ট্রমা কাটিয়ে উঠতে যা প্রয়োজন
ফৌজিয়া শারমীন হোসেন
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জুলাইয়ের প্রায় শুরু থেকেই কোটা নিয়ে আন্দোলন চলে আসছিল। আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছিল। সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব, দাম্ভিকতা ও একগুঁয়েমির কারণে দেশের ছাত্র-জনতা একসময় ফুঁসে উঠল। তারা মিছিল-মিটিং করতে লাগল। বেড়ে গেল শিক্ষার্থীদের ওপর অত্যাচার। সেই সঙ্গে পুলিশের গুলি, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, গরম পানি ছোড়াছুড়ি। অনেক ছাত্রের মাথায় ও বুকে টার্গেট করে গুলি ছোড়া হয়। শহিদ হন অনেকেই। সরকার তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে হেলিকপ্টার থেকে তাক করে গুলি করলে ছাদে ও বারান্দায় খেলতে থাকা কিছু শিশুও শহিদ হয়। এতে ছাত্রজনতা আরও বেশি খেপে গেল। পুরো দেশে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদের বন্যা বয়ে গেল। দুর্বৃত্তরা সমানে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালাতে লাগল। সরকার নামাল সেনাবাহিনী, বিডিআর, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে। শিক্ষার্থীদের পাশে নেমে এলো সাধারণ জনতা, রিকশাওয়ালা, এমনকি পোশাক শ্রমিকরাও। নির্মমভাবে কত মেধাবীর প্রাণ ঝরতে লাগল। শেখ হাসিনার মদদদাতা কিছু পুলিশ অফিসারের নির্দেশে প্ররোচিত হয়ে নিচের স্তরের কিছু পুলিশ সদস্য শিক্ষার্থীদের ওপর অকাতরে গুলি করেছে। ছাত্ররাও ছাড় দেওয়ার নয়। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীর উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। অবশেষে টিকতে না পেরে সরকারপ্রধান ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কত মানুষকে যে হারিয়েছি আমরা, প্রকৃত সংখ্যাটি অজানা। হারিয়েছি সাঈদ-মুগ্ধের মতো অনেক মেধাবীকে, যারা ভবিষ্যতে পৃথিবীতে বাংলাদেশকে একনামে তুলে ধরতে পারত। এছাড়া কত মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছে, কেউবা হয়েছে বধির, কেউবা বরণ করে নিয়েছে অন্ধত্ব।
আজ কত মানুষ স্বজন হারিয়ে প্রলাপ বকছে, কেউবা নিজেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে তা আর ভুলতে না পেরে মানসিক চাপে (Post traumatic stress disorder) ভুগছে। কেউবা স্বজন হারোনোর বেদনা নিতে না পেরে বিষণ্নতায় ভুগছে। কেউবা নিজের দৈহিক অঙ্গ হারানোর বেদনায় ভবিষ্যতের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন। অনেকের মাঝেই হঠাৎ এরূপ আঘাত আতঙ্কজনিত ভীতি সৃষ্টি করেছে। অনেকের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এরূপ অবস্থায় কেউবা আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।
একজন মনোবিজ্ঞানী হিসাবে আমি মানসিক চাপ মোকাবিলায় কী করণীয়, তা এখানে তুলে ধরছি।
কৌশল-১ : অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকুন। দেখা গেল কেউ হঠাৎ বর্তমান রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া শুরু করেছে, যা তার মাঝে মানসিক চাপ তৈরি করে। তার উচিত হবে ওই পরিবেশকে এড়িয়ে চলা। যদি তার জীবনে বিশেষ কেউ থাকে, যে তার মাঝে মানসিক চাপ তৈরি করে, তাকে এড়িয়ে চলা-নতুবা তার মানসিক চাপ আরও বেড়ে যাবে। যেমন, আপনি হয়তো কাউকে কিছুতে ‘না’ বলতে খুব লজ্জাবোধ করেন। কিন্তু আপনাকে মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে অবশ্যই না বলতে হবে।
কৌশল-২ : পরিস্থিতির বিকল্প চিন্তা করুন। সবসময় নিজের ভাবকে মনের মাঝে পুষে না রেখে একটা ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রকাশ করে ফেলুন। আপনাকে আরও বেশি compromising হতে হবে। সময়ানুবর্তিতার (time-management) দিকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। কেননা এটি না করলে মানসিক চাপ আরও বেড়ে যাবে।
কৌশল-৩ : পীড়কের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলুন। এখানে পীড়কের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিন। মানে নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে হবে। আপনি রাস্তায় অনেক যানজটে আটকে গেছেন। বিরক্তি লাগছে। আপনি সময় কাটানোর জন্য মোবাইল ফোনে গান শুনতে পারেন। অথবা ভাবতে পারেন আপনি একাকী সময় উপভোগ করছেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিন। আপনার মনোভাবকে খাপ খাইয়ে নিন।
কৌশল-৪ : যেটা কখনো বদলানো যাবে না, সেটাকে গ্রহণ করে নিন। কিছু ঘটনা যা চাইলেও বদলানো যায় না, যেমন কারও মৃত্যু বা কারও অসুখ-এগুলোকে মেনে নিতে হবে। আপনার মনের অনুভূতিগুলোকে অনেক আপন কোনো বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করুন। ক্ষমা করতে শিখুন।
কৌশল-৫ : রিলাক্সেশনের জন্য এবং কীভাবে হাসিখুশি থাকতে পারবেন, এজন্য সময় বের করুন। হাঁটুন, মেডিটেশন করুন, গান শুনুন, প্রকৃতিকে সময় দিন, বাগান করুন, কমেডি দেখুন, হাসুন, রিলাক্সেশন করুন, আনন্দ করুন, অনেক সময় ধরে গোসল করুন। প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কথা বলুন।
কৌশল-৬ : একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিন। প্রতিদিন ব্যায়াম করুন (৩০ মিনিট), সুষম খাবার খান। সিগারেট, অ্যালকোহল ও ড্রাগস থেকে দূরে থাকুন। চিনি কম খান। পরিমিত ঘুমান।
সবশেষে বলব, যারা মানসিক সমস্যায় আছেন, তারা চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। প্রয়োজনে টেলিকাউন্সেলিং নিতে পারেন।
ফৌজিয়া শারমীন হোসেন : মানসিক রোগের চিকিৎসক
