Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সৃষ্টিশীল এক অনন্য পুরুষ

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নিবন্ধের সূচনায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি নির্ভীক উচ্চারণ উপস্থাপন করতে চাই-‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগণ্য সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা পরম শ্রদ্ধেয় নুরুল ইসলাম স্মরণে উল্লেখিত পঙ্ক্তির বিশ্লেষণ অতি তাৎপর্যপূর্ণ। এ দেশের সচেতন গণমানুষের বিবেচনায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বাবুল ভাইয়ের বিকল্প খুবই বিরল। ছাত্রজীবন থেকে কর্মবীর-মেধাবী এই ব্যক্তিটি শুধু বাংলার মাটি-মানুষকে ভালোবাসেননি; প্রতিটি কর্মযজ্ঞে একজন দেশপ্রেমিক জনদরদি ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। তার মেধা, প্রজ্ঞা ও ত্যাগের মহিমা অত্যুজ্জ্বল হয়ে আছে। অসত্যের কাছে কখনো মাথানত না করে সত্যের অপরাজিত পতাকাকে সর্বত্রই উড্ডীন রেখেছেন।

নতুন জীবনের স্বপ্নদ্রষ্টা বাবুল ভাই কথায় নয়, কাজে অবিচল বিশ্বাসী ছিলেন বলেই নির্মাণ করতে পেরেছেন বহু প্রতিষ্ঠান। বর্তমান সময়ের সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনগণের আকাক্সক্ষা লালনকারী পত্রিকা দৈনিক যুগান্তর প্রতিষ্ঠা ছিল তার অনুপম উপমা। বাবুল ভাইয়ের নিরলস প্রচেষ্টা ও নিরন্তর পরীক্ষণ-সমীক্ষণ দেশবাসীর কাছে অতিশয় প্রশংসনীয়। মহৎ এ ব্যক্তি পত্রিকার মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে উঁচুমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অতুলনীয় উদাহরণ রচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য-কৃষ্টি, বাণিজ্য-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিনোদন ইত্যাদির জানালা উন্মুক্তকরণে অনবদ্য ভূমিকায় মর্যাদাসীন করেছেন নিজেকে।

সমকালীন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বিকাশ-বিস্তার যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে প্রতিভাত। প্রিন্ট-ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন-ফেসবুক-সামাজিক যোগাযোগ নানামুখী চেষ্টায় দেশ ও বিশ্বব্যাপী দ্রুততর সময়ের মধ্যে যে কোনো ধরনের সংবাদ সম্প্রচার করছে। মানুষের বাকস্বাধীনতা, বৈশ্বিক ও দেশীয় বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কলাম-নিবন্ধ-সংবাদ উপস্থাপন-পরিবেশন অনন্য মাত্রিকতায় পৌঁছেছে। ইতিবাচক এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবদান রাখা শক্তিগুলোর অন্যতম স্বাধীন গণমাধ্যম। উন্নয়ন ও গণমাধ্যম একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতন্ত্র-সুশাসন ও উন্নয়নের সঙ্গে গণমাধ্যমের রয়েছে নিবিড়তম সম্পর্ক। সার্বিক বিবেচনায় আধুনিক গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। অতীতে সাংবাদিকতার পরিসর সীমিত থাকলেও আধুনিকালে তা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, অর্থনীতি, রাজনীতি, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, কৃষি, ক্রয়-বিক্রয়সহ নাগরিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব চাহিদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রদূতের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এ গণমাধ্যমের উন্নয়নে নুরুল ইসলাম ভাইয়ের অবদান চিরস্মরণীয়।

অকুতোভয় এই বীর সেনাকে স্মরণযোগ্য করার জন্য কাজী নজরুলের কবিতাখানি যেন স্মরণ-প্রচ্ছদ হিসাবে বিবেচ্য। কবি নজরুলের ‘তুমি কি গিয়াছ ভুলে’ কবিতার কয়েকটি চরণ নিবেদনে এই কৃতিমানবকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি : ‘তুমি কি গিয়াছ ভুলে?/ তোমার চরণ-স্মরণ-চিহ্ন আজো মোর নদীকূলে/ মুছিল না প্রিয়, মুছিল না তার বুকে যে লিখিলে লেখা,/ মাঝে বহে স্রোত, দু’কূল জুড়িয়া চরণ-স্মরণ-রেখা!/ বন্যার ঢল, জোয়ার, উজান আসে যায় ফিরে ফিরে/ ও চরণরেখা মুছিল না মোর বালুচরে নদী তীরে!/ ঊর্ধ্বে ধূসর সান্ধ্য আকাশে ক্ষীণ চন্দ্রের লেখা,/ নিম্নে আমার শূন্য বালুচরে তোমার চরণরেখা।’ অনন্য যোগ্যতা-দক্ষতা-অক্লান্ত পরিশ্রমের সমাহারে আপসহীন এই কর্মবীর ১৯৭৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একে একে ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করেছিলেন। দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার অগ্রদূত নুরুল ইসলাম শিল্প সাম্রাজ্য স্থাপনে অনন্য দৃষ্টান্ত রচনা করেন। তার নেতৃত্বে যমুনা গ্রুপ দেশীয়-বৈশ্বিক বাজারে গুণগত-মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।

তার প্রতিষ্ঠিত অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে-যমুনা টেলিভিশন, যমুনা ফিউচার পার্ক, যমুনা হোটেল ও রিসোর্ট লিমিটেড, ক্রাউন বেভারেজ লিমিটেড, যমুনা নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, যমুনা ডেনিমস, যমুনা স্পিনিং মিলস, শামীম স্পিনিং মিলস, শামীম কম্পোজিট মিলস, শামীম রোটোর স্পিনিং, শামীম গার্মেন্টস, যমুনা ডেনিমস গার্মেন্টস, যমুনা ডেনিমস ওয়েভিং, পেগাসাস লেদারস, যমুনা ডিস্ট্রিলারি, যমুনা ওয়েল্ডিং ইলেক্ট্রোড, যমুনা ইলেকট্রোনিক্স অ্যান্ড অটোমোবাইলস, যমুনা টায়ার অ্যান্ড রাবারস, যমুনা পেপারস মিলস, যমুনা আয়রন অ্যান্ড স্টিল মিলস, যমুনা গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ, যমুনা পাওয়ার, যমুনা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং, যমুনা ফ্যান অ্যান্ড ক্যাবলস, যমুনা পলি সিল্ক, যমুনা লজিস্টিক অ্যান্ড শিপিং, যমুনা বিল্ডার্স, যমুনা গ্যাস, হোলসেল ক্লাব লিমিটেড, যমুনা ওয়াশিং, হুরিয়ান এইচটিএফ লিমিটেড, যমুনা মিডিয়া, লন প্রসেসিং, যমুনা ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং, যমুনা ফুডস, হোরক্যাচার লিমিটেড, ক্রাউন বেভারেজ, যমুনা ডেনিমস টেকনোলজি লিমিটেড ইত্যাদি। ঢাকার নিউ উত্তরা মডেল টাউন এবং যমুনা সিটি তার দুটি অমর কীর্তি হিসাবে বিবেচ্য।

নুরুল ইসলাম ৩ মে ১৯৪৬ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জের চুড়াইন ইউনিয়নের কামালখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আমজাদ হোসেন ও মাতা জোমিলা খাতুন। তার সহধর্মিণী যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, ঢাকা-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও একাদশ সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য, প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। নুরুল ইসলাম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। যৌবনে অস্ত্র হাতে ১৯৭১ সালে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনের প্রথম সারির এ যোদ্ধা। স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শুরু করেন আরেক যুদ্ধ। সারাটা জীবন তিনি সমাজ হিতৈষী-সংস্কারক হিসাবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। দেশের করোনা মহামারিকালে করোনা চিকিৎসায় কুড়িলে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ ছিল আর্তমানবতার সেবার অনন্য নিদর্শন। করোনা মোকাবিলার জন্য বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেও দিয়েছিলেন ১০ কোটি টাকা। তা ছাড়াও নিজ প্রতিষ্ঠানে তৈরি করেছিলেন স্বল্পমূল্যের হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ২০২০ সালের ১৩ জুলাই তিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ শেষে জীবনের কাছে হার মেনে মাটির পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে ৭৪ বছর বয়সে শেষ গন্তব্যে পাড়ি জমান।

কোনো ধরনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও নুরুল ইসলাম রাজনৈতিক নীতিনিষ্ঠার জন্য জেল-জুলুমসহ অসহনীয় মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। চারদলীয় ঐক্যজোট সরকারের অপশাসনকালে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের সংবাদ পরিবেশন নিয়ে তাকে রোষানলে পড়তে হয়েছিল। তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর হুমকি, মিথ্যা-ভুয়া-বানোয়াট মামলা ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি তার কাক্সিক্ষত কর্ম যথাযথভাবে পালন করে গেছেন। ২০০৩ সালে রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের ড্রেজারকর্মী হত্যা ও তখনকার বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। ২০০৭ সালে দুর্নীতি, অবৈধ সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে তার এবং যমুনা গ্রুপের ৭টি কোম্পানির বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মামলা দায়ের করে। সব অশুভ শক্তির হয়রানি-প্রতারণামূলক দুরভিসন্ধিকে নিধন করে বাবুল ভাই সৃজন-মনন-প্রগতিশীল চিন্তা চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে উদারনৈতিক-গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিমানস নির্মাণে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্যমান।

আজীবন তার প্রার্থনায় বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ‘ত্রাণ’ কবিতার অমীয় বাণী স্মরণযোগ্য : ‘এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে, হে মঙ্গলময়,/ দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়-/ লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর।/ দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার,/ এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে/ এই নিত্য অবনতি, দন্ডে পলে পলে/ এই আত্ম-অবমান, অন্তরে বাহিরে/ এই দাসত্বের রজ্জু, এস্ত নতশিরে/ সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার/ মনুষ্যমর্যাদাগর্ব চিরপরিহার-/ এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে/ চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে/ মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে/ উদার আলোক-মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে॥’ আধুনিক ধ্যান-ধারণায় বশীভূত অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক দেশগঠনে তার উপলব্ধি ছিল অতুলনীয়। জীবন প্রবাহের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি দেশমাতৃকার কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করেছেন। শুধু গণমাধ্যমকে উচ্চকিত করেননি, সাংবাদিকতা পেশার উত্তরণে তার অবদান অপরিসীম। প্রয়াত এ মহান ব্যক্তিকে স্মরণ করা যে কোনো মানুষের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করি। আজকের এ দিনে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

 

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম