ড. ইউনূসের বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী ভাষণ
গাজী মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসাবে গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিলেন। তার ভাষণ, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি দেশের সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। একটি অনির্বাচিত সরকারপ্রধান হলেও তিনি পাদপ্রদীপের কাছেই ছিলেন। এটা দেশবাসীর জন্য গৌরবের বিষয়।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আগে থেকেই একটি পরিচিত নাম। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো দেশের সরকারপ্রধানকে উচ্চ ডিগ্রিধারী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর উচ্চশিক্ষা বা নোবেল হস্তগত থাকলেই জাতিসংঘের ফোরামে কোনো সরকারপ্রধানকে অন্যরা বাড়তি কদর দেবেন, তা আশা করা যায় না। একেক দেশের সরকারপ্রধান একেক বিষয়ে আপন মহিমায় উজ্জ্বল। তাই সম্মান আদায় করে নিতে হলে উচ্চশিক্ষা, ডিগ্রি বা পুরস্কারের পাশে আরও অনেক অনুষঙ্গ বা যোগ্যতা থাকার দরকার হয়।
অনেক উন্নয়নশীল দেশেই ভঙ্গুর ও অপরিণত গণতন্ত্রের কারণে জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য মার্জিত রুচির ও ভদ্রতা জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তি মুখ্য নেতৃত্বে আসতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। কাজেই কোনো বৈশ্বিক সম্মেলনে একজন গুণী ব্যক্তি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ এমন দেশগুলোর কাতারে বসেন, তখন তার সহকর্মী সভাষদগণ অনেকটাই আপ্লুত হন। বিশেষ করে যখন তারা দেখেন, বিশ্বের বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান বা আগের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা তাকে বন্ধুর মতো জড়িয়ে ধরছেন, নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় বা সংগঠন তাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন আন্তর্জাতিক পরিসরে আগত অতিথিরা তার কথা আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে শুনবেন, এটাই স্বাভাবিক।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য উপস্থাপন বরাবরই অসাধারণ। লাগসই শব্দ সংযোজন করে যে কথাটা সহজভাবে বলা দরকার, সেটাই তিনি সাবলীলভাবে তুলে ধরেন। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে ভাষণ দিয়েছেন, সেটাও তার স্বভাবসুলভ চিরপরিচিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই তার অনর্গল কথা বলতে পারার পারঙ্গমতার সঙ্গে বাস্তবতা, যুক্তি এবং লক্ষ্য নির্ধারণে সিদ্ধহস্ততার সমন্বয় তার ভাষণকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
দেশের নেতৃত্বের পরিবর্তনের যে অবশ্যম্ভাবী কারণে তাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিতে হয়েছে, তা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে তরুণ সমাজকে সামনে এনেছেন তিনি। তিনি তার বক্তব্যে সমাজ গঠনে তরুণদের ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে সুশাসনের জন্য বিপ্লবের ফসলকে মহিমান্বিত করেছেন। তিনি আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, বৈশ্বিক উষ্ণতা, কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা, অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে কথা বলেছেন, যা সব দেশের জন্যই সাধারণ সমস্যা। বাংলাদেশের একটি প্রধান সমস্যা রোহিঙ্গা সংকটকে তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সমস্যা হিসাবে উপস্থাপন করে তার প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি জানেন, বিশ্ববাসীর সহায়তা ছাড়া আঞ্চলিকভাবে এ সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ অপারগ।
সবকিছুর পরও অনেকের কাছে মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল যে, তিনি গাজা সমস্যা সম্পর্কে কথা বললেও জোরালোভাবে নাও বলতে পারেন। কারণ ইসরাইল প্রসঙ্গে আমেরিকার বর্তমান প্রশাসনের অবস্থান মুসলিম দেশগুলো থেকে আলাদা। ওদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রকমের উষ্ণ না থাকায় বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার সহায়তা দরকার। এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস কী বলেন, তা একটি জিজ্ঞাসার বিষয় ছিল। তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেক কথা বলেছেন। তিনি জানেন, এগুলো এদেশের মানুষের মনের কথা। হাজার কথা বলার পরও একথা না বললে বাংলাদেশের মানুষের কথা বলা হবে না। তাই স্পষ্টভাবে তিনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলেছেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, প্রথাগত রাজনীতির বৃত্ত থেকে দীর্ঘকাল ধরে দেশে এমন যোগ্য মানুষ বেরিয়ে আসতে পারছে না। পারিবারিক সূত্র, সামরিক ক্ষমতা বা আন্দোলনে দেখানো সাহস এখন নেতৃত্বের জন্য প্রধান নিয়ামক হয়েছে। এখানে সুদুরপ্রসারী চিন্তার জগত ঋদ্ধ না হলেও নেতা হওয়া যায়। এমন অবস্থায় এক অপ্রত্যাশিত আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় ড. ইউনূসের অধিষ্ঠান এক অনন্য ঘটনা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক ফোরামে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মানে বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য এক বিরল সম্মান। এটা যে কোনো দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানে ভবিষ্যতে সহায়ক হবে।
আমরা জানি, একেক দেশের সমস্যা একেক রকম। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় কোথাও শিক্ষার অভাবে জনগণের অসচেতনতা, কোথাও অর্থিক দুর্নীতি, কোথাও ভোট দুর্নীতি, কোথাও সম্পদ সমবণ্টনের অভাব সামাজিক পশ্চাৎপদতার কারণ। বাংলাদেশে এগুলোর একটি মিশ্রণ রয়েছে। কিন্তু সবকিছুর মূলে রয়েছে সুশাসনের অভাব। ড. ইউনূস বাংলাদেশে সুশাসনের জন্য সংস্কারের নানা পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য তার দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। দেশবাসী তার এ অবস্থানকে সবচেয়ে বেশি স্বাগত জানায়। দেশবাসী জানে, অনির্বাচিত সরকার থেকে নির্বাচিত সরকারে উত্তরণ না হলে সংস্কারটি একটি ফলহীন বৃক্ষ হিসাবে পরিগণিত হবে, যা কারও কাম্য নয়।
গাজী মিজানুর রহমান : সাবেক যুগ্মসচিব ও লেখক
