Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মিথ্যা অভিযোগের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিভিন্ন সূত্রমতে, সাম্প্রতিককালে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি-দুর্নীতি-ধর্ষণ-নারী নির্যাতনসহ বহু ছোট-মাঝারি ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত। হত্যা-আত্মহত্যা-অর্থ পাচার-মাদক-অস্ত্র ক্রয় ও বিক্রয়-কিশোর গ্যাং এবং নানামুখী অসামাজিক অপরাধজনিত মামলার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ভূমিদস্যু, জাল দলিল, ভূমি-জলাশয়-নদী-নালা-খাল-বিলের জোরপূর্বক দখল নিয়ে নানাশ্রেণির প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। জনশ্রুতি মতে, দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থায় হিংসা-প্রতিহিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতায় নানাভাবে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা-বানোয়াট-ভিত্তিহীন অভিযোগে সৎ-নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসানোর যেন মহোৎসব চলছে। সততা-যোগ্যতার অবমূল্যায়ন, মিথ্যা-ভিত্তিহীন অভিযোগে শতভাগ নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত-বিচারের নামে হয়রানি অহরহ প্রচারিত। নিরীহ-দরিদ্র-অসহায় ব্যক্তিদের ন্যায্য বিচার বঞ্চনার আর্তনাদ পুরোদেশকে যেন চরম অস্থিতিশীল করে তুলছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া যে কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিলকেন্দ্রিক ঘুস বা অনৈতিক অর্থ লেনদেনের রমরমা ব্যবসা চলমান।

২০২৩ সালের আগস্ট মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইন কমিশনের প্রতিবেদন মতে, আদালতে মিথ্যা-ভিত্তিহীন ও হয়রানিমূলক মামলা বা অভিযোগ দায়ের মহামারি আকার ধারণ করেছে। এজন্য অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি বিনা কারণে কারাভোগ, অহেতুক হয়রানি ও নানা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে; বিশেষ করে ফৌজদারি মামলায়। পুলিশের গবেষণায় মিথ্যা মামলার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। মিথ্যা মামলা দায়ের হওয়ার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারও তেমন জানা নেই। ২০২২ সালে প্রকাশিত উক্ত সংস্থার এক গবেষণায় মিথ্যা মামলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়; প্রতিপক্ষকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন-হয়রানি-আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, আসামি পক্ষের দায়েরকৃত মামলার দায় থেকে বাঁচার জন্য পালটা কৌশল হিসাবে মিথ্যা মামলা করা, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, দায়দেনা থেকে অব্যাহতি পাওয়া, প্রভাবশালী মহল কর্তৃক দুর্বলকে কষ্ট দেওয়া, অজ্ঞ বিচারপ্রার্থীদের টাউট-বাটপারদের কুপরামর্শ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে এবং আর্থিক লাভের আশায় মিথ্যা মামলা করা হয়।

মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের শাস্তি প্রযোজ্য; দেশবাসীর অনেকেই তা অবগত নন। আইনজ্ঞদের মতে, মিথ্যা মামলা দায়ের করলে আইনের শাস্তির বিধান রয়েছে। এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। মিথ্যা অভিযোগকারী কিংবা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো, ওই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে হবে। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের যদি মনে হয়, আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা-ভিত্তিহীন-তুচ্ছ-বিরক্তিকর-হয়রানিমূলক এবং আসামির প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে মামলাটি করা হয়েছে, তাহলে এ ধরনের মামলা মিথ্যা হিসাবে গণ্য হবে। মামলা মিথ্যা বা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট মামলা দায়েরকারীকে দণ্ড দিতে পারেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্বপ্রণোদিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারবেন। আমলযোগ্য নয় এমন মামলায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধেও ২৫০ ধারা মতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়া সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বাদী হয়ে পৃথক মামলা দায়ের করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পুলিশ রেগুলেশন্স বেঙ্গল, ১৯৪৩ এর ২৭৯ ধারা অনুসারে তদন্তকালে কোনো মামলা বিদ্বেষপ্রসূতভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের কাছে মামলার বাদীর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৮২ বা ২১১ ধারা অনুসারে প্রসেস ইস্যুর আবেদন করতে পারবেন।

দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে মিথ্যা মামলার সাজা হলো দুই বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম ও বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় ধরনের দণ্ড। যদি মিথ্যা মামলা কোনো মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা সাত বছর বা তার বেশি মেয়াদের কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ সম্পর্কে দায়ের করা হয়, তাহলে মিথ্যা মামলা দায়েরকারী বা বাদী সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এর সঙ্গে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ১৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তাহলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন উক্ত ব্যক্তি অনধিক সাত বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

গবেষণায় আরও বলা হয়, মিথ্যা মামলার বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রসিকিউশনের সঠিক উদ্যোগ নেই। আবার কাজের চাপ, মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি, লোকবলের অভাবসহ নানা কারণে আদালতও ২১১ ধারায় করা আবেদন কম মঞ্জুর করে থাকেন। এসব কারণে মিথ্যা অভিযোগের মামলার বাদীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে কাগুজে নিয়মে পরিণত হয়েছে। অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কিংবা বাদী-বিবাদীর আপসরফার কারণে তদন্ত কর্মকর্তা বাদীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চান না। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতেও কখনো কখনো প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা। মিথ্যা অভিযোগের মামলার কারণে আদালতের সময় নষ্ট এবং বিবাদী আর্থিক ক্ষতি-হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিচারিক কার্যক্রমও নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে।

১৬ মে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখ যায়, নিম্ন ও উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ। তন্মধ্যে সারা দেশের নিম্ন আদালতগুলোতেই অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ৩৭ লাখের বেশি। ২০০৮ সালে দেশের অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল প্রায় ১৫ লাখ। আদালত সূত্র অনুসারে, সারা দেশের আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে মোট ৪২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০৪টি মামলা। এগুলোর মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ২৬ হাজার ৫১৭টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৭টি। আপিল বিভাগে থাকা মামলাগুলোর মধ্যে দেওয়ানি ১৬ হাজার ৬৭, ফৌজদারি ১০ হাজার ২৭০ এবং আদালত অবমাননাসংক্রান্ত ১৮০টি। হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার মধ্যে দেওয়ানি ৯৫ হাজার ৫৩টি, ফৌজদারি ৩ লাখ ২২ হাজার ৫৬৪ এবং রিট ১ লাখ ৬ হাজার। ২০২৩ সাল নাগাদ অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারাধীন ৩৭ লাখ ৭ হাজার মামলার মধ্যে দেওয়ানি ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪৪টি এবং ফৌজদারি ২১ লাখ ১০ হাজার ৬৯৬টি। এগুলোর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার সংখ্যা যথাক্রমে ৪ লাখ ১১ হাজার ৬২৫ ও ৩ লাখ ৬২৯। বিজ্ঞ আইনজীবীদেরও অভিমত, দেশে মামলাজটের মূল কারণ মিথ্যা মামলা বা অভিযোগ।

অভিজ্ঞ মহলের মতে, কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ যে কোনো সংস্থার কাছে প্রদত্ত হলে সংস্থার প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত অভিযোগকারীর পরিচয় এবং অভিযোগের উদ্দেশ্য কোনো হীনস্বার্থে করা হচ্ছে কিনা তার যথার্থ নিরপেক্ষ অনুসন্ধান। পরিপূর্ণ তদন্ত শেষে অযাচিত মামলার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিযোগকারীর অভিযোগ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত-চক্রান্তমূলক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তদন্ত পরিক্রমায় যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার পরিবার ও সমাজে সম্মানহানির দীর্ঘ ক্ষত তৈরি হয়ে যায়। আইনের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাশীল জনগোষ্ঠী আইন-আদালতের সত্যনিষ্ঠ বিচার কার্যক্রমে এখনো পুরোপুরি নির্ভরশীল। যথার্থ অর্থেই অভিযোগের সত্যতা নির্ধারণে প্রশিক্ষিত ও পারদর্শী কর্মকর্তাদের নিয়োগ আবশ্যক। অকাট্য প্রমাণ এবং প্রযোজ্য সততার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্রের বাহনগুলোর ভূমিকা অতি তাৎপর্যপূর্ণ। চৌকশ তদন্তকারীদের সমন্বিত নিগূঢ় ও পুনঃ-ক্রস যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে অবশ্যই কঠোর শাস্তির পরিদৃশ্যমান ব্যবস্থা একান্তই প্রয়োজনীয়।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম