Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রকৃতির প্রতিশোধ বড্ড নির্মম

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রকৃতি কীভাবে তৈরি হয়েছে, এর ব্যাখ্যা দেওয়া এখানে অযৌক্তিক। সচেতন মানুষ বোঝেন। কিন্তু প্রকৃতিরও যে একটা প্রতিশোধ আছে, এটা বুঝতে আমরা অনেকেই উদাসীনতা দেখাই। যদিও এর প্রতিশোধ থেকে নিস্তার পাওয়া অতটা সহজ নয়। আমাদের অজান্তে প্রকৃতি তার কাজ নীরবে করে যায়। একজন মহান নেতার এক ‘সুপুত্র’ ছিল। বাপ-মা তাকে খুব আদর করতেন। সুপুত্র বলছি এ কারণে যে, জীবনের প্রারম্ভেই সে জীবনের সব রকমের স্বাদ উপভোগ করত। উচ্ছৃঙ্খলতা, মস্তানি, খুন ও বোতল ফুস পর্যন্ত। একদিন সে মাতাল অবস্থায় বন্ধুদের নিয়ে মহাসড়কে গাড়ি চালাতে গিয়েছিল। পথের সোজা রাস্তা তার চোখে বাঁকা মনে হচ্ছিল। গাড়িটা সোজাভাবে চালাতে গিয়ে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা লাগে। বন্ধুরাসহ সুপুত্রের সেখানেই জীবন মঞ্চের যবনিকাপাত ঘটে। এমন ঘটনাকে আমরা প্রকৃতির প্রতিশোধ বলতে পারি, যাকে বলে বিনা মেঘে বজ পাত। বাবা কাউকে এজন্য দায়ী করতে পারেননি। একটাই সান্ত্বনা-‘আল্লাহর মাল আল্লাহই নিয়ে গেছেন’। এমনই লাখ লাখ ঘটনা আমাদের অজান্তে চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, আমাদের একটুও ভেবে দেখার সময় নেই। ‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন’-একটা নিদান সান্ত্বনা। কিন্তু আমরা প্রকৃতির অনুকূলে কাজ করে কি প্রকৃতির এমন নির্দয় দহন থেকে বাঁচতে পারি না? মুখে স্বীকার করি আর না করি, আগুনে হাত দিলে হাত তো পুড়বেই। এটাও তো প্রকৃতির প্রতিশোধ।

প্রায় দশ দিন হতে চলল পত্রিকার উদ্দেশে কলম ধরিনি। ভেবেছিলাম, ছাত্রছাত্রীদের কোটা আন্দোলনটা শেষ হোক, তারপর লিখব। এ বিবাদটা তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। জানি, বিষয়টা পুরোপুরি সরকারের হাতে, যদিও তা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ২০১৮ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘কোনো কোটাই আর থাকবে না’-সম্ভবত এমন ভাষায় কথাটা বলেছিলেন। তখনই তার বলার ভঙ্গি শুনে বুঝেছিলাম, আজ হোক কাল হোক, ঝামেলা একটা আসতে বাধ্য। সে ঝামেলা এখন শুরু হয়েছে। বিষয়টার যৌক্তিক মীমাংসা কঠিন কিছু নয়। জেদাজেদি করলেই যত সমস্যা। তেপ্পান্ন বছর হয়ে গেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কোটা পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা এখন সময়ের দাবি। এটাকে কেউ উঠিয়ে দিতে চায় না, উঠিয়ে দেওয়া ঠিকও নয়। তবে সংশোধনযোগ্য। আশা করি, সরকার অল্পে সংযত হবে। দুর্মুখেরা বলছেন, সরকার এ আন্দোলনকে চাঙা করে অন্যদিকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চাচ্ছে। মাস্টার মানুষ, এত রাজনৈতিক বুদ্ধি ও কৌশল আমার মাথায় ধরে না; যা বুঝি সোজাসুজি বুঝি। এখানেই রাজনীতিকদের সঙ্গে আমার চিন্তার পার্থক্য। একজন যশস্বী সাংবাদিককে লিখতে দেখেছিলাম, ‘গুলি মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’। আমাদের মগজটা জটিল রোগে ভুগছে। আরেকটা কারণে এ কদিন লিখিনি। মূলত লেখায় খেই হারিয়ে ফেলছিলাম; কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা লিখব। আমার জীবনের মতো দেশের ভাগ্যটা তো সব দিক দিয়ে ক্রমেই গুটিয়ে আসছে। ভেতরের চোখে দেখতে পাচ্ছি; যাকে বলে, ‘সর্ব গায়ে ব্যথা’। শুধু কথায় কতক্ষণ আর চিড়ে ভেজানো যায়! প্রকৃতির দহন থেকে তো বাঁচানো যায় না।

আসলেই এদেশের সমীকরণ বড্ড জটিল। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। বুদ্ধি হচ্ছে দেশে বসে, এমপি আনারের মাংস যাচ্ছে কলকাতার সেপটিক ট্যাংকে। হত্যাকাণ্ড ও কৃতকর্মের মতোই মাংসের টুকরাগুলো দুর্গন্ধে ভরা। এ গন্ধ শুধু এমপি আনারের পচা মাংসের নয়, তিনবার ‘জনপ্রিয় বলে মনোনীত’ জনপ্রতিনিধির সোনা চোরাচালান, হুন্ডি ব্যবসা, মাদক-ব্যবসা ও রাজনৈতিক ব্যবসার পচা দুর্গন্ধ। কীভাবে, কিসের জোরে তিনি রাজনৈতিক বড় কর্তাদের চোখে জনপ্রিয় হয়ে মনোনীত হয়েছিলেন, অনেক দুর্মুখকে আমার চোখের সামনে সত্য বলতে শুনেছি। এদেশে এটা ওপেন-সিক্রেট। মনে হয়, এক ‘এমপি আনারকাণ্ড’ এদেশের মহান রাজনীতিকদের মুখোশ ও স্বরূপ অনেকটাই উন্মোচন করে দিয়ে গেছে। এটাও প্রকৃতির প্রতিশোধ। আমাদের ভেবে দেখার সময় নেই, কিংবা আমরা ইচ্ছা করেই ‘কাণ্ডটাকে’ এড়িয়ে যাচ্ছি। আরেকটা বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য-এদেশে সব ধরনের অন্যায়, দুর্নীতি, প্রতারণা, কোষাগার লুণ্ঠন ইত্যাদি অপকর্ম করে রাজনীতির ছায়াতল বা নামকীর্তন ছাড়া পার পাওয়া পুরোপুরি অসম্ভব। সেজন্যই রাজনীতির বাজারে এত নেতার সমাগম, এত ভিড়। ‘কালা জাহাঙ্গীর’, ‘মুরগি মিলন’ গংও পরিণামে এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। প্রকৃত রাজনীতিকদের বাজারে মন্দাভাব। বেশ কবছর আগে টিআইবি এদেশের শতকরা কতভাগ এমপি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, তার ফিরিস্তি দিয়েছিল। শুধু এমপি ছাড়াও লাখ লাখ নন-এমপি নেতাও তো এদেশে দুর্দম প্রতাপে যত অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু এমপিরাইবা দোষের ভাগী হতে যাবেন কেন? অনেক দিন টিআইবি এ বিষয়ে চুপ। হয়তো দুর্নীতি ও লুটপাটের লোম বাছতে গেলে প্রতিটি সেক্টর, বিভাগ, প্রতিষ্ঠান ও অতি সম্মানিত বলে খ্যাত মহারথিদের কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। এতদিনে হয়তো দুর্নীতি আরও শতগুণ বেড়ে গেছে। জরিপ না হলেও আমাদের মুক্ত-চোখ তো এখনো জীবিত আছে। দুর্নীতি এখন আরও ডালপালা প্রসারিত করে ফুলে-ফলে চোখ ধাঁধানো পূর্ণরূপ ধারণ করেছে। এ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ ভুলে যাওয়া অধ্যায়ের মতো অনেক কম। কোটা সিস্টেম নিয়ে আন্দোলন হয়, ক্ষমতায় বসার জন্য আন্দোলন হয়, কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ানো নিয়ে সামাজিক আন্দোলন হয় না, আরও শত শত দুর্গন্ধযুক্ত কিছু নিয়ে টুঁ-শব্দটিও হয় না। বানের পানির মতো-যেখানে বাড়ে, সেখানেই আস্তে আস্তে আবার স্তিমিত হয়ে শুকিয়ে যায়, অথবা বঙ্গোপসাগরের দিকে ক্রমে সরে পড়ে।

অনেকবার ‘বালিশকাণ্ড’ নিয়ে এ কলামে লিখেছি, কোনো প্রতিকার হয়নি, বরং নানাবিধ এমন ‘কাণ্ডের’ প্রসার ও নির্বিঘ্ন বিস্তার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমরা নিশ্চুপ। রূপপুরের ‘বালিশকাণ্ড’ দেশব্যাপী স্বরূপে ‘ছাগলকাণ্ডে’ পর্যবসিত হয়েছে। দু’মুখ খোলা বস্তার মতো করের অর্থকড়ি জনকোষাগারে কেন দাঁড়াতে চায় না, তার হেতু প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসাবে সবার সামনে উন্মুলিত হচ্ছে। ওই বিভাগের অজস্র ‘ছাগলকাণ্ডের’ হদিস খোঁজার কারবা দায় পড়েছে! আমরা বারবার একটা কথা বলেই খালাস-‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’ ব্যস, দায়িত্ব শেষ। এদেশে শুধু ‘ছাগলকাণ্ড’ কেন, কত ‘হাতি-ঘোড়াকাণ্ড’ তল হয়ে গেল, আর ‘সামান্য ছাগলকাণ্ড’ জল মাপতে এসেছে। ‘ছাগলকাণ্ড’ নিছক অজুহাত মাত্র। এক নালায়েক ছেলে অদূরদর্শিতাবশত ‘মতিউর রহমান গংকে’ প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসাবে জানান দিয়েছে। এতেও যদি আমাদের চৈতন্যোদয় না হয়, প্রকৃতিইবা আর কী করতে পারে বলুন? এতে আমরা হয়তো গলার স্বরটাকে একটু ভারী করে বলতে পারি-‘কোনো ধরনের দুর্নীতি বরদাশত করা হবে না।’ ব্যস, ওই পর্যন্তই। অন্য কোনো বক্তব্য আমাদের আর থাকার কথা নয়। কত মতিউর রহমান এলো-গেল, দেশ লুট, ব্যাংক লুট, কোষাগার লুট করল, এ আর তেমন কী! ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।’ আমাদের কাজ ও চিন্তা যখন মুখসর্বস্ব হয়ে যায়, তখন এমন দশাই হয়।

পুলিশ বিভাগের এক বেনজীর সম্পদ লুট করে পালিয়েছে, তো তাতে কী হয়েছে? শত বেনজীর সে পদ ও আদর্শ পূরণ করার জন্য খাড়া হয়ে আছে। প্রকৃতি ছাড়া সে দশা খুঁজে পাওয়ার মানুষ এদেশে বিরল। সে জন্য আমরাও প্রকৃতির ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকি। আবার বেনজীর তো শুধু নিজ কুলকেই নাশ করে সরে পড়েনি, শিক্ষার পাদপীঠ ও জাতির গর্ব বিশ্ববিদ্যালয় নামের গৌরবকেও কলঙ্কিত করে মজিয়ে ছেড়েছে, যে উপসর্গ ও ঘটনা এ কলামেই আগে লিখেছি। অবশেষে প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হয়েছে। ওই কুলের আরও অনেক কুলনাশার নাম পত্রিকায় ভেসে আসছে, সময় হলে কিছু জানা যাবে; বাকিটা এদেশের স্বাভাবিক ক্ষমতার দাপটেই চাপা পড়ে যাবে।

এছাড়া সব পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের খবর এতদিনে পড়তে পড়তে অবশেষে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের খবরও পত্রিকায় পড়তে হচ্ছে। টাকা কীভাবে কত কার কার কাছে গেছে, সব বেরিয়ে আসছে। ধৈর্য আর কতক্ষণইবা ধরে রাখা যায়। সরকারি পেনশন বাতিলের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় ভোগা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের ফিরিস্তি ও সম্ভাব্য সমাধানের কথা আজ নাইবা বললাম। মরার আগে এক জনমে আর কী কী দেখার বাকি আছে, তার ফর্দ তৈরি করতে বসব ভাবছি। এক জনমে এত কিছু দেখা-এটাও একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।

যুগান্তরে (১৩.০৭.২৪) পড়লাম, ‘ডলার আয় উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে’। সংবাদে লেখা, ‘রপ্তানি আয়ের তথ্য সংশোধনের ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেছে। এর মধ্যে আগে রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধি ছিল, এখন তা নেতিবাচক।...বৈদেশিক মুদ্রার আর্থিক হিসাব ও চলতি হিসাব আগে থেকেই ঘাটতিতে ছিল, এখন ওই ঘাটতি আরও বেড়েছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।’

আমি গ্রামের মানুষ হিসাবে ছোটবেলা থেকে ঋণ করে ঘি খাওয়ার বদভ্যাসের কথা শুনে আসছি। দেশীয় পর্যায়ে ঘিয়ের ব্যবহার কম। আমাদের ঋণের টাকা অনেকটাই ‘বালিশকাণ্ডের’ মতো বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন পর্যায়ে সিস্টেম-লসে খেয়ে যায়, অধিকাংশ বিদেশে পাচার হয়। দেশে থাকলে সাদা হোক, কালো হোক, ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়লেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সেখানকার উচ্ছিষ্ট খেয়ে কিছুটা হলেও টিকে থাকত। বিদেশে পাচার করাতে তাও হওয়ার নয়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল চিন্তিত বলেও মনে হয় না। প্রয়োজনে ঘাটতি পূরণে অন্যের কাছে হাত পেতে ঋণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করে।

জীবনের এই বেলাশেষে এসে এই সুজলা-সুফলা দেশের বিবর্ণ দশা দেখে বিরান প্রান্তরে বসে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তাতেও কি শেষ রক্ষা হবে? এই ছোট্ট একটা দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা কি এতই কঠিন?

আমি আমাদের পাশের গ্রামের রহম পাগলার গল্পটা অনেকবার অনেক জায়গায় লিখেছি। আরেকবার বলি : সে বাজারের এক মেয়ের সঙ্গে ঘর বাঁধতে গিয়ে প্রতারিত হলে তার ‘মাথা খারাপ’ হয়ে যায়। নিজের চলার পথের দিকে এক নিবিষ্টে তাকিয়ে, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে অনবরত একটা গানই অনুচ্চস্বরে গেয়ে পথ চলত সে-‘আমি যা চেলাম তা পেলাম কই, তুমি কেন মজালে সই বাজারে এনে।’ এখন গ্রামে যাওয়া হয় না বললেই চলে। সেই রহম পাগলা বেঁচে আছে কি নেই-অনেক বছর খোঁজ রাখা হয়নি।

ড. হাসনান আহমেদ, এফসিএমএ : অধ্যাপক, ইউআইইউ; সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম