Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ভাবমূর্তি সংকটের দায় কার?

Icon

মোহাম্মদ হোসেন

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একটি ঘূর্ণিঝড় ঘটে গেল বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার নিয়ে। এটি কীভাবে হলো, কেন হলো, তা তলিয়ে দেখার জন্য তিনজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ তদন্ত কমিটি কী তথ্য, উপাত্ত, ঘটনা খুঁজে বের করবে; তাতে কী ফলাফল হবে, আমরা এখনো তা জানি না। কিন্তু ঘটনা সত্য-মিথ্যা দিয়ে বিচার হওয়ার আগেই বহু ক্ষয়ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার ছাড়াও অন্য ক্যাডারের অনেক ঊর্ধ্বতন নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামোর গঠন অনুমোদন, জনপ্রশাসনে চাকরির নিয়ম, পদ্ধতি, নীতি, বিধি, আইন প্রণয়ন, রক্ষণ ইত্যাদির ব্যাখ্যাদানকারী এ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের সব কর্মচারীর একটি পবিত্র তীর্থস্থানের মতো এ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অতীতে এ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো কোনো কর্মকর্তা সম্পর্কে নানা ফিস-ফিস শোনা গেলেও গণমাধ্যমে বর্তমানে যে তোলপাড় হচ্ছে, তা কখনো হয়নি। জনপ্রশাসনের সচিবকে সবসময়ই একজন শ্রদ্ধাস্পদ কর্মকর্তা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ তাকে যেভাবে বিব্রত করেছে, ইতঃপূর্বে জনপ্রশাসনের কোনো সচিব ওইরূপ বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন কিনা আমার জানা নেই। এখন ঘটনাটি আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক হিসাবে চিহ্নিত করারও সুযোগ নেই। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দাবি করেছে, অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ করে প্রশাসন ক্যাডারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ঘটনার রং কম-বেশি যা-ই হোক না কেন, এ ঘটনা যে প্রশাসন ক্যাডারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আজ প্রশাসন ক্যাডারের এ দুর্গতি দেখে সত্যি দুঃখ হয়। জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন না পাওয়ার কারণে আন্দোলন হয়। টাকা লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অনেক নিচুতে নেমেছে, তাতে কেউ কোনো দ্বিধা করেনি। এরা দেশ ও জাতির জন্য কী করতে পারবে বা জনগণের জন্য কিছু করার মানসিকতা কি এদের আছে? সব দোষ কি এদের, না আরও কেউ দায়ী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার পুনর্গঠন করা হয়, তখন বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রশাসন ক্যাডারে আত্তীকরণ করা হয়; যেমন-ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস (আইএসএস)। ১৯৭৩ সালের ব্যাচকে বিসিএসের প্রথম ব্যাচ হিসাবে গণনা করা হয়। এ ব্যাচকে একজন প্রভাবশালী এবং নামকরা নেতার নামে ডাকা হয় অর্থাৎ ওই নেতার নাম, তার পর ক্যাডার শব্দটি লাগানো হয়। কারণ হিসাবে জানা যায়, তিনি যাকে পছন্দ করতেন বা তার পরিচিত বা সমমানের নেতারা যাকে সুপারিশ করতেন, তাকেই তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে চাকরিতে নিয়োজিত করতেন। তবে এ ব্যাচে অনেক নামকরা কর্মকর্তাও কাজ করেছেন বলে জানা যায়।

এরপরে ১৯৭৭, ৭৯, ৮১ এবং ৮২-এর বিসিএস ব্যাচগুলো নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক নেই। এ সময়ে কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়েও প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেছেন। লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ১৯৮৩ সালে বহু নির্বাচনি প্রশ্নোত্তরের একটি অতি সংক্ষিপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বয়সসীমা নির্বিশেষে সম্ভবত ৬৫০ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়; যাদের মূলত উপজেলা কাচারিতে ফৌজদারি বিচারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের সবাইকে ৮৩’র ব্যাচ বলেই সবাই জানে, তবে এ ব্যাচের সদস্যরা নিজেদের ৮২’র স্পেশাল ব্যাচ বলে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন। যদিও অনেক নিন্দুক আছে, যারা আবার ৮৩’র ব্যাচকে টিকমার্ক ব্যাচ বলে থাকে; যা হোক, ওই ৮৩’র ব্যাচের সদস্যরা আন্দোলন ও লবিং করে ক্যাডারভুক্তি লাভ করেন এবং ৮২’র ব্যাচের লেজে তাদের জ্যেষ্ঠতা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ আমলে প্রশাসন ক্যাডারের যেসব নিয়োগ হয়েছে, তার মধ্যে ৮২’র নিয়মিত ব্যাচকে চৌকশ হিসাবে গণ্য করা হতো। অন্যান্য ব্যাচে অনেক চৌকশ কর্মকর্তা আছেন, তবে ৮২’র ব্যাচের প্রায় সব কর্মকর্তাই চৌকশ আর সিএসপিরাও তাদের একটু বেশি পছন্দ করতেন। তাই নিন্দুকেরা আবার ৮২’র নিয়মিত ব্যাচকে বাংলা সিএসপি বলে ডাকত, পেশাগত ঈর্ষাপরায়ণতা (Professional Jealousy) আর কী!

এরপর ৮৪ ও ৮৫’র দুই ব্যাচে এক হাজার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হলো। লক্ষ্য বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন চালানো। এক ব্যাচে এতসংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগের কারণে প্রশাসনের যে উচ্চমার্গীয় বৈশিষ্ট্য, তার প্রচুর ঘাটতি হয়েছিল। এ কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী ব্যাচগুলোতে কত কত নিয়োগ হয়েছে, তার হিসাব আমার জানা নেই। কাজেই ৭৩’র ব্যাচে নানা বর্ণের আত্তীকরণ, ৮২’র ব্যাচের সঙ্গে ৮৩’র ব্যাচের একটি বিশাল বহরজুড়ে দেওয়া, ৮৪ ব্যাচের ৪৫০ এবং ৮৫ ব্যাচের ৫৫০ জনের নিয়োগের সম্মিলিত ফলাফলে প্রশাসন ক্যাডারের আভিজাত্য নামতে শুরু করেছিল। তা কেউ আর পুনরুদ্ধার করতে বা পুনঃস্থাপন করতে পারেনি। এরপর পর্যায়ক্রমে তার আরও অধঃপতনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সম্ভবত ১৯৯৫-৯৬ সালে এসে বিসিএস (সচিবালয়) ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হলো। ফলে সচিবালয় ক্যাডারের প্রত্যেক ব্যাচের কর্মকর্তারা গিয়ে স্ব স্ব ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের লেজে জুড়ে গেল। একইভাবে অতিসম্প্রতি ইকোনমিক ক্যাডারকেও জুড়ে দেওয়া হলো প্রশাসন ক্যাডারের লেজে। শোনা যায়, এসব কাজ কোনো জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে নয়, বরং ব্যক্তি স্বার্থে হয়েছে। সচিবালয় ক্যাডার থেকে বা ইকোনমিক ক্যাডার থেকে বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা সচিব হতে পারেন না। তাই তাদের কোনো কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ক্ষমতার এতই পাকাপোক্ত দহরম-মহরম ছিল, ক্যাডারই মার্জ হয়ে গেল তাদের সচিব হওয়ার খায়েশ মেটাতে। আবার এ-ও শোনা যায়, ইকোনমিক ক্যাডারের লোকরা প্রকল্পের ব্যয়ে বেশি বেশি বিদেশে যান। প্রকল্পের বিদেশযাত্রায় প্রশাসন ক্যাডার বেশি ভাগ পায় না, তাই প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে তাদের অধিগ্রহণ করে বিদেশ যাওয়ায় পথ পরিষ্কার হলো। সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বে যারা ছিল, তাদের সঙ্গে নিয়েই এসব ধান্দাবাজি করা হয়েছে।

১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকারের অভিযাত্রা শুরু হলো। ফলে ’৯০-এর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ বাতিল করে আবার কেন্দ্রীভূত শাসন জারির ফলে উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট ও মুনসেফ কোর্ট থাকল না। প্রশাসন ক্যাডার আবার জেলা পর্যায় কেন্দ্রীভূত হলো। প্রশাসন ক্যাডার শ্বেতহস্তীর আকার ধারণ করল। নিচের দিকে অনেক পদ থাকলেও উপরে পদ অনেক সংকুচিত। উপসচিব পদোন্নতির সময় শুরু হলো রাজনৈতিক পরিচয়কেন্দ্রিক পদোন্নতি। বিশেষ করে এ পরিচয় তিনটি দলের মধ্যেই ব্যাপক ছিল। কেউ বিবেচিত হলো জাতীয়বাদী, কেউবা লীগ আবার কেউবা জামায়াত। শুনেছি, এটি নাকি জাতীয়তাবাদীরা শুরু করেছে, লীগ এসে তার ওপরে স্কয়ার বসিয়ে দিয়েছে অর্থাৎ এক্সপোনেশিয়াল হারে বেড়েছে। কার ওপর দিয়ে কে যেতে পারে। প্রথমদিকে নাকি কিছুটা ধার্মিক পদ্ধতিতে এক বলয় অন্য বলয়কে ল্যাং মারত। কিন্তু পরে এ ধর্ম-কর্ম রহিত হয়ে গেছে। অধর্মই ধর্ম হয়ে গেছে। প্রত্যেক ব্যাচেরই সংগঠন আছে। কাজেই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, ছাত্রজীবনে ওই দলের সমর্থকরা ব্যাচের নেতা হয়। তারপর তারা খেয়াল-খুশিমতো তাদের বিরোধী পক্ষ, অপছন্দের ব্যক্তি বা নিরীহ, নিরপেক্ষ সবাইকে বিরোধীদলীয় ট্যাগ লাগিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত করা, সুবিধাজনক পদায়ন যেমন ডিসি, সচিব, সংস্থা প্রধান থেকে বঞ্চিত রাখা এবং নিজেরা সব পদোন্নতি এবং সুবিধাজনক পদায়ন গ্রহণ ইত্যাদি সবকিছুতে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন।

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর যে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা যেমন ২০১৯ থেকে শুরু করে কালক্রমে ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদে উত্তরণ হয়েছিল, তেমনি তাদের সঙ্গে প্রশাসন কাঠামোকেও দুমড়ে-মুচড়ে একটি আবর্জনায় পরিণত করা হয়েছে। ১৯৮২’র ব্যাচের প্রথম স্থান অধিকারীসহ অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে অবসর দেওয়া হয়েছে। অপরদলীয় বিবেচনায় তাদের সচিবও করা হয়নি। অথচ ৮২’র স্পেশাল ব্যাচ বা ৮৩’র ব্যাচ বা টিকমার্ক ব্যাচ থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ করে তাকে আবার ওইপদে সম্ভবত বছর দুয়েক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক সরকারের আমলে দলীয় কর্মকর্তারা যেভাবে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন বা পেয়েছেন, তা দেখলে মনে হতো জনপ্রশাসন, প্রধানমন্ত্রীর অফিস তাদের মামারবাড়ি। কারও কারও ক্ষেত্রে মামারবাড়ি আবার মামাতো বোনকে বিয়ে করে সেটা নিজের শ্বশুরবাড়িও বটে। মামারবাড়িতে যেমন আবদার করে সবকিছু পাওয়া যায়, তেমনি দলীয় পরিচয়ে প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটের সদস্য হিসাবে তারা যা চাইত, তাই হতো। সেই মামারবাড়ি যদি শ্বশুরবাড়ি হয়, তাহলে তো দ্বিগুণ আবদার। অতিরিক্ত সচিব হয়েও মন্ত্রীর পিএস থেকেছেন অনেকেই। দুই জেলায় ডিসি, পরে বিভাগীয় কমিশনারও দুই বিভাগে, এরপর দুই-তিন মন্ত্রণালয়ের সচিব। রসালো পদ অলংকৃত করার কারণে অনেকে সচিব হতে না পারলেও পিআরএলে যাওয়ার আগের দিন তাকে সচিব পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২০১৪, ১৮ এবং ২৪-এর স্বৈর-গণতান্ত্রিক সরকারের উদারতায় এ ধরনের সচিবের পরে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হয়েছে। আর এসব নিয়োগের পেছনে যে পদ্ধতি ছিল, তা হলো দল, তেল, নারী, কড়ি ইত্যাদি। কোনো শরিয়াহ বা বিধি-বিধান ছিল না, ছিল শুধু মারেফাত, কারও কারও অভিপ্রায়-ইচ্ছা। কারও কারও কুন ফায়ে কুন। আর অন্যদিকে কোনো কোনো কর্মকর্তার পাপ এতই গাঢ় ছিল, তাদের ৩০ বছরের চাকরি জীবনে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হওয়ার পুণ্যটুকু অর্জন করতে পারেননি। তাদের পাপ কী? জিজ্ঞেস করলে পদোন্নতিদানকারীরা জবাব দিতেন, পাপ তো দেখা যাচ্ছে না। তাদের পাপ এত গাঢ়, পাপের রূপ, আকার কেমন তা দেখা যায় না, কিন্তু পাপ নিশ্চয় আছে, এ অনুমান থেকে তাদের শাস্তি হাবিয়া দোজখের একদম নিচে। যা হোক, এখানে এত কাহিনি আছে যে ভালো কোনো গল্পকার শতশত ছোট গল্প, নয়তো কুড়িখানেক উপন্যাস লিখে ফেলতে পারবেন। আন্দালিব রাশদী কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখেছেন কিনা আমি জানি না।

উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবের জন্য নির্ধারিত পদসংখ্যার চেয়ে ২-৩ গুণ বেশিসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে এক বিশাল নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে একদিকে ডেস্ক পর্যায়ে কর্মকর্তার আকাল পড়েছে, অন্যদিকে টেবিলের চেয়ে চেয়ার উঁচু হয়ে এক বিশাল মাথাভারী প্রশাসন তৈরি হয়েছে; যা আমলাতন্ত্রের মৌলিক সূত্রের চরম লঙ্ঘন। এ সবই হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের স্বেচ্ছাচারিতায়। ক্ষমতা তাদের হাতে, তাই তারা যেমন খুশি তেমনভাবে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। নেতারা দই-মাখন খাচ্ছে, সঙ্গে দল ভারী করার জন্য পছন্দের সহকর্মীদের একটা অংশকে একটু ঘোল খাইয়ে সন্তুষ্ট রাখছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ক্ষোভের বাষ্প বুঁদ বুঁদ করতে থাকে, যার ফলে প্রশাসন ক্যাডারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

আজকে প্রশাসন ক্যাডারের ভাবমূর্তির যে সংকট, এটি তো একটি ক্যাডারের কয়েকজন বা কয়েকশ বা কয়েক হাজার কর্মকর্তার সংকট নয়। এটি একটি জাতীয় সংকট, দেশের সংকট। যেদিন থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে কোনো না কোনো কাঠামোতে আমলাতন্ত্র ছিল। রাষ্ট্রব্যবস্থা যতদিন থাকবে, আমলাতন্ত্র ততদিন থাকবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশাসন ক্যাডার এ আমলাতন্ত্রের মেরুদণ্ড, কোমর, একইসঙ্গে মুখমণ্ডল। কারও মেরুদণ্ড যদি না থাকে, সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে? কারও যদি কোমর ভেঙে যায়, সে কি আর চলতে পারে? প্রশাসন ক্যাডার আজ এ ধরনের সংকটে পড়েছে এবং তা দীর্ঘদিনের সঞ্চিতি। আর এ সংকটের দিকে যারা ঠেলে দিয়েছে, তারা রাষ্ট্রকে সংকটে ফেলেছে। দিনে দিনে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, বিশেষত এসএসবির সদস্যরা এবং তাদের সহযোগীরা, বিসিএস প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যাচের সংগঠনিক নেতারা এবং বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ওই সময়ের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা এ সংকট তৈরি করেছেন। এরা সবাই মিলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছেন নিজেদের অপস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন, এদের বিচার হওয়া উচিত।

প্রশাসনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি কর্মসূচি হাতে নেওয়া প্রয়োজন। পদোন্নতি, পদায়ন, কর্মকর্তার যোগ্যতার মান মূল্যায়নের জন্য যেসব নীতিমালা, বিধিমালা, পদ্ধতি রয়েছে, তা পুরোটাই একটা ভাঁওতাভাজি। এর বিজ্ঞানসম্মত ও গাণিতিক ভিত্তি নেই। প্রশাসন ক্যাডারের হাতে যেভাবে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত, তা সাধারণ বিচারে এবং গণতান্ত্রিক মাত্রায় ‘স্বার্থের সংঘাত’ দ্বারা পূর্ণ। এরা অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ এবং অন্য ক্যাডারকে বঞ্চিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে নিদারুণভাবে নির্লজ্জ। কাজেই এ প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের যোগ্যতা ও মানের মূল্যায়ন, পদোন্নতি ও পদায়ন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে না দিয়ে এ কাজের জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ বা কমিশন গঠন করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার।

মোহাম্মদ হোসেন : লেখক ও বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম