পরিবেশ দূষণ ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব একসূত্রে গাঁথা
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রবিঠাকুরের দুই বিঘা কবিতার লাইন দিয়েই শুরু করি।
‘নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি
অবারিত মাঠ, গগনললাট, চুমে তব পদধূলি,
ছায়াসুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল, দিঘি কালোজল, নিশীথশীতলস্নেহ।’
কবিগুরু এমনভাবেই গ্রামবাংলার সৌন্দর্য বাস্তবতার নিরিখে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আহা বাংলার বর্তমান রূপ যদি প্রকৃত অর্থে এমন হতো, তাহলে বাঙালির শান্তির কোনো অন্ত থাকত না। কিন্তু বাস্তবতা অতীব নির্মম। তাই তিনি আরও বলেছেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ তিনি শহরকে উদ্দেশ করে যেমন বলেছেন-‘ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ-কীট/নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা।’ অন্যদিকে গ্রামকে নিয়ে বলেছেন, ‘আমার যে নিরন্তর ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে আমি পল্লী গ্রামকে দেখেছি, তাতেই আমার হৃদয়ের দ্বার খুলে দিয়েছে।’ পরিবেশের প্রতিটি উপাদান-তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ু প্রবাহ, আর্দ্রতা, সূর্যালোক, মাটি, পানি, গাছপালা ও অন্যান্য বায়োটিক ও এবায়োটিক উপাদানগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন রোগের সঙ্গে জড়িত। রোগগুলো সংক্রমিত হয় বিভিন্ন বাহক ও বাহনের মাধ্যমে, যার সঙ্গে জড়িত আছে পরিবেশের উপাদান। উপাদানগুলো যত বেশি দূষণের শিকার হবে, রোগের জীবাণু তত বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে প্রবাহিত হবে বাহকের মাধ্যমে পোষক শরীর অর্থাৎ মানুষের শরীরে।
আমরা জানি, সংক্রামক রোগ হলো সেসব রোগ যে রোগগুলো কোনো জীবাণু দ্বারা সংঘটিত হয় এবং বাহকের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। সেই আলোকে ডেঙ্গু একটি সংক্রামক রোগ, যা ডেঙ্গু নামক ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত হয় এবং বাহক এডিস মশার মাধ্যমে পোষক মানুষের শরীরে প্রবাহিত হয়। এখন প্রশ্ন হলো, পরিবেশ দূষণের দ্বারা ডেঙ্গু রোগটি কিভাবে ক্রমান্বয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠছে? ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার জীবনচক্র থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারি-এর ডিম, লার্ভা ও পিউপা তিনটিই পানিতে বিচরণ করে এবং পূর্ণাঙ্গ দশাপ্রাপ্ত হয় স্থলে। এডিস মশার পাশাপাশি যে মশাটি আমাদের জাপানি ইনক্যাপালাইটিস রোগসহ সবচেয়ে বিরক্তিকর ও কষ্টের কারণ, সেটি হলো কিউলেক্স মশা। এ মশার প্রজননস্থল দূষিত পানি। তাই কিউলেক্স ও এডিস উভয় ধরনের মশাই পরিবেশের প্রতিটি উপাদান দিয়ে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। আমরা জানি, এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে জন্মে। তাহলে দূষণ তাদের প্রজননকে কিভাবে প্রভাবিত করে? পরিবেশ দূষণের যত কারণ আছে তার মধ্যে পানি, তাপমাত্রা, মাটি ও বায়ু দূষণ প্রধান। অতিরিক্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণও এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়ে চলেছে। সিডিসি পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে নির্মাণাধীন ভবনের নিচের ফ্লাডিং ফ্লোরই এডিস মশার সবচেয়ে উপযোগী প্রজননস্থল।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত এডিসের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। একইসঙ্গে ইচ্ছামতো বন উজাড় করার কারণে এডিস এলবোপিকটাসের প্রজাতি বনের পরিবেশে থেকে এনথ্রোপোজেনিক সংস্পর্শে নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখেছে। গাছপালা ধ্বংসের ফলে নিজেদের অস্বস্তির কারণেই তারা মানুষের বাসস্থানের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আবার শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে মানুষের যাতায়াতের কারণে অবাধে এর বিস্তার ঘটছে। পরিবর্তিত পরিবেশে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে এডিসের বংশবিস্তার ও তাদের শক্তিশালী হয়ে টিকে থাকার ক্ষেত্রে। মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত পদার্থ কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের ফলে পানি ও মাটির ব্যাপক দূষণ ঘটছে। এ দূষণে এডিসের লার্ভাও সমানতালে কীটনাশক-প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। কারণ এডাল্ট মশাকে মারার জন্য যে এডালটিসাইড ব্যবহার হচ্ছে তার নাম ম্যালাথিয়ন। এ ম্যালাথিয়নই আবার কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই রেসিডুয়াল ইমপ্যাক্টযুক্ত মাটিতে যে পানি জমছে, তা লার্ভাকে জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিকূল পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে নিজেকে অধিক প্রতিরোধী করে গড়ে তুলছে। ফলে প্রয়োগকৃত লার্ভিসাইড তার কোনো ক্ষতিই করতে পারছে না। ধারাবাহিকভাবে লার্ভা থেকে পিউপা এবং পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠছে। মশার প্রাকৃতিক শত্রু যেমন ড্রাগন ফ্লাই নিম্ফ, কপপেড ও বিভিন্ন শিকারি মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অযাচিতভাবে ব্যবহৃত কীটনাশকের বিষক্রিয়ার প্রভাবে। পরিবর্তিত পরিবেশে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বায়োডাইভারসিটি। ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে অত্যন্ত ক্ষতিকারক বিভিন্ন ভারী ধাতুর পরিমাণ। বাতাস ও পানি উভয়েই আজ সিসা, ক্যাডসিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদি মারাত্মক ধাতুতে বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। বিপাকে পড়ছি আমরা সবাই। শুধু সুন্দর পরিবেশ পাচ্ছে আমাদের শত্রু ক্ষুদ্র পতঙ্গ আর তাদের দ্বারা বাহিত রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, একটিনোমাইটস, সেমাটোড ইত্যাদি) কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত ম্যালথিরন আগে থেকেই বাতাসে টক্সিসিটি ছড়িয়ে রেখেছে, যা পূর্ণাঙ্গ মশাকে এডালটি সাইড প্রতিরোধ করে তুলছে। বাতাসে ডাস্ট পার্টিকেল আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তা ডেসিকেশন রেজিসটেন্স বাড়িয়ে ডিমের সজীবতা আর ডিম ফুটে লার্ভা উৎপাদন ও টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবেশের এ দূষণ শুধু যে মশকীকে শক্তিশালী করে তা নয়, শক্তিশালী করে তুলছে মশকী দ্বারা বাহিত ভাইরাসকে। ভাইরাসের ভিরুলেন্স বাড়িয়ে তুলছে বহুগুণে। তাই ডেঙ্গুতে সিএফআর বা কেস ফেটালিটি রেট আমাদের দেশে অনেক উঁচুতে।
এতক্ষণ বললাম এডিস মশার কথা। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যে প্রজাতির মশাটি নিয়ে বলেছিলেন, ‘রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়েই কলকাতায় আছি’, সেটি হলো কিউলেক্স-যার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও স্বচ্ছন্দে বিরক্ত করার পরিবেশই হলো দূষিত পরিবেশ। তাই সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় এর তাণ্ডবলীলা। গুনগুনানি মহাবিরক্তকর শব্দ আর রক্ত শোষণের তীব্র জ্বালার সঙ্গে উপহার হিসাবে ফাইলেরিয়া, জাপানি ইনক্যাপালাইটিস ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব। দূষণে বাড়ছে এদের পরিসর ও কলেবর। মাটি, পানি, বায়ু, শব্দদূষণে চতুর্মুখী বিপর্যয়ে লন্ডভন্ড আমাদের সাজানো জীবন। ভয়ংকর সব এনসিডি বা নন কমিউনিক্যাবল ডিজিজ ও সংক্রামক রোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারী ধাতুর উপস্থিতিতে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য রোগ আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। মাটি দূষণের ফলে উৎপাদিত খাদ্যশস্যও বিষাক্ত হচ্ছে।
আমরা বুঝে না বুঝে সামান্য লাভের আশায় প্রতিনিয়ত পরিবেশকে দূষিত করে তুলছি। বুঝতেই পারছি না কত ভয়ংকর কর্মকাণ্ডে আমরা নিয়োজিত। তাই আবার কবিগুরুর অরণ্য দেবতায় ফিরে আসি। ফিরে আসি মহান সৃষ্টিকর্তার মূল উদ্দেশ্যের দিকে। তিনি সৃষ্টি করেছেন, তাই তিনি খুব ভালো জানেন কিসে সৃষ্টির ভালো আর কিসে মন্দ। তাই তিনি মানুষসহ সব জীব দ্বারা উৎপাদিত কার্বন-ডাই অক্সাইড বানিয়েছেন সবুজ গাছের খাদ্য তৈরির কাঁচামাল হিসাবে। আর এ কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদিত খাদ্যের সঙ্গে অতীব গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস অক্সিজেন তৈরির কারখানা করে দিয়েছেন সবুজ গাছকে। এমন চমৎকার কম্বিনেশন আমাদের মঙ্গলের জন্যই। অথচ আমরা এ কম্বিনেশন ভেঙে আমাদের বিপর্যয় ডেকে আনছি। যে গাছের পাতায় মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, তাকে ধ্বংস করে রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে বিষাক্ততা বাড়িয়ে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছি। তাই আসুন, এই বিশ্ব ধরিত্রীকে মায়ের মতো সম্মান ও যত্ন করে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য এক অবারিত চারণভূমি তৈরি করি।
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
