জাতিসংঘে ড. মুহাম্মদ ইউনূস
সালেহ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবার বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসাবে জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূস অত্যন্ত পরিচিত মুখ। তার সবচেয়ে বড় সুবিধা, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাকে নতুন করে পরিচিত হতে হবে না এবং নতুন সরকারের বৈধতা নিয়ে কারও কাছে দেনদরবারও করতে হবে না।
প্রথমে আমরা দেখে নিই, গত বছর শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেন, তার সঙ্গে এবারের কী পার্থক্য। হাসিনার বিদেশ সফর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, সবসময় ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। কমপক্ষে ১৫০ জনের বিরাট লটবহর নিয়ে বিদেশ সফর করতে তিনি পছন্দ করতেন। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও থাকতেন তার সমর্থকরা, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক-সবাই সরকারি খরচে।
কখনো তাদের নাম-ধাম প্রকাশ করা হতো, আবার কখনো বা গোপন রাখা হতো। হাসিনার সঙ্গে গত বছর আরও আসেন তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তখন পুতুল ছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদপ্রার্থী। পুতুলকে মায়ের আঁচল ধরে জাতিসংঘের আঙিনায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। হাসিনা জাতিসংঘ সম্মেলনকে বেছে নেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুতুলকে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য।
শেখ হাসিনা পনেরো বছর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের উঁচুস্তরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নেতাদের সঙ্গে খুব সোহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেননি। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের কোনো বৈঠক করতে তাকে দেখা যায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দিতে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে। সেখানে বাইডেন সবার সঙ্গে ‘হ্যায় হ্যালো’ বলেন এবং পুতুলের ক্যামেরায় একটা সেলফি তুলে দেন। সেটাকে বাংলাদেশে ফলাও করে প্রচার করা হয় ‘একান্ত বৈঠক’ বলে। পুতুলও বলেন, তার সঙ্গে বাইডেনের বিশ্বের বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা নিয়ে কথা হয়েছে।
২০২৩ সালে হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরের দুটি নিজ উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমটি ছিল, পুতুলের নির্বাচনের জন্য সমর্থন আদায় করা এবং দ্বিতীয়টি ছিল, যুক্তরাষ্ট্রে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথিত তদন্ত নিয়ে যে সমস্যা হচ্ছে, তার একটা সুরাহা করা।
ভারতীয় এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সুপারিশে বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, সুলিভান জয়ের তদন্তের ব্যাপারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে তার অপারগতার কথা জানান। হাসিনার এর আগের সফরগুলোতে জয়কে সবসময় দেখা যেত মুখ্য ভূমিকায়। ২০২৩ সালে জয়কে মায়ের পাশে একবারও দেখা যায়নি।
২০২৪ সালের জাতিসংঘ অধিবেশনে ইউনূস যাচ্ছেন একটি ছোট্ট ডেলিগেশন নিয়ে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এক বছরের মধ্যেই কী পরিবর্তন! প্রেসিডেন্ট বাইডেনই ড. ইউনূসের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। বাইডেনের সঙ্গে যে ইউনূসের বৈঠক হবে, তা নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসের মিশন মূলত চারটি-১. বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বিপ্লবকে তুলে ধরা এবং নতুন সরকারের সংস্কার কাজগুলোর প্রতি সমর্থন আদায় করা, ২. যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখা, ৩. ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা এবং ৪. বাংলাদেশের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা চাওয়া।
এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা এবং শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ষে টানাপোড়েন চলছে, তার সমাধান করা সবচেয়ে কঠিন ও জরুরি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করার প্রস্তাব এড়িয়ে গেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক ছেড়ে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্ক পৌঁছানোর আগেই। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নিয়ে মোদি খুব নিশ্চিত নন।
হাসিনার দিল্লি অবস্থানও একটা নাজুক বিষয়, এটি নিয়ে মোদি সরাসরি ইউনূসের সঙ্গে এসময় কথা বলতে চান না। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ভারতের বিদেশমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের মধ্যকার বাংলাদেশ-ভারত বৈঠক হবে এটি নিশ্চিত। এ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের মাঝে কথা হবে। ইলিশ কূটনীতিও এখন সামনে এসেছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করতে ভারতীয় অনুরোধ প্রায় এক মাস ধরে অগ্রাহ্য করার পর ২১ সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আশা, আলোচনা হবে।
ড. ইউনূস নিউইয়র্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের এমন কোনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নেই, যা নিয়ে আলোচনা করে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে।
শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে গেলেই বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো বিমানবন্দর ও জাতিসংঘের সামনে বেশ বড় ধরনের বিক্ষোভের আয়োজন করত। ড. ইউনূসের সফরে আওয়ামী লীগ কোনো বিক্ষোভ করবে কিনা, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা এখন ভীষণ হতাশাগ্রস্ত; আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী বিশেষ একটি গ্রুপ আছে। তারা কি চুপ করে থাকবেন? সময় স্বপ্লতার জন্য ড. ইউনূসের জন্য নিউইয়র্কে কোনো নাগরিক সংবর্ধনা হচ্ছে না। প্রবাসীরা এবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় থেকে বঞ্চিত হবেন।
সালেহ উদ্দিন আহমদ : ডাকসুর সাবেক সম্পাদক (’৭০-৭২ সাল), সাংবাদিক ও শিক্ষক
