Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও নতুন বাংলাদেশ

Icon

ড. মো. মনিরুজ্জামান

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও নতুন বাংলাদেশ

ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় ঘটনা বলে বিবেচিত। স্বাধীনতা-পূর্ব ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছাত্রদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯০ সালের আন্দোলনে ছাত্ররা এরশাদ সরকারের পতনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও ছাত্রদের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনটি ছিল মূলত স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা তৎকালীন সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক ভুলত্রুটি জনসম্মুখে তুলে ধরে। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই আন্দোলনে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুরুতে এ আন্দোলন অহিংস ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেপরোয়া হলে ১৫ জুলাই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। অতঃপর শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। সহিংসতার মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। যার শেষ পরিণতি ঘটে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মাধ্যমে। ৫ আগস্ট পতন ঘটে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী সরকার শেখ হাসিনার। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা এবং ৪৪ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। একথা ভুলে গেলে চলবে না, ছাত্রদের ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। সে সময় এ আন্দোলন আর কোটা সংস্কারের মধ্যে নিহিত ছিল না। এভাবে স্বৈরাচার সরকারের দীর্ঘদিনের চলমান দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, বিদেশে অর্থ পাচার, মানুষের কথা বলার অধিকার হরণ এবং সর্বোপরি মানুষের নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এসব বিষয়ে বৈষম্য লাঘব করাই ছিল ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত সরকার কর্তৃক নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর সরকার পর্যায়ক্রমে ২০১৪ সালে দশম, ২০১৮ সালে একাদশ ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জোরপূর্বক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এ শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রত্যেক নেতাকর্মীর বেফাঁস মন্তব্য, আমিত্ব, অহমিকা, দাম্ভিকতা, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল। ‘আয়নাঘর’ নামক গোপন বন্দিশালায় মানুষকে আটক করে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। ‘মায়ের ডাক’ নামক সংগঠনের ব্যানারে হারিয়ে যাওয়া ও গুম হওয়া স্বজনদের আর্তনাতে বাতাস ভারি হয়ে উঠত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল যে দাবি ছিল, তা সমাধান করা ছিল অত্যন্ত সহজ একটা ব্যাপার। কিন্তু সরকারের একগুঁয়েমির এবং দলের দায়িত্বশীল নেতাদের অতিরঞ্জিত কথার কারণে শেষ রক্ষা হলো না।

১৬ জুলাই বিশ্বের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এদিন আমাদের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে পুলিশ গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ পাশবিক ঘটনা দেশ-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যার ফলে সরকারের ক্ষমতায় থাকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনাই একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। সেই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐহিত্যবাহী দলকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে অগণিত নেতাকর্মীর মনোবল ভেঙে চুরমার করে দেন।

জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা বিতর্কিত সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন শান্তিতে নোবেলবিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ২১ উপদেষ্টা। একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এ সরকার গতানুগতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয়। দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সিংহভাগ মানুষের সমর্থনে এ সরকার গঠিত। তাই দল-মত নির্বিশেষে সবার উচিত এ সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করা, কারণ বর্তমান সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। শত শত ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশকে তাই আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে অভিহিত করছি। রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণই হচ্ছে ছাত্রদের মূল লক্ষ্য। ইতোমধ্যে কতিপয় রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে চাপ দিচ্ছে। সে লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বেশকিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। একটি বিষয়ে আমাদের পরিষ্কার ধারণা রাখা উচিত, তা হলো গত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রের এহেন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল না। এর আগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের শাসনামলও তেমন সুখকর ছিল না বললেই চলে। ভবিষ্যতে যে দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হবে, তাকে অতীতের সব গ্লানি মুছে দিয়ে ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত নতুন বাংলাদেশ উপহার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, বর্তমান সরকার তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য তা যেন কার্যকর হয়, সে বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করা যায়। আগামীতে যে দলই সরকার গঠন করবে, সেই দলের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চা অব্যাহত রেখে দলের খোলনলচে পালটাতে হবে। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার কষ্টার্জিত ফল বিফলে যাবে। শুধু তাই নয়, নতুন বাংলাদেশ গঠনে ব্যর্থ হলে ছাত্র-জনতা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ নতুন সরকারকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে এবং সেইসঙ্গে আত্মদানকারী শহিদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানির কারণে জাতি তাদের কখনো ক্ষমা করবে না। নতুন সরকারের কর্মকাণ্ডে যদি আগের সরকারের মতো নানা অপকর্মের ধারা দৃশ্যমান হয়, তাহলে একথা দ্বিধাহীনচিত্তে বলা যায়, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের প্রারম্ভিক সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী সরকারের যে পরিণাম হয়েছে, নয়া সরকারের ক্ষেত্রে তার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই আগামীতে যাদের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের এখন থেকেই সতর্ক পন্থা অবলম্বন করা উচিত, যাতে করে দেশে আর কখনো স্বৈরাচারী সরকারের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

ড. মো. মনিরুজ্জামান : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

mzamanbrur71@gmail.com

ছাত্র আন্দোলন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম