Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কাপুরুষোচিত জীবনে ক্লান্ত আমরা এখন সাহস দেখাতে চাই

Icon

মাহমুদুর রহমান মান্না

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাপুরুষোচিত জীবনে ক্লান্ত আমরা এখন সাহস দেখাতে চাই

মাহমুদুর রহমান মান্না

প্রায় এক যুগ আগের কথা হবে। দিনক্ষণ মনে নেই। আমি আমার বেড-কাম-স্টাডি রুমে চেয়ার টেবিলে বসে গান শুনছিলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। হেমন্ত আমার প্রিয় শিল্পী। অদ্ভুত দরদে ভরা ভারী গলা। কবিতা আবৃত্তি করলেও হেমন্তের কণ্ঠে তা গান হয়ে যায়। তার একটা বাংলা গান শুনছিলাম। আমার ঘরের লাইট নিভিয়ে একটা নীল বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। দরজাটা ভেজানো ছিল।

ডিমলাইট হলে তার কালার নীল হলেই ভালো। একটা রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি হয়। তার মধ্যে হেমন্তের দরদি গলার গান একটা অদ্ভুত, রঙিন আবেশে ভরিয়ে রেখেছিল ঘরটাকে। আমি তন্ময় হয়ে গান শুনছিলাম। এমন সময় ভেজানো দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। কেউ একজন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। আমি বুঝলাম আমার ছেলে নিলয়। ভাবলাম সে হয়তো কিছু বলবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। ও কিছু বলল না। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবে নিলয়? নিলয় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কি করছ আব্বু? আমি বললাম, কেন ব্যাটা গান শুনছি। আবারও একটু থেমে নিলয় বলল, এগুলোকে গান বলে? এসব গান শুনে শুনে বাঙালি জাতি দুর্বল হয়ে আছে। এসব শুনে শুনেই বাঙালি মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে আছে। এরকম করে নির্বাচনের নামে এত বড় জালিয়াতি করল, তবু আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারলাম না।

নিলয় সেই প্রথম নির্বাচনের কথা বলছিল যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দল ছাড়াই ভোটের আগে ১৫৪ আসন জিতে নিল। কিন্তু সে কথা থাক। আমার মন খারাপ হয়ে গেল ওর কথা শুনে। এত বড় শিল্পী হেমন্ত, তাকে সে রীতিমতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল! আমি তাকে বললাম, তুমি কি জানো আব্বু এ লোকটা কত বড় শিল্পী? নিলয় বলল, সেটা আমার জানার দরকার নেই। আমি শুধু দেখছি, এ গান শুনে তোমরা ঘুমিয়ে যাবে। জাগতে পারবে না।

আমার ওর কথা ভালো লাগেনি। কারণ আজও হেমন্ত আমার ভালো লাগে, মেহেদী হাসান ভালো লাগে; রবীন্দ্রসংগীত ভালো লাগে। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারলাম, আমার ছেলের কিংবা ওর বয়সের ছেলেদের এসব গান আর ভালো লাগে না। এদের বয়সের যারা, তারা তো রবীন্দ্রসংগীত শোনেই না। একটা সময় ছিল ভদ্রলোকের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা থাকতই। কিন্তু আজ যারা তরুণ, তাদের অনেকে রবীন্দ্রনাথ পড়েনইনি।

ভারতীয় সংগীত জগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর যখন ধীরে ধীরে বয়সের কারণে গান গাওয়া থেকে বিরত হচ্ছেন, তখন তার একটা টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। আলোচনা হচ্ছিল বুঝি তার সময়কার গান এবং বর্তমানকার (যখন সাক্ষাৎকারটা দেওয়া হচ্ছে তখনকার) নিয়ে। লতা মঙ্গেশকর রীতিমতো বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, এখন যা হচ্ছে, এগুলোকে কি গান বলা যায়? এগুলোর না আছে কোনো সুর, না আছে কোনো তাল-লয়। যার যেমন ইচ্ছা তেমন গেয়ে যাচ্ছে। অথচ এমন এক সময় ছিল, যখন গানের গলা ইত্যাদির সঙ্গে গ্রামারও ধরা হতো। এই যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে এত ভালো কথা বললাম, তিনি যখন রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন (আমার অবশ্য তার রবীন্দ্রসংগীত খুব ভালো লাগে), তখন তাকে রবীন্দ্রসংগীতের অথরিটি হিসাবে যাদের ধরা হতো, তারা তাকে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে মানা করেছিলেন, কারণ তিনি রবীন্দ্রসংগীতের গ্রামার মানেননি।

কিন্তু আজকে দেখেন, রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে মডার্ন মিউজিক বাজছে; আশা ভোঁসলেও রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন। লতা মঙ্গেশকর যতই অপছন্দ করুন, ভারতীয় সংগীত আর আগের গাঁথুনিতে নেই। শুধু ভারত বলব কেন, বিশ্বব্যাপী সংগীতের কাঠামো বদলেছে, তার প্রেজেন্টেশন বদলেছে। এবং শুধু সংগীতে নয়-কবিতায়, সাহিত্যে পর্যন্ত পরিবর্তনের বাতাস ঠেকানো যায়নি। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশকে কোনো কবি মনে করতেন না। জীবনানন্দের পাঠানো কবিতা রবীন্দ্রনাথ পড়েও দেখেননি। বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের পর তিনি আধুনিক কবিতাকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছেন। আপনাদের মনে থাকার কথা, আজকে যে আধুনিক কবিতা আমরা দেখি, সেটাও তো আগের কাঠামো ভেঙেচুরে একেবারে নতুন একটা কাঠামোতে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিকে অনেকেই ভয়ানক অপছন্দ করেছেন আধুনিক কবিতাকে। কিন্তু পুরোনো কবিতাকে দূরে ফেলে দিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে আধুনিক।

এবার রাজনীতির কথায় আসি। বাংলাদেশের রাজনীতি অবশ্য অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে পুরোনো বৃত্ত বা মাত্রার মধ্যেই ঘুরেছে। এরমধ্যে ক্ষমতার বদল হয়েছে কয়েকবার। একই দল কয়েকবার করে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু যাহা ৫২ তাহাই ৫৩। থোড় বড়ি খাড়া; খাড়া বড়ি থোড়। এ সময়ের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে যে উদগ্র লালসা এবং লড়াই, লুটপাট, মানুষের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা-অবিচার, মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র, তা মানুষকে হতাশ করেছে। নির্বাচনি প্রহসন, জালভোট, দিনের ভোট রাতে করা, প্রশাসনকে সরাসরি ব্যবহার করে মানুষকে ভোটদানে বাধা দেওয়ার ঘটনায় মানুষ ভেতরে ভেতরে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। সেই বিক্ষোভ মানুষের মনের ভেতরে তুষের আগুনের মতো ধিক ধিক করে জ্বলেছে। শাসক গোষ্ঠী তা দেখতে পায়নি। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাসীনদের এসব অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, লড়েছে, জেল খেটেছে, জীবন দিয়েছে। কিন্তু শেষ যে লড়াই, রুখে দেওয়ার লড়াই; সেটা করতে পারেনি। শেষে এসে সেটাই করল শিক্ষার্থীরা। কী অকাতরে জীবন দিল তারা!

কী করে পারল! ৪ আগস্টেও অনেকে আমাকে ফোন করেছেন, ভাই কিছু কি হবে? এরা কি পারবে? আমি নিজেও খুব নিশ্চিন্ত ছিলাম না। কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম, যখন দেখলাম তারা ৬ তারিখে যে ‘ঢাকা সিজ’ দিয়েছিল, হঠাৎ করেই তা ৪ তারিখ বিকালের এক ঘোষণায় একদিন আগে নিয়ে এলো। এবং সেদিনই সরকারের পতন হলো। বিশ্ব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম স্বৈরাচার পালিয়ে গেল। বিস্ময়কর নয়? এ যেন রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের মতো। লেনিন বলেছিলেন, ৮ নভেম্বর দেরি হয়ে যাবে, ৬ তারিখে আবার বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। ক্ষমতা নিতে হবে ৭ নভেম্বরেই।

এই যে বিস্ময়কর, অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা ঘটে গেল, তা আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে সাহিত্য-সংগীতের মতো রাজনীতি, রাজনীতির ভাষাও বদলে গেছে। ৫২ থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলনের ঐতিহ্য নিয়ে আমরা গর্ব করি, তার কোনো ঐতিহ্য অনুসরণ করে এ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এর মধ্যে কোনো হিংসাশ্রয়ী ছিল না। কেউ বিশাল জনসভা করে বলেনি, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব...। কোনো হরতাল, অবরোধ, অসহযোগের ডাক দেওয়া হয়নি। কিন্তু মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছেন। শাটডাউন করেছেন। একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল মেধার জয়গান গেয়ে, শেষ হয়েছিল নৃশংস এক স্বৈরাচারীর পতনে। এ শক্তি তারা পেল কোথায়?

অনেকে এ আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজতে চেয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, এরকমটি আমিও চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেরকম কিছু পাইনি। আমাদের ঐতিহ্যের ধারণা তো এরকমই যে, আন্দোলনের জন্য সংগঠন লাগবে, নেতৃত্ব লাগবে। এরকম কিছু তো ছিল না এখানে। প্রধানত স্বতঃস্ফূর্তই ছিল এ আন্দোলন। স্বতঃস্ফূর্ততাই যদি এটার প্রধান উপাদান না হতো, তাহলে এভাবে জীবন দিতে পারত না তারা। হতে পারে যারা আন্দোলনে ছিল বা এমনকি নেতৃত্বে ছিল, তাদের কেউ কেউ কোনো কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা আছেন। কিন্তু সেটা এ আন্দোলনের চরিত্র নির্ধারণ করেনি।

জুলাই অভ্যুত্থানকে অনেকে আফ্রিকার আন্দোলনগুলোর সঙ্গে তুলনা করেন। প্রথম আলোতে আলতাফ পারভেজ জেন জি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উগান্ডার প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। উগান্ডার সিনিয়ার সিটিজেনদের অধিকাংশ বিশ্বাসই করতেন না যে, তাদের ৮০ বছর বয়সি স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টকে জীবিত অবস্থায় পদচ্যুত করা যাবে। কিন্তু জেন জি লেগে থাকতে চেয়েছে। মুসেভেনি বলেছেন, আন্দোলনকারীরা আগুন দিয়ে খেলছে। জেন জির জবাব, কাপুরুষোচিত জীবনে ক্লান্ত আমরা এখন সাহস দেখাতে চাই।

জেন জি (জেড) প্রসঙ্গে দুটি কথা বোধহয় এখানে বলা উচিত, না হলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সময় এবং পরিসরের অভাবে এখানে বিস্তারিত বলা যাবে না। লেখার শুরুতে বলেছিলাম, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কীভাবে রুচি-কৃষ্টি-দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। পশ্চিমের দেশে এসব নিয়ে গবেষণা হয়। তারা একেকটা জেনারেশনের একেকটা নাম দেয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের এই পার্থক্যগুলো বিশ্লেষণ করে, এতে যে কী সামাজিক প্রভাব পড়ে বা পড়তে পারে, তাও বলে দেয়। দশক ধরে ধরে জেনারেশনগুলোর নাম দেওয়া হয় এবং তাদের পার্থক্য দেখিয়ে দেওয়া হয় যেমন জেন এক্স, জেন ওয়াই ইত্যাদি।

আমাদের দেশে তো বলা যায়, গবেষণার বালাই-ই নাই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া হয় না। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, মাস্তানি, তোষামোদির চর্চা। মেধা বা জ্ঞান চর্চার তো কোনো দরকার নেই। সবকিছুর জন্য তো তিনিই আছেন। সেই যে কবিতায় আছে :

তুমি মা কল্পতরু, আমরা সব পোষা গরু।

শিখিনি শিং বাঁকানো

কেবল খাব খোল, বিচিলি ঘাস॥

আমরা ভুসি পেলেই খুশি হব

ঘুসি খেলে বাঁচব না।

মাহমুদুর রহমান মান্না : নাগরিক ঐক্যের সভাপতি, ডাকসুর সাবেক ভিপি

মান্না রাজনীতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম