Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আমাদের কূটনীতি ও নাগরিক প্রত্যাশা

Icon

কমডোর শেখ আরিফ মাহমুদ (অব.)

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কূটনীতি হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যাকে অবলম্বন করে একটি দেশ অন্য একটি দেশ তথা একাধিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে, সে সম্পর্ক চিরস্থায়ী করে এবং ক্রমান্বয়ে উন্নতি করে। আর এ কাজগুলো সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য দুই বা ততধিক দেশের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা চালিয়ে যাওয়ার অন্যতম বাহন হচ্ছে কূটনীতি। এটি এমন একটি মাধ্যম, যা দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা দূর করে ক্রমান্বয়ে উন্নতি সাধনে সচেষ্ট হয়। ভবিষ্যতে দুদেশের মধ্যে কোনো মতদ্বৈধতা সৃষ্টি হলে তা নিরসন করা সহজ হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক বিস্তারের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। সেজন্য সব সার্বভৌম দেশ কিছু বৈদেশিক নীতিমালা প্রণয়ন করে, যা তাদের অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। শুরুতেই নেওয়া হয় সংবিধান রচনার কাজ। অতি স্বল্প সময়ে (অনধিক এক বছর) তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করেন। একটি নতুন জাতিসত্তার এটি এক অনন্য দলিল, যার মধ্যে বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত হবে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কী সম্পর্ক বজায় রাখবে, কীভাবে সম্পর্ক বজায় রাখবে, কীভাবে তার উন্নতি হবে-এসবের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এ সংবিধানে সন্নিবেশিত আছে। আমাদের কূটনীতির মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’। বিশ্বের যে কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মূলত এ মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। তবে এ মূলমন্ত্র আমাদের দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণবান্ধব কিনা তা বিবেচনার বিষয়। কারণ, কূটনীতির মূলমন্ত্র যাই হোক না কেন, আসল কথা হলো, নিজ নিজ দেশের ও দেশের মানুষের স্বার্থ সুসংহত করা। বস্তুত পৃথিবীর সব দেশ নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। এসব স্বার্থ কখনো রাজনৈতিক, কখনো অর্থনীতিক, কখনো ভৌগোলিক, আবার কখনোবা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে হতে পারে। সবকিছু যদি ঠিকঠাক মতো চলে, তখন বিদ্যমান সম্পর্ক কীভাবে আরও বৃদ্ধি করা যায়, শক্তিশালী করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া হয়। এভাবেই একটা দেশের সঙ্গে আরেকটা দেশ তার বা তাদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।

আর এসব কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য সব সার্বভৌম দেশ তার প্রয়োজন অনুযায়ী দেশে দেশে দূতাবাস স্থাপন করে, কূটনীতিক নিয়োগ করে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আনুমানিক ৭০টি দেশে দূতাবাস স্থাপন করেছে এবং আরও বেশকিছু দেশে দূতাবাস স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দূতাবাসগুলো কি আমাদের দেশ ও দেশের জনগণের হয়ে আশানুরূপ প্রকৃত অবদান রাখতে পারছে? বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের জনসংখ্যার চাপ অনেক, পাশাপাশি সম্পদের সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। দেশটির পক্ষে এককভাবে সব নাগরিকের জন্য জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা অদ্যাবধি সম্ভব হয়নি। তাই তো নাগরিকের একাংশকে জীবিকার তাগিদে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বর্তমানে আমাদের দেশ যে অবস্থায় আছে এবং যে পদ্ধতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তা কখনোই আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানেই দরকার উন্নত বিশ্বের সাহায্য-সহযোগিতা। আর ওইসব দেশের সঙ্গে আমরা যত বেশি যোগাযোগ রক্ষা করতে পারব, তাদের আস্থা অর্জন করতে পারব, তত বেশি মঙ্গল। এখানেই প্রয়োজন কূটনীতিকদের সুদীপ্ত পদচারণা। শুরু হয় দেশে দেশে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারি কাগজপত্র বিনিময় তথা সমঝোতা স্মারক, আর চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা। এসব চুক্তি ক্ষেত্রভেদে স্বল্পমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি ও আজীবনের জন্য হতে পারে। যে দেশ অন্য দেশকে যত বেশি আস্থায় নিতে পারবে, তার সম্পর্ক তত বেশি সুদৃঢ় হবে, এটাই বাস্তবতা।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, বিগত দিনগুলোতে কূটনীতিকরা কি আমাদের স্বার্থরক্ষার্থে সেভাবে অবদান রাখতে পেরেছেন বা বর্তমানে পারছেন? হচ্ছে কি সম্পাদিত চুক্তিগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন? উদাহরণস্বরূপ দুটি বিষয় সামনে আনতে চাই। একটি হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিষয়, অন্যটি আমাদের দেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টাকা পাচারসংক্রান্ত। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে আমাদের দেশের অসংখ্য লোক কর্মরত আছেন। তারা কী কাজ করছেন বা কীভাবে করছেন, সেটি দেখার দায়িত্ব আমাদের দূতাবাসের, সেখানে কর্মরত সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের। সেখানে লোকজন খারাপ অবস্থায় থাকলে বা খারাপ কিছু করলে সেটা আমাদের ভাবমূর্তি অনেকখানি ক্ষুণ্ন করবে, দেশগুলো আমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আস্থা হারাবে। পার্শ্ববর্তী বা অন্যান্য দেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

এখন দেখা যাক, আমাদের দেশের লোকজন কীভাবে বিদেশে যায় এবং কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়। আমাদের দেশের কর্মঠ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ নিতে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে। পরিবারের উপার্জনকারী কোনো এক সদস্য (বাবা/মা/ভাই/বোন) তার উপার্জনের বিরাট অংশ দিয়ে তার বা তাদের যোগ্য পোষ্যকে (ছেলে অথবা ভাই) বিদেশে পাঠিয়ে থাকেন, সংসারের আয় উন্নতির আশায়। অপ্রিয় সত্য হলো, অনেকে টাকা খরচ করেও বিদেশে যেতে পারেন না, আবার অনেকে বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হন। দেশি-বিদেশি দালালদের খপ্পরে পড়ে তার বা তাদের কোম্পানি পরিবর্তন হয়, কাজ পরিবর্তন হয়, বেতনের একটা অংশ দালালরা নিয়ে যায়, বছর বছর নিজ খরচে ভিসা বা কাজের পুনঃনিয়োগাদেশ নিতে হয়। এগুলো বৈষম্য, কেননা একই কাজে অন্য দেশ থেকে যারা যাচ্ছেন, তারা এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হন না, তাদের এত টাকাও খরচ করতে হয় না। কারণ, সেখানে তাদের দেশের কূটনীতিকরা দূতাবাস থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।

দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের একটি অশুভ চক্র বৈধ-অবৈধ উপায়ে অগাধ টাকা উপার্জন করেন। পরবর্তীকালে তারা সে অর্থের এক বিরাট অংশ অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করেন। সেখানে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন, বাড়ি-গাড়ি করে আয়েশি জীবনযাপন শুরু করেন। এতে করে দেশে আর্থিক সংকটসহ শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি হয়, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। যুগ যুগ ধরে এমন অবস্থা চলমান থাকায় আরও অনেকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এমন অশুভ চক্রে জড়িয়ে পড়েন। এসব ঘটনার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বহুলাংশে দায়ী হলেও বৈদেশিক নিয়মনীতির শৈথিল্যের কারণে চক্রটি বিদেশে এ ধরনের অবৈধ কাজে সক্রিয়। শুরু থেকে এগুলো রোধকল্পে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো নজর দিলে, একটা পদ্ধতি অবলম্বন করলে দেশ থেকে আনুমানিক ১০০ বিলিয়নের বেশি টাকা বিদেশে পাচার হতো না।

বিগত দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয়েছে, সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিছু গোপনীয় ও অতি গোপনীয় বিষয় বাদ দিলেও অধিকাংশ বিষয় সম্পর্কে আমাদের সর্বস্তরের জনসাধারণ তেমন কিছুই জানতে পারেনি বা তাদের জানানো হয়নি। কেননা চুক্তি সম্পাদনের আগে ও পরে এগুলো নিয়ে আমাদের সংসদে আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অতীতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব নিয়ম অনুসরণ করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সংবেদনশীল বা স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তাই বৈষম্য দূরীকরণের মাহেন্দ্রক্ষণে জনগণের সঙ্গে আলোচনা না করে সম্পাদিত সব চিঠিপত্র, সমঝোতা স্মারক, চুক্তি আপাতত স্থগিত রাখা দরকার। পরবর্তীকালে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই-বাছাইয়ে ওইগুলো আমাদের স্বার্থসংরক্ষণ করলে আবারও অনুসরণ করা যাবে। অন্যথায় ওইসব চুক্তি/সমঝোতা স্মারক/চিঠিপত্র পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বাতিল বা নবায়ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে গোপনীয় ও অতি গোপনীয় বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, দপ্তর, অধিদপ্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই জনসাধারণের চাওয়া।

এটি অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপনে আমাদের দূতাবাসগুলোর তথা কূটনীতিকদের ভূমিকা অপরিহার্য। ধরে নেই দূতাবাসগুলো তাদের কাজ সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মানুষের বৈধ অধিকার কি সংরক্ষণ হচ্ছে? প্রবাসী বাংলাদেশিরা সেখানে কি তাদের চুক্তি অনুযায়ী কাজ করতে পারছেন, কাজের পরিবেশ ও বেতন পাচ্ছেন? দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার কি রোধ হচ্ছে? বিদেশে আমাদের টাকা পাচারকারীরা কি চিহ্নিত হচ্ছে? পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা কি কূটনীতিকরা নিচ্ছেন? সর্বোপরি বিদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পাদিত সব চুক্তি কি দেশ ও দেশের মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করছে? এসব বিষয়ে দেশ ও দেশের সুবিশাল স্বার্থে কূটনীতিকদের শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ নাগরিকদের একান্ত প্রত্যাশা।

বর্তমানে বাংলাদেশ এক কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক আস্থা ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রচলিত কর্মপদ্ধতির বাইরে গিয়ে কূটনীতিকরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উদ্ভাবনী পদ্ধতি নিরূপণের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটাও জাতির প্রত্যাশা। আর তখনই রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক পরাকাষ্ঠা থেকে জাতিকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের কূটনীতি এক অনন্য মাত্রায় উপনীত হবে।

কমডোর শেখ আরিফ মাহমুদ, বিএন (অব.) : নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা

sheikharifmahmood@gmail.com

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম