রাষ্ট্র সংস্কারের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হোক
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ড. মুহাম্মদ ইউনূস
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স মাত্র এক মাস পেরিয়েছে। লক্ষ্য পূরণে একনিষ্ঠ ও অবিচল থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় উচ্চারিত হচ্ছে জোরালোভাবে। এ ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র মেরামতের উদ্যোগ আশাব্যঞ্জক। এ উদ্যোগের পরিপূর্ণ সুফল লাভের আকাঙ্ক্ষায় দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সব সংস্কার কর্মকাণ্ডের যৌক্তিক সম্পাদন আবশ্যক। সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সব ক্ষেত্রে লুটেরাদের করায়ত্ত থেকে দেশকে মুক্ত করে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনই প্রত্যাশিত। জনগণের সামগ্রিক দুর্ভোগ লাঘব কঠিন চ্যালেঞ্জ হলেও প্রয়োজনীয় সংস্কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করি। বিভিন্ন সিন্ডিকেট ও বাজার কারসাজি বন্ধ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হ্রাস করা গেলে তা হবে জনগণের জন্য স্বস্তিদায়ক। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্য রক্ষা এবং জনগণের আয়-ব্যয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
বিগত সরকারের আমলে সর্বক্ষেত্রে ঘুস-দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন সামগ্রিক ব্যবস্থাকে করেছিল পর্যুদস্ত। পবিত্র সংবিধানে প্রতিটি বিষয়ে আইনের ভিত্তি রচিত হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে চরম বিচ্যুতি লক্ষ করা গেছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বহু আইন, বিধিবিধান, পরিকল্পনা-কৌশল প্রণয়ন করা হলেও সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আইনের শাসনের অপপ্রয়োগের কুফল প্রতিফলিত হয়েছিল বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যে, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনায় এবং দুর্নীতিতে। অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু মনোভাবের কারণে দেশের সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়েছিল অকার্যকর। আর্থিক খাতে দুর্বৃত্তায়নে জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি দেশজুড়ে সংক্রমিত ছিল।
ইতোমধ্যে বিগত সরকার সৃষ্ট ব্যাংক লুটপাটের চিত্র জনগণের সামনে উন্মোচন হয়েছে। ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ ও খেলাপি হওয়া, বিদেশে অর্থ পাচারে দেশের আর্থিক খাত হয়েছে প্রায় বিপর্যস্ত। তাই অপরাধীদের কঠোর আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান একান্তই কাম্য। সব আইনগত পন্থা অবলম্বন করে পাচারকৃত অর্থ ফেরতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তাকে কার্যকর করা বাঞ্ছনীয়। দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারের লক্ষ্যে ছয় সদস্যবিশিষ্ট টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ টাস্কফোর্স প্রধানত আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ এবং প্রধান প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ, দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, প্রভিশন ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদের পৃথকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
এছাড়া টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সংকটকালীন প্রতিঘাত সক্ষমতা অর্জনে ব্যাংকের সুশাসন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ার আওতায় রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক উন্নয়ন, ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক ও করপোরেট প্রভাব সীমিতকরণ, ব্যাংকের মালিকানা সংস্কার ইত্যাদি সংক্রান্ত প্রস্তাবনা প্রদান, রেজুলেশন ফ্রেমওয়ার্ক ও সংশ্লিষ্ট গাইডলাইন প্রস্তুতকরণ, দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নীতিগত ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ঘোষিত টাস্কফোর্স আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন যেমন-ব্যাংক কোম্পানি আইন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ইত্যাদি সংস্কার এবং অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, ব্যাংক অধিগ্রহণ, একীভূতকরণ আইন প্রণয়ন-সংস্কার-যুগোপযোগী করার প্রস্তাব করবে। একইসঙ্গে ব্যাংক খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ টাস্কফোর্সের সার্বিক কার্যাবলি সমন্বয় করবেন। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাবমূর্তি এক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখবে বলে জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত সব পদক্ষেপ দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সরকার পরিচালনার শুরুতে বিচার বিভাগের সংস্কারের বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বিচার বিভাগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ সুসম্পন্ন হওয়ায় ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে জনগণের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ দেশে বিদ্যমান সব কালো আইনের তালিকা প্রণয়ন করে দ্রুত এসব আইন বাতিল বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনের আশ্বাস প্রদান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক হবে। পাশাপাশি নিশ্চিত করা হয়েছে সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘের গুম ও নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ, যা জাতিসংঘসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বিপুল প্রশংসিত হয়েছে। এতে গুম-খুনের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃঢ় অবস্থান সুস্পষ্ট হয়েছে। তাছাড়া বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সংঘটিত গুমের ঘটনা তদন্তে এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে পাঁচ সদস্যের কমিশনও গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
১১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা যেহেতু জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাস করি, সেহেতু নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়ন আমাদের সংস্কার ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা মনে করি, নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব আকাঙ্ক্ষা রোধ করার জন্য নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা আমরা ভাবছি। নির্বাচনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এ চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানাভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সংস্কার চাই। তবে অনুরোধ, আমাদের ওপর সংস্কারের গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন, দায়িত্ব দিয়ে আপনারা দর্শকের গ্যালারিতে চলে যাবেন না। আমাদের সঙ্গে থাকুন। গত মাসে আমি বেশকিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। তারা সংস্কারে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। মতবিনিময় করেছি বিশিষ্ট সম্পাদকদের সঙ্গে। তারাও সংস্কার চেয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি। এসব বিষয়ে সংস্কার করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে আমরা প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এ কমিশনগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব দিয়েছি। এর পর আরও বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রাখব।’
কমিশনপ্রধানরা ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করে ৩ মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ সভার আয়োজন করবে। এতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত এবং তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার একটি ধারণা দেওয়া হবে। কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শ সভায় উপস্থিত থাকবেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।
দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানো সময়ের জোরালো দাবি। দল-মত নির্বিশেষে সব ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণিপেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বৈষম্য-বিরোধ-বিচ্ছেদের অবসান জরুরি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের সব পর্যায়ে শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য নির্মূল। জনগণের সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্রতই হোক সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রধান উদ্যোগ।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম, বিশ্ববিদ্যালয়
