বিষয়টির দ্রুত সমাধান দরকার
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনটি যে এতদূর এসেছে, এটাই অবাক হওয়ার বিষয়। এর কারণ হচ্ছে, বিষয়টির খুবই সহজ সমাধান ছিল। এই কোটাব্যবস্থাকে ২০১৮ সালে যখন বাতিল করা হলো, তখন পুরোটা বাতিল করা ঠিক হয়নি। যা হোক, হাইকোর্ট সেই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সরকারকে বলেছিলেন রেক্টিফাই করতে। যেহেতু পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর বিষয়টি সংবিধানে উল্লেখ আছে, সেহেতু সরকার রেক্টিফাই করলেই হয়ে যেত। দেখলাম, সরকার নিজেই হাইকোর্টে সেটাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এখন চ্যালেঞ্জ করে চুপ করে থাকার কারণেই তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। এরপর তাদের কারও কারও বক্তব্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে, সাংবাদিকরাও নানা প্রশ্ন করেছেন, এসব করে পুরো বিষয়টি একটা জটিল থেকে জটিলতর জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এসবের কোনো দরকার তো ছিল না।
সরকারে যারা রয়েছেন, তারা এখন বলছেন, চাকরির ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে করার সুপারিশ তারা করবেন। এটা আগে বললেই কিন্তু হয়ে যেত। সাধারণত যে কোনো কোটা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বার্থে দেওয়া হয়ে থাকে। যখন ওই ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিদের জন্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখনই সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে আপত্তি ওঠে। এটা তো যুক্তিসংগত আপত্তি। তারা তো কোটা বাতিলও চায়নি। যারা সামাজিকভাবে পিছিয়ে আছে, তাদের জন্য যুক্তিসংগত কোটা সুবিধা তারা চেয়েছে। এখন দেশে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার যারা রয়েছে, তাদের মোটামুটি সবার অবস্থাই ভালো। তারা কেন বিশেষ সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন, তারা সবাই তো প্রায় মেধাবী। সেখানেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আপত্তিটা দেখা দিয়েছে, সন্দেহ নেই। তারা মনে করেছে, তাহলে আমি পড়াশোনা করে কী করব। কাজেই সরকারের পক্ষ থেকে এখন যেটা বলা হচ্ছে, তা আগে ঘোষণা করলেই পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যেত না। সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও তো প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তোমরা হতাশ হবে না, সরকার আদালতে এ ব্যাপারে সুপারিশ করবে।
আমি জানি না, প্রধানমন্ত্রীকে কারা অ্যাডভাইস করেন। তবে আমি মনে করি, বিষয়টি খুব সহজেই সমাধান করা যেত। আমি আশা করব, দ্রুতই আদালতে বিষয়টির সুরাহা হবে। এখন সরকারের পক্ষ থেকে ৮০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে রাখার যে কথাটা বলা হচ্ছে, তার মানে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে দাবি, সেটাকেই মেনে নেওয়া হয়েছে। এখন এটা যত দ্রুত আদালতের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া যায়, ততই সবার জন্য ভালো। এতে অন্তত সাধারণ ছাত্রদের যে দাবি, সেটাকে সম্মান জানিয়ে একটা স্তর হয়তো শেষ হবে। তবে আরেকটি যে বিষয়, সেটি হচ্ছে এর মাধ্যমে অনেকেই হয়তো সুযোগ-সুবিধা নিতে চাইবে। রাজনীতির খেলাটাই হলো এমন; কিন্তু সেটার সঙ্গে সাধারণ ছাত্ররা তো জড়িত না। তাদের এটা নায্য দাবি যে, আমি কেন তাহলে এত খেটে পড়াশোনা করছি। আমি তো কোটার মধ্যে থাকবো না। সরকার যেখানে নিজেও চাইছে কোটা সংস্কার করতে, সেখানে বিষয়টি যদি তারা আগে থেকেই, মানে ৭দিন আগেই যদি বলতে পারতো, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও যদি তা থাকত, তিনি বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের হতাশ হতে হবে না। কিন্তু তিনি যদি আগেই পরিষ্কার করে বলতেন, ৮০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে করার সুপারিশই আমরা করতে চলেছি, আমি তো মনে করি সেদিনই আন্দোলন থেমে যেত। কিন্তু সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী পরবর্তীকালে বলেছেন, আমরা আলোচনায় বসবো। তখন শিক্ষার্থীরা বলেছে, আমরা কেন আলোচনায় বসবো? আমি জানি না, কারা প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়, সহজ সমাধানটাকে জটিল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকারপ্রধানের তো একার পক্ষে সবকিছু চিন্তা করা কঠিন। যারা তার পরামর্শদাতা, তাদের উচিত ছিল বিষয়টি যাতে আরও সহজ হয়, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়া।
মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি যতদিন সন্তানদের মধ্যে ছিল, ততদিন কেউ তো আপত্তি করেনি। কিন্তু যখনই এটা নাতি-পুতিদের দিকে নিয়ে আসা হলো, তখনই আপত্তিটা এসেছে। তবে এরপরও সরকার চাইলে পর্যায়ক্রমে এটা রাখতে পারে। যেমন, কোনো শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে যদি সত্যিই কেউ খারাপ অবস্থায় থাকে, তাহলে তার বিষয়টি দেখা হতে পারে। সেদিক বিবেচনায় ১-২ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা রাখতেও পারতো সরকার। আমি বলতে চাইছি, সব শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হয়তো ভালো অবস্থায় আসতে পারেননি। তাদের জন্য সরকার এগিয়ে আসতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, কোটা ব্যবস্থাটা সব সময় সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যই দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু যারা ইতোমধ্যেই ক্ষমতাবান, তাদের জন্য যদি কোটা রাখা হয়, সেটা তো স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ চাইবে না। এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।
এখন সরকারের কেউ কেউ বলছেন, বিরোধী মহল আন্দোলনটার সুযোগ নিচ্ছে। সেটা যদি হয়েও থাকে, তবে ক্ষমতাসীন দলকে তা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ হয়ে আন্দোলনটা করছে, এ ধরনের বক্তব্য দেওয়াটা ঠিক নয়। কারণ কোটা সংস্কার আন্দোলনটা তো কোনো বিশেষ দলের হয়ে করা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এ আন্দোলনটা করছে। আমি মনে করি, বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করা দরকার। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ মারা গেছেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার করা দরকার।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক ও বিশ্লেষক
