Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

কৃষিজমি কি একসময় বিরান পড়ে থাকবে?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মতিঝিল এজিবি কলোনি বাজারে নেত্রকোনার একজন মহিলা দোকানিকে দেখলাম ‘ভাগা’ দিয়ে কাঁচামরিচ বিক্রি করতে। পাঁচটি কাঁচামরিচ ৫ টাকা। আমি মেপেই ২৫০ গ্রাম কাঁচামরিচ কিনলাম, দাম ১০০ টাকা। কেজি মাত্র ৪০০ টাকা! কৌতূহলবশত বাড়িতে এনে গুনে দেখি আসলেই ছোট-বড় প্রতিটি মরিচের দাম পড়েছে এক টাকা। ডিমের হালি ৬০ টাকা। একটার দাম ১৫ টাকা। পেঁয়াজ, গোল আলুর দামের অবস্থা কী? হিসাব করে লাভ নেই। তবে দেখা যাচ্ছে, সাবেক সরকারের কর্মকর্তাদের মতো এখনো একই যুক্তি দেওয়া হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধির জন্য। এসব বলে আর লাভ নেই। কারণ সমস্যা এখন দেখা দিয়েছে বড় একটি। এখন আশ্বিন মাস। অক্টোবরের ১৭ তারিখ হবে কার্তিক মাস। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে যথারীতি। টানা চার দিন ছুটি।

এমনিতে আগের দিনে আশ্বিন-কার্তিক এলে মানুষ ভয়ে থাকত। তখন ছিল ‘মঙ্গার’ মাস। ভাত মেঙ্গেও পাওয়া যেত না। বড় অভাব ছিল। এখন তা আর নেই। কিন্তু তবু দুশ্চিন্তা আছে। মাসখানেক আগেই হয়ে গেল বড় একটি বন্যা, যা কুমিল্লা ও নোয়াখালীর অনেক ক্ষতি করেছে। টানা বৃষ্টি এবং উজানের পানি-এ দুইয়ে মিলে ক্ষতি হয়েছে মানুষের। ফসল গেছে, মাছ গেছে, গবাদিপশু গেছে। ধ্বংস হয়েছে বাড়িঘর। প্রাণ হারিয়েছে মানুষও। ঢাকাবাসী ত্রাণ নিয়ে গেছে দৌড়ে। সব হয়েছে, কিন্তু যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে লাগবে অনেকদিন। গরিব মানুষের পক্ষে তা পোষানো অসম্ভব। গরিব এভাবেই মরে। কোনোমতে সে বেঁচে থাকে। বছরে, দুই বছরের একটি বাড়ি খায়, আর দাঁড়াতে পারে না। ঋণী হয়। বন্ধকি বন্দোবস্ত নষ্ট হয়। হয় গৃহহীন। হারায় গবাদিপশু। এই তো গেল গত মাসে নোয়াখালীর করুণ অবস্থা।

নোয়াখালীর বন্যার ধকল শেষ হতে না হতেই এবার বান এসেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহে। খবরের কাগজের শিরোনাম : ‘বৃষ্টির পানি বেড়েছে ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায়’। আরেক কাগজ লিখেছে, ‘দুই জেলায় বন্যার অবনতি, আরও তিনজনের মৃত্যু’। দুটি কাগজের রিপোর্ট দেখলাম। মনে হলো, এতে পুরো চিত্র ধরা পড়েনি। যতটুকু হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ধোবাউড়া উপজেলায় ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির ফসল জলের তলে তলিয়ে গেছে। হালুয়াঘাটে তলিয়ে গেছে ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির ফসল। ফুলপুর উপজেলায় ৩ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমির ধান পানির নিচে গেছে। এদিকে শেরপুরে প্রায় পৌনে ২ লাখ কৃষকের প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। শুধু আমন ফসল নয়, গবাদিপশু গেছে। ঘেরের মাছ নষ্ট হয়েছে। ঘরবাড়ি গেছে। মানুষের বাড়িঘর জলের তলে। আমার বাসার যে মেয়েটি আমাকে খালু বলে ডাকে, তার কান্নাভরা আর্তনাদ কে দেখে! কঠোর পরিশ্রম করে টাকা জমিয়ে কিছু জমি রেখেছিল নেত্রকোনায়। বন্ধকি জমি। বড় ভাই ওই জমিতে চাষ করত। বছরে যা ধান পেত, তা বিক্রি করে চাল কিনত ঢাকায়। সংসার চলে যেত। চালের জন্য আর ‘ক্যাশ’ খরচ করতে হতো না। এখন ও হতাশ। কপালের দোষ দিচ্ছে, উপরওয়ালাকে ডাকছে। ঋণী হয়েছে সে। এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঘর পানির নিচে। বন্যার পর ঘর মেরামত করতে হবে। এমন অবস্থা হাজার হাজার গ্রামবাসীর। কে কার খবর রাখে! শহরের লোকের কাছে এসব কোনো খবর নয়। তাদের কাছে খবর হচ্ছে ‘সংস্কারে’র খবর। চুরি, চামারি, অর্থ পাচার, ঘুস, চাকরিচ্যুতি, মামলা ইত্যাদি তাদের কাছে খবর। আর খবর কাঁচামরিচের মূল্যের। দেশের হাজার হাজার গ্রামে যে দৈব-দুর্বিপাকে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, তার খবর কে রাখে! দারিদ্র্যসীমার উপরে ওঠার খবর আছে। কিন্তু এক দুর্যোগেই যে সে আবার পড়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যসীমার নিচে, তার হিসাব কে রাখে! এখানেই আমাদের সমস্যা।

আমরা বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক, শিল্পপতি, পোশাকশিল্প মালিক, রপ্তানিকারক ইত্যাদি শ্রেণি নিয়ে যত ব্যস্ত, তার এক ছটাকও ব্যস্ত নই দেশের প্রান্তিক লোকদের জন্য। তারা ঠকছে সর্বত্র, সব দিকে। শহরবাসীর জন্য সরকার যত খরচ করে, তাদের আরাম-আয়েশের জন্য সরকার যত সময় ও অর্থ ব্যয় করে, তার এক ছটাকও করে না গ্রামের গরিবের জন্য। গ্রামে রাস্তা আছে, রাস্তায় চলাচল করা যায় না। মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা আছে, নর্দমা আছে, কিন্তু তার অবস্থা কহতব্য নয়। দুর্দিনে সে সাহায্য পায় না। ব্যাংকঋণ চাইলে সে ঋণ পায় না। ঋণের ৫০০০ টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তার কোমড়ে দড়ি বেঁধে থানায় নেওয়া হয়। কৃষক পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদন করলে তার দাম পায় না। লুট করে নিয়ে যায় ফড়িয়ারা। উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। একমাত্র কৃষক যারা তাদের দায়িত্ব শতভাগ পালন করে এবং শতভাগ শাস্তি পায়। কে দেখে তা?

বলছিলাম গ্রামের মানুষের কথা, গরিবের কথা, নিুবিত্তের কথা, মধ্যবিত্তের কথা। অর্থাৎ ছোটদের কথা, ছোট ছোট কথা। আশার কথা, সরকার ছোটদের একটা কথা শুনেছে। কী সে কথা? সরকার ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। ডিম আকারে ছোট কিন্তু কাজে বড়। প্রোটিন জোগায়। কিন্তু দাম বেড়েছে মারাত্মক। এতে ক্ষতি কী? ক্ষতি আছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ মাংস ছেড়েছে অনেক আগেই। ১২০০-১৩০০ টাকা কেজি খাসির মাংস কজন খেতে পারে? গরুর মাংস? তাও জোটে না। এক রিকশাওয়ালাকে কয়েকদিন আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, গরুর মাংস কবে সে খেয়েছে গত কয়েক মাসের মধ্যে। অবলীলায় সে বলল, পবিত্র ঈদের সময় সে তা খেয়েছে। এরপর আর নয়। তাহলে কি নিুবিত্ত, মধ্যবিত্ত, গরিবরা মাছ খাচ্ছে? এর উত্তর কী দেব? কোনো মাছই তো ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০০ টাকা কেজির নিচে নেই। ইলিশ? ইলিশ থাকবে ‘শো কেসে’। এটা খাওয়ার জন্য নয়। তাহলে মানুষ বেশি বেশি সবজি খাবে? তা-ই খাওয়া উচিত। কিন্তু যারা বাজারে যান, তারা জানেন সবজির বাজারের কী অবস্থা। এসব এখন প্রতিদিনের টেবিল টক। আর সরকারের উত্তরও একই। যখন যে সরকার আসে, তখন সেই সরকার পুরোনো যুক্তিই দেয়। সবকিছু নাগালের বাইরে যাওয়ার পর মানুষ ধরেছিল ডিম। অন্তত এক হালি ডিম দিয়ে ভাগ করে একদিন চলবে চারজনের সংসার। ডিমের ঝোল। প্রতিদিন একটা ডিম খাওয়ার কথা বলছি না। বাধ্য হয়ে ডিম ধরে এখন সবার হাত পুড়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী? একটা ডিমের দাম ১৫ টাকা হবে কেন? এ প্রশ্ন করলেই ডিমের ফার্মওয়ালারা তাদের ফর্দ নিয়ে আসবেন। বলবেন, ডিম তারা কম দামে বিক্রি করছেন। আবার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার যদি ডিম আমদানি করে, তাহলে বলবেন, দেশীয় খামার নষ্ট করার জন্য সরকার ডিম আমদানি করছে। সরকারের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ীরা যা বলবে, তাই করতে হবে। নইলে চলবে না। যেমন, এ মুহূর্তে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানি করা হবে। এর জন্য সাতটি কোম্পানিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন’ সাময়িকভাবে ডিম আমদানির ওপর থেকে শুল্ক-কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। না, ব্যবসায়ীরা আগাম বলে চলেছেন, এতে হবে না। তারা চান ডিম আমদানির ওপর ৩৩ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হোক। কী হবে শেষ পর্যন্ত আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি, সরকার ডিম আমদানি করবে।

এখানেই মুশকিল; আমাদের বুঝতে কষ্ট হয়। সবসময় বলা হয়, আমরা সবকিছুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেমন, চাল দিয়ে শুরু করি। আগে বলা হতো, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য কিন্তু বেশ বড় পরিসরের জিনিস। পরে বলা হলো, না-আমরা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেখা যাচ্ছে, গম আমদানি করতে হয় ৬০-৭০ লাখ টন। আবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে-চালের তথ্য ঠিক নয়। হয় মানুষের সংখ্যার হিসাব ঠিক নেই, নতুবা চাল উৎপাদনের তথ্য ঠিক নেই। এর ফয়সালা হওয়া দরকার। চালের পর ধরা যাক আলুর কথা-গোল আলু। বরাবর শুনে এসেছি, গোল আলুতে আমরা উদ্বৃত্ত। একবার রাশিয়ায় আলু রপ্তানির কথা ওঠে। গোল আলু দিয়ে কী কী করা যায়, তার কথা হয়। মইন-উ-আহমেদের হাফ সামরিক শাসনামলে গোল আলু খেয়ে চালের অভাব দূর করার কথা হয়। বানানো হয় গান। দিনের পর দিন সেই গান শুনেছি টেলিভিশনে। কণ্ঠ মমতাজের। কত বড় আশার কথা, গোল আলুতে আমরা উদ্বৃত্ত। ও মা! দেখা গেল গোল আলু পর্যন্ত আমদানি করতে হলো প্রতিবেশী ভারত থেকে। বলা হচ্ছিল, মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সবজি তো বটেই। যার কথাই বলা হয়, তাতেই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। ডিমেও তাই। না, এখন দেখা যাচ্ছে, ডিমে আমরা ঘাটতির দেশ। অতএব, ডিম আমদানি করতে হবে। কোত্থেকে জানি না। তবে লাইসেন্স দেওয়ার নমুনা দেখে মনে হয় ডিম আসবে প্রতিবেশী দেশ থেকেই। অথচ প্রতিবেশী দেশের ‘পণ্য বর্জনের’ আন্দোলন আছে। খোলাবাজার অর্থনীতিতে যে আমদানি নিষিদ্ধ করা যায় না ইচ্ছামতো, তার কথা কে বলবে!

আমরা গম, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, কাঁচামরিচ, ডিম সবই আমদানি করি প্রধানত প্রতিবেশী দেশ থেকে। এখানেই কথা। কৃষিপ্রধান দেশ আমরা। কেন সব কৃষিপণ্য আমরা আমদানি করে খাব? এটা তো লজ্জার বিষয়। স্বাধীনতার ৫০-৫২ বছর পরও এটা ঘটবে কেন? প্রতিবেশী বলে কথা নয়, আমরা আমদানি করে খাব কেন? আমাদের কৃষকরা কর্মঠ। তারা সারা বছর এখন নানা ফসল করে। যেসব ফসল লাভ দেয়, সেসব ফসলে তারা উৎসাহী। লোকসানি কারবার তারা আর কত করবে? কেন জানি আমরা বেশ বড় বড় কারবার করতে গিয়ে, বড় বড় অবকাঠামো করতে গিয়ে কৃষির কথা ভুলে গেছি। যত নজর ঢাকা শহরে। মেট্রো বানাও, এক্সপ্রেসওয়ে বানাও। আরও কত কী! সারা দেশের মানুষকে ঢাকা শহরে আনো। গ্রাম হোক শূন্য। কৃষির দরকার নেই-ভাবটা এমন। তা না হলে ৫০-৫২ বছরে চোখের সামনে কৃষিকাজটি হয়ে উঠেছে একটি লোকসানি কারবার। কৃষক ভালোভাবে যা-ই করে, তাতেই তার লোকসান। বাধ্য হয়ে সে তা করে। উপায় নেই বলে। যুবক বয়সের ছেলেরা কৃষিকাজ করতে চায় না। ওই বয়সের অশিক্ষিত ছেলেরা পর্যন্ত কৃষিকাজ না করে চলে যেতে চায় মধ্যপ্রাচ্যে। মালয়েশিয়া, ইউরোপ ইত্যাদি দেশে। লাঙ্গলে সে হাত লাগাতে চায় না। খবর ছাপা হচ্ছে, কৃষিকাজ লোকসানি কাজে পরিণত হচ্ছে-কিন্তু তবু কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অন্যসব ব্যবসায় ব্যবসায়ীদের লোকসান পুষিয়ে দেয় সরকার। এই তো বাংলাদেশ ব্যাংক সেদিন নোট ছাপিয়ে টাকা দিল পোশাকশিল্পের মালিকদের। কেন? কারণ তারা বেতন দিতে পারছে না। এর বিপরীতে কৃষিতে যখন ভর্তুকি দেওয়ার কথা ওঠে, তখন আপত্তি সবার। বড় আপত্তি আইএমএফের, যার খপ্পরে আমরা পড়েছি। কৃষিতে ভর্তুকির বড় শত্রু এ সংস্থাটি সারা বিশ্বে ‘হ্যাভক’ সৃষ্টি করছে। ঠিক আছে, ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। তাহলে কৃষিকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করা হোক। তা না হলে চাল, গম, পেঁয়াজ, আলু, ডিম, কাঁচামরিচের সমস্যা থেকেই যাবে।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম