ব্রহ্মপুত্রের মরণদশা ও বিপন্ন জনপদ
মো. অহিদুর রহমান
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানুষের অবিবেচনাসুলভ কর্মকাণ্ডের ফলে পৃথিবীর ১৫তম বৃহৎ জলধারা ব্রহ্মপুত্র নদ ও বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর প্রায় সব নদ-নদী এখন হুমকির সম্মুখীন। দখল, দূষণ, নগরায়ণ, অপরিকল্পিত খনন, ব্রিজ, বাঁধ, পানিপ্রবাহ, ভিন্ন মুখকরণ, অতি আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি এক বা একাধিক কারণে লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগো, কলোরাডো, হার্ডসন (যুক্তরাষ্ট্র), টেমস (যুক্তরাজ্য), দানিয়ুব, রাইন (ইউরোপ), নিল (মিসর), হোয়াংহো, ইয়াংসি (চীন), সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র (ভারতীয় উপমহাদেশ) ইত্যাদি নদ-নদী এবং এগুলোর শাখা-প্রশাখাসহ পৃথিবীর জলধারা এখন মহাসংকটে। বাংলাদেশের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ এখন যেন মরা লাশ।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পললগঠিত সমতল ভূমি ও হাওড় অঞ্চলের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সম্পদ বিনিময় ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে টিকিয়ে রেখেছিল এ অঞ্চলের জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২৭১টি নদ-নদী। এসব নদীর জলের পলিধারা সবুজ হয়েছে এ জনপদের প্রকৃতি, ফসলের খেত, ভরেছে কৃষকের গোলা, নদীতীরে গড়ে উঠেছে সভ্যতার চিহ্ন। বহু পেশাবৈচিত্র্যের মানুষ খাদ্যে, পুষ্টিতে প্রতিপালিত হয়েছে। নদীতে চলেছে পালতোলা নৌকা, মাঝি গান গেয়ে নাইওরিকে নিয়ে গিয়েছে আপনজনের ঠিকানায়। নদীর প্রকৃতি তৈরি করেছে কবি, লেখক, গায়ক, বাউল। নদী জীববৈচিত্র্য বাঁচায়, সেচে পানি দেয়, সাহিত্যে উপকরণ দেয়। যে ব্রহ্মপুত্রের জলে জেলের জীবন, কৃষকের সেচের পানি, জীবন সংসার, তার পায়ে আজ কেন শিকল। দখল, দূষণ, ভরাটের প্রতিযোগিতা কার স্বার্থে?
ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ৫ কোটি বছর আগে টেকটোনিক প্লেটের মহাসংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট হিমালয়ের কৈলাস শৃঙ্গের মানস সরোবরের আঙ্গসি হিমবাহের ৫,২১০ মিটার উঁচু (১৭,০৯৩ ফিট) থেকে জন্ম নেওয়া ব্রহ্মপুত্র সৃষ্টি হয়ে তিব্বতের বুকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম উপত্যকা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারতের আসাম হয়ে পরবর্তী সময়ে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার পাখিউড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার পাগলারচর হয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের কাছে যমুনার সঙ্গে মিলে পদ্মায় প্রবাহিত হয়েছে যমুনা নদী হিসাবে।
জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, শেরপুরের নকলা শেরপুর সদর, ময়মনসিংহের ফুলপুর, ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল, গফরগাঁও, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, ভৈরব, কটিয়াদী, কুলিয়ারচর, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর, নরসিংদীর বেলাব অতিক্রম করে ভৈরব বাজারের দক্ষিণে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। অঞ্চলভেদে সাংপো (তিব্বত), ইয়ারলুং জাংবো (চীন), লৌহিত্য, লোহিত, দিহাং (আসাম), পুরাতন ব্রহ্মপুত্র (বাংলাদেশ) নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক এ নদটিকে সাধারণত বাংলাদেশে এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নামে ডাকা হয়।
ব্রহ্মপুত্র নদ তার যাত্রাকালে বেশকিছু উপনদীর জন্ম দিয়েছে। উপনদীর সংখ্যা ১৮ ও ১৭টি শাখা নদী। বাংলাদেশের ভেতরে উপনদীর মধ্যে রয়েছে ধরলা, তিস্তা, মৃগী, গিরাই, গঙ্গাধর, দুধকুমার, দিবাং, লৌহিত, ধানসিঁড়ি, কামেক, রায়ডাক, জলডাকা, কালজানি, তোরসা, নাগর, দুপচাপিয়া, যমুনেশ্বরী, আত্রাই নদী। শাখা নদীর মধ্যে আছে ঝিনাই, আইমান, আখিলা, বানার, সুতিয়া, শীতলক্ষ্যা, নরসুন্দা, আড়িয়াল খাঁ, ঘাঘট, বাঙালি, বড়াল, গঙ্গা, নারদ নদ, তুলসী গঙ্গা, শিব বরনাই, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা।
ব্রহ্মপুত্রের যাত্রাপথে অসংখ্য চর ও দ্বীপের জন্ম হয়েছে। এ নদের মাজুলি দ্বীপকে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী-দ্বীপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উৎস থেকে চীন ও ভারতে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে বুঢ়হিদিহিং, দিখু, কপিলা, সুবানসিরি, কামেং, মানস, সংকোষের মতো জলপ্রবাহ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পুরাতন ব্রহ্মপুত্রকে ‘নদী’ এবং ব্রহ্মপুত্রকে ‘নদ’ হিসাবে উল্লেখ করেছে। এছাড়া উত্তর-পশ্চিম হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলে যমুনা, তিস্তা ও ধরলার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, জামালপুর, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপন্ন হয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মেঘনা নদীতে মিশেছে। ২৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর অববাহিকা ৫,৪৩১ বর্গকিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও জামালপুরের নদ ব্রহ্মপুত্র তিব্বতের কৈলাসটিলার মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে যমুনা নদীতে মিশেছে। ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদের অববাহিকা ২,৫৯০ বর্গকিলোমিটার। নদী খতিয়ানে যদি এরা উভয়েই ‘ব্রহ্মপুত্র’ হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় দলিলে এ জলধারার একক পরিচয় থাকাটা খুবই দরকার।
যাতায়াতের সুবিধার জন্য নদীতীরে গড়ে ওঠে নগর-জনপদ। যোগাযোগের জন্য ব্রহ্মপুত্র ছিল যেন এক তরল মহাসড়ক। নদীপথে লঞ্চ, স্টিমার দিয়ে ব্যবসা চলত। নদীতীরে নগর, বন্দর, গ্রাম, থানার প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে। যেমন বেপারি নৌকা দিয়ে ব্যবসা চলত-ধান, পাট, লাকড়ি, কাঠ, বাঁশ ও মাছের ব্যবসা। নদীর তীরে গড়ে ওঠে জেলে পাড়াগুলো। সংগত কারণেই জেলেদের পেশা, জীবন-জীবিকার জন্য সম্পূর্ণভাবে ব্রহ্মপুত্র নদের জলের ওপর নির্ভরশীল ছিল তারা। নদী দখল, দূষণ, বিলুপ্তির ফলে জেলেরা পেশা হারিয়ে ভিন্ন পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। পেশার পাশাপাশি জেলেদের মাছ ধরার উপকরণগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। নদী হারিয়ে মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে চাষকৃত মাছের ওপর।
ব্রহ্মপুত্রসহ ময়মনসিংহের অনেক নদী এখন ভয়ানকভাবে বিপন্ন। তাই নদীর প্রাণবৈচিত্র্যও এখন ভীষণভাবে সংকটাপন্ন। এক সময় যেসব নদী ছিল প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ, আজ সেসব নদী পরিণত হয়েছে প্রায় প্রাণশূন্য সংকীর্ণ স্রোতধারায় কিংবা বিষাক্ত নর্দমায়। এক সময়ের বিস্মৃত অতল জলরাশি ভরা ব্রহ্মপুত্র নদ এখন দেখা যায় অবিস্তীর্ণ-অগভীর বালিয়াড়ি ভরা এক শীর্ণকায় স্রোতস্বিনী হিসাবে। আবার কোনো কোনো জায়গায় নদী সম্পূর্ণভাবে মুছে গিয়ে তৈরি হয়েছে ফসলের খেত কিংবা স্থাপনা।
ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বহু হাতি, বেঙ্গল বাঘ, চিতা বাঘ, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, বন্য মহিষ, হরিণের মতো প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যেত। এরা বেঁচে থাকার জন্য ব্রহ্মপুত্রের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল ছিল।
বাংলাদেশের প্রধান ৩০টি কৃষি-প্রতিবেশ অঞ্চলের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র পলল গঠিত অঞ্চল-৯। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অববাহিকা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। প্রবহমান জলধারা উভয় পাড়ের মাটিকে পলি দ্বারা করেছে উর্বর ও বৈচিত্র্যময় ফসলের আবাসভূমি। এ অঞ্চলের মাটি বিশ্বের সেরা উর্বর মাটির অন্যতম। ধান, গম, ডাল, তেলজাতীয় ফসল, চা, বৈচিত্র্যময় সবজি, বাদাম, আলু, আখ, ভুট্টা, পাট, মসলাজাতীয় ফসল, আগরজাতীয় সবচেয়ে সুগন্ধি কাঠ উৎপাদন হয় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়। গ্রামের মানুষ তার কৃষিকাজ, গোসল, গরুর গোসল, সবজি ও ধান খেতে সেচের জন্য নদের জল ব্যবহার করেছে। গ্রামের কৃষকের শত শত পাওয়ার পাম্প বসত নদের জলে, যে পানি দিয়ে বোরো মৌসুমের পুরো সেচের কাজ চলত। বর্তমানে পানি না থাকায় হাজার হাজার কৃষক ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে এলাকার ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে আয়রন ও আর্সেনিক। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু এখন আর ব্রহ্মপুত্রে পানি নেই। স্রোত নেই। কৃষকের কৃষি খরচ বেড়ে গেছে। পানি এখন কিনে আনতে হয় পয়সা খরচ করে। বিদ্যুতের লাইন সংযোগ না পেলে অনেক ফসলি জমি পতিত থেকে যায়। খাদ্য উৎপাদনও কমে যায়।
ব্রহ্মপুত্র যেন এক সাংস্কৃতিক বলয়। নদীর সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি বিশেষভাবে জড়িত। ছোট কবিতা, ছড়া, সনেট, কাব্য, গল্প, নাটক, উপন্যাস, গান, চলচ্চিত্র সব কিছুই নদ-নদীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষকে দিনে দিনে কবি, বাউল, লেখক, গবেষক, গায়ক, ভাবুক করে তুলেছে এ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা। ময়মনসিংহ গীতিকার অনেক গল্প, কাহিনি, শ্লোক, ছড়া নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। নদী যত বিলুপ্ত হচ্ছে, মানুষ ততই প্রকৃতি থেকে সরে যাচ্ছে। প্রকৃতি থেকে যত সরে যাবে, তত বেশি সংস্কৃতিহীন, বিপন্ন হয়ে উঠবে মানুষ।
আমাদের চিন্তার বিষয় হলো-এশিয়ান ওয়াটার টাওয়ার, এশিয়ার প্রধান নদ-নদী এশিয়ান ওয়াটার তিব্বতের মালভূমি। এ তিব্বত থেকে উৎপত্তি হয়েছে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, সিন্ধু, কার্নালি, কোশি, সালুইন, ইরাবতী, মেকঙ, ইয়াঙসি, ইয়োলোর মতো এশিয়ার বড় বড় নদী। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনামের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সরাসরি নদীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তিব্বতের মালভূমিতে যখন দুর্যোগের অভিঘাত লাগে, তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। কারণ ব্রহ্মপুত্রসহ আন্তঃসীমান্ত নদ-নদীর মাধ্যমে ভাটির দেশে চলে আসে পানি, শুরু হয় বন্যা, পাহাড়ধস। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশ, কৃষি, জীবন-জীবিকা। নদী প্রণালি হলো এ অভিঘাত আসার রাস্তা।
ব্রহ্মপুত্র নদ ১৯৮৮ সালে খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদ খনন হলে নাব্য ফিরে আসবে। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজ মাঠে এক নির্বাচনি জনসভায় ব্রহ্মপুত্র খননের কথা বলেছিলেন। ২০০৯ সালে ময়মনসিংহের নাগরিক সমাজ নৌ-পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র খনন নিয়ে মতবিনিময় করেন। ২০১০ সালে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ দল ব্রহ্মপুত্র পরিদর্শন করে। পরে ২০১৯ সালে নদের নাব্য, যাত্রীবাহী পণ্য বোঝাই চলাচল, কৃষিজমি, মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ফুলছড়ি উপজেলার পাগলারচরে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল থেকে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক পর্যন্ত ২২৭ কিমি. এলাকা ড্রেজিং করার জন্য চার বছর মেয়াদি ২৭৬৩ কোটি টাকার ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ড্রেজিং প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০২৪ সালে প্রকল্পটি শেষ হবে। কিন্তু অপরিকল্পিত ও অকার্যকর এ প্রকল্প কোনো কাজেই আসছে না। যেখানেই খনন করা হচ্ছে সেখানেই চর জাগছে, নদটি একটি সরু খালে পরিণত হচ্ছে। মাঝখানে লাভবান হচ্ছে ঠিকাদার ও বালু ব্যবসায়ীরা।
নদ-নদীকে বাঁচাতে হলে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। জরিপ করে নদ-নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। পরিবেশ নীতির বাস্তবায়ন, দূষণ হ্রাসকরণ, নদ-নদী, উৎসমুখ, শাখা নদী, উপনদী, সংযোগ খাল খনন করতে হবে। অপরিকল্পিত বাঁধ, সেতু নির্মাণ করা যাবে না। জনসচেতনতা তৈরি করা, নদী দখলকারীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেওয়া, ব্যাংক ঋণ না দেওয়া-এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
জলধারা হারিয়ে যাওয়া মানে একটি জনপদ বিপন্ন হয়ে যাওয়া। নদী হারিয়ে গেলে প্রকৃতির সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্র বিলুপ্তির কারণে পানির জন্য আজ হাহাকার। ভূগর্ভের পানি আজ অনেক নিচে নেমে গেছে। নদীর জলে এখন আর গোসল করা যায় না। নদীর দখল-দূষণ আমাদের শুধুই আহত করে। ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে ধু-ধু বালুচর, পাড়ে আজ ময়লার স্তূপ, পানিতেও ময়লা।
সভ্যতা আমাদের সঠিক মাত্রায় সভ্য করেনি। যেমন শিক্ষা আমাদের শিক্ষিত করেনি। পরিবেশ ভাবনা আমাদের ভাবিত করেনি। সংকটের আবর্তে বাস করেও আমরা নিজেদের শঙ্কিত মনে করি না। উদাসীনতা আমাদের বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করছে। বিবেক আছে, তাড়না নেই। মন আছে, মননশীলতা নেই।
ব্রহ্মপুত্র আমাদের অস্তিত্বের অংশ, আমাদের নান্দনিকতার উৎস। নদকে হত্যা করে আমরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সচল ধারাকে অবলুপ্ত করতে চাই না। নদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান ধারক ও বাহক। জীবনের বাঁক ও বোধগুলোকে নদ-নদীর নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে জীবনকে জীবন সম্পৃক্ত রাখতে হবে। জীবনের দুঃখ-বেদনা, ভাঙাগড়ার মতো নদীর ভাঙাগড়া ও নিরবচ্ছিন্নতাকে জীবনের পরিবর্তনশীল প্রত্যয়ের অনুষঙ্গ করে নদী ও জীবনকে একাকার করে দেখাই আমাদের প্রতিশ্রুতি হওয়া দরকার। আসুন, আমরা নিজেদের নিঃশর্তভাবে নদীর কাছে নিয়ে যাই। নদীকে নদীর মতো করে দিই।
সত্তর বছর আগে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ নামে যে কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেছিলেন, তাতে তিনি নদী মরে যাওয়ার ফলে একটি জনপদের মানুষ, শিক্ষার্থী, পেশা, জীবনযাত্রা কতটা বিপন্ন হয়ে উঠেছিল, তা তুলে ধরেছিলেন। তিনি যেমন নিশুতি রাতে নদীর কান্না শুনতে পেয়েছিলেন, জনপদের মানুষও মৃত নদীর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। নদী বিপন্ন হওয়া মানে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া, কৃষিভিত্তিক সমাজ ধ্বংস হওয়া, পেশা বিপন্ন হওয়া, দু’হাত বাড়িয়ে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনা।
ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় টিকে থাকার জন্য নদের অস্তিত্ব চাই, স্বাভাবিক প্রবাহ চাই। আমাদেরই গড়ে তুলতে হবে ব্রহ্মপুত্র বাঁচানোর আন্দোলন।
মো. অহিদুর রহমান : লেখক ও গবেষক; আঞ্চলিক সমন্বয়কারী, বারসিক
