়তি মুনাফা তুলে নেয়। তাদের দৌরাত্ম্য এত বেশি যে, কাঁচা মরিচের কেজি হাজার টাকায়ও নিয়ে যেতে পারে। যদিও সরকারের অভিযান ও উদ্যোগে কিছুদিনের মধ্যে বাজারের কিছুটা উন্নতি হয়, কিন্তু এর মধ্যে হাজার কোটি টাকা ক্রেতার পকেট থেকে চলে যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের অ্যাকাউন্টে। কিন্তু এর বিপরীতে তাদের শাস্তি বা জরিমানা খুব কম কিংবা অনেক সময় তারা থাকে আইনের সীমার বাইরে। সেসব মানুষ কারা, তা কি সরকারের অজানা? এ প্রশ্নটা সব সময় মনের মাঝে থাকে, কিন্তু কোনো উত্তর পাই না।

আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আছে, আছে ভোক্তা অধিকার, চলে অভিযান; কিন্তু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য থেমে নেই। তারা কি এতই শক্তিশালী যে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না? ‘বাজার সিন্ডিকেট’ বলে একটা কথা বহুদিন ধরে প্রচলিত। প্রশ্ন হলো, যদি সিন্ডিকেট বলে কিছু থেকে থাকে, তাহলে কারা তা নিয়ন্ত্রণ করেন? তাদের কি আইনের আওতায় নিয়ে বিচার করার সুযোগ নেই? আর যদি সিন্ডিকেট বলে কিছু না থাকে, তাহলে বাজার ঘোলা করে মুনাফা নিচ্ছে কারা, সেটাও আমাদের অজানা। সিন্ডিকেট থাক বা না থাক, যাদের কারণে বাজার অস্থির হয়, মানুষ দেখতে চায় সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

বাজার নির্ভর করে দেশীয় উৎপাদন ও আমদানির ওপর। বাজারে গেলে কোনো পণ্যের ঘাটতি দেখা যায় না, কিন্তু মূল্য কমে না। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র এখানে মার খেয়ে যায়। দেশে উৎপাদিত ও আমদানি করা পণ্যের মূল্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অজানা থাকার কথা নয়। উৎপাদক ও আমদানিকারক কারা তাও আজানা নয়। তাহলে বাজারের অবস্থা স্বাভাবিক করা যায় না কেন? যেসব অভিযান হয়, এর বেশির ভাগ হয় খুচরা দোকানে বা আড়তে। ভোক্তা অধিকার সময় সময় বিক্রেতাদের সতর্ক ও জরিমানা করে ঠিকই; কিন্তু উৎপাদক, আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান বা শাস্তি দেওয়ার উদাহরণ কম। খুচরা দোকানদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের পক্ষে সারা দেশের বাজারকে প্রভাবিত করার সুযোগ কতটা আছে? বরং তা করা সম্ভব উৎপাদক বা আমদানিকারকদের পক্ষে-এ সহজ সত্য সবাই জানে।

বাজারের অবস্থা স্বাভাবিক রাখতে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, দেশীয় ও আমদানিকৃত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করা। এটা মোটেও কঠিন কিছু নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের কাছে সব তথ্য থাকার কথা। তাই বাজারে বিদ্যমান পণ্যের দাম উপযুক্ত কি না, তা যাচাই করাও কোনো সমস্যা নয়। আমদানিকৃত ও দেশীয় পণ্যের খুচরা মূল্য সংশ্লিষ্টরা ঠিক করে দিলে বাজারের বেহাল দশা অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে হয়। একই সঙ্গে সেটা জনসাধারণকে অবহিত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নির্ধারিত মূল্য খুচরা দোকানে ঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না, তাও নিয়মিতভাবে দেশের সব বাজারে যাচাই করা দরকার।

দেখা যায়, আমাদের কৃষিজাত পণ্যের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীরা রাজত্ব করে এবং মুনাফার বড় অংশ তারাই ভোগ করে। সরকারের উচিত কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে আসার পথ সহজ করা। ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ কাজটি করছে যদিও, তাদের দরকার সরকারের সহযোগিতা। একই সঙ্গে পাইকারি বাজারের মূল্য নিয়মিত তদারক করা এবং বাজারের সঙ্গে এর ভারসাম্য আছে কিনা তা যাচাই করা।

আবার বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং অনেককে আর্থিক জরিমানা করা হয়। আসলে অভিযান হওয়া দরকার আমদানিকারক, আড়তদার ও সরবরাহকারীদের ওপর। কেননা খুচরা দোকানদার চাইলেও সারা দেশের বাজার প্রভাবিত করতে পারে না। জরিমানার পরিমাণও উপযুক্ত হওয়া দরকার। অসাধু ব্যবসায়ী বাজার অস্থির করে যে পরিমাণ অর্থ মুনাফা করে, জরিমানার অর্থ তার সমান বা বেশি হওয়া দরকার। না হলে সামান্য জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। একই সঙ্গে তাদের কৃত অপরাধের ভিত্তিতে জেল ও ব্যবসায়ী সনদ বাতিল বা স্থগিত করার বিধান থাকা খুবই জরুরি। বিশেষ করে একই অপরাধে একাধিকবার অভিযুক্তদের বেলায় আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। তবে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, এ কাজে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। মানুষ দেখতে চায়, অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশের আইন ও সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নয়। তা না হলে বাজার বারবার অস্থির হবে, আমরা নাকাল হব এবং সরকারের জন্য সেটা হবে বিব্রতকর।

আবুল কাশেম উজ্জ্বল : শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম