Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রাজনৈতিক দলের সংস্কার কেন জরুরি

Icon

মো. মুজিবুর রহমান

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বহু বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সচেতন নাগরিক সমাজ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এ নিয়ে সরব রয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নির্বাচন কমিশনও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে অনেক আগে উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যতটা আশা করা হয়েছিল, কার্যত সে উদ্যোগ ততটা সফল হয়নি।

রাজনৈতিক দলের সংস্কারের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগের একটি ছিল, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনের অধীনে নিবন্ধিত দলগুলোর জন্য দলের গঠনতন্ত্র কমিশনে জমা দেওয়ার একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা। দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের পর্যাপ্ত আইন ও বিধি বিদ্যমান থাকলেও দলের সংস্কার বিষয়ে আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। কেন হয়নি-এ প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায়নি। তবে অনেকেই বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে দলের নেতৃত্বের মধ্যেই এক ধরনের অনীহা বা অনিচ্ছা কাজ করায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সংস্কার নিয়ে আর বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই এ সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য খাত অনুযায়ী কমিশনও গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট কমিশন প্রাথমিকভাবে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কার কাজও শুরু করা দরকার। এক কথায় বলা যায়, বর্তমানে দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার অনেক সহজ হবে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। শুধু দরকার দলগুলোর আন্তরিক ইচ্ছা ও সহযোগিতা।

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সংস্কার ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মুখর রয়েছে। কোনো কোনো দল প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দাবি করলেও কিছু রাজনৈতিক দল সংস্কারের জন্য বেশি সময় না নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন আয়োজনের জন্য মতামত জানিয়ে রেখেছে। লক্ষণীয় বিষয়, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র সংস্কার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে দাবি তুললেও নিজেদের দলের সংস্কার নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ প্রকাশ করছে না। অথচ রাষ্ট্র সংস্কারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই রাজনৈতিক দলের সক্রিয় উপস্থিতি অপরিহার্য। গণতন্ত্রের স্বার্থেই দেশে বিরোধী বা একাধিক রাজনৈতিক দল থাকা দরকার। সরকারের বাইরে পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল ও দেশে বিদ্যমান অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে দেশে কার্যকর সরকারব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ইতিবাচক সহযোগিতা ব্যতীত সরকার কার্যকরভাবে পরিচালিত হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দল উভয়ের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণে ভূমিকা রাখা। কিন্তু আমাদের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাতে দেখা যায়, সরকারি দল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিরোধী মত দমনে অধিক তৎপর থাকে। একইভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলও জনকল্যাণে সরকারকে সহযোগিতার পরিবর্তে প্রায় সব সময় অসহযোগিতা করে। ফলে সৃষ্ট সংঘাতের কবলে পড়ে দেশবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ব্যাপক প্রাণহানিও ঘটে কোনো কোনো সময়। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলকেই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে জনগণের প্রতি তাদের দলের আচরণের পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ হতে হবে ইতিবাচক ও সহযোগিতামূলক। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সহনশীলতার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এসব লক্ষ্য নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার করা জরুরি।

বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, সেসব দলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ দল গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী পরিচালিত হয় না। রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হলে দরকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ। অনেক ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্বাচন প্রক্রিয়া দলীয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে উপস্থিত রাজনৈতিক প্রতিনিধি ও কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সম্পন্ন হলেও তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে গণতান্ত্রিক রীতি অনুসৃত হয় না। এমন অনেক দল রয়েছে, যেসব দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে যেভাবে নির্দেশনা আসে, সেভাবেই দলের পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচন থেকে দলের অন্যান্য সাংগঠনিক নেতৃত্ব নির্বাচিত ও দলীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশের খবরও প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে থাকে। কখনো কখনো রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে, তা জাতীয় পর্যায়ে হোক কিংবা আঞ্চলিক বা জেলা পর্যায়ে হোক, নেতৃত্ব নির্বাচনে অগণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণ, দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং মতবিরোধের কারণে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। এসব ঘটনা অনেকক্ষেত্রে সহিংসতার রূপ নেয়। এর প্রধান কারণ, দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ না করা। দেশে সরকারের গণতান্ত্রিক আচার-আচরণের হিসাব-নিকাশ নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় সোচ্চার থাকে। অথচ নিজেদের দলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও চিন্তা-চেতনার প্রয়োগের তেমন কোনো নমুনা দেখা যায় না। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই এ ধরনের অবস্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে এ ধারণা যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই, তা নয়।

রাজনৈতিক দল কীভাবে গঠিত হবে, কীভাবে পরিচালিত হবে এবং দলগুলোর আয়ের উৎস কী, আয়-ব্যয় কীভাবে হবে, এসব বিষয় নিয়ে স্বচ্ছতার স্বার্থেই অনুপুঙ্খ জানার অধিকার দেশের সাধারণ মানুষের রয়েছে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোকে দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করতে দেখা যায় না। একটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, দলের হিসাব প্রতি বছর অডিট করা হবে এবং অর্থবছর সমাপ্তের ছয় মাসের মধ্যে অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। এ নিয়ম দলের গঠনতন্ত্রে লিখিত থাকলেও বাস্তবে দলের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অডিট করা বা কোনো অডিট রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করার কোনো খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। এসব বিষয়েও সংস্কার জরুরি।

গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য রাষ্ট্রে প্রচলিত আইন-বিধির আওতায় উপযুক্ত যে কোনো নাগরিক রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকারী হলেও জনগণের সংখ্যানুপাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে দল গঠন কতটুকু সমীচীন, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কারণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাজনৈতিক দল গঠনের কারণে অপরাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের সংস্কারের মাধ্যমে এখন দরকার অপরাজনীতি নিয়ন্ত্রণ। রাজনীতি নয়, অপরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত ও সহযোগিতা দরকার। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত তথ্যমতে, দেশে ৪৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর মাত্র ১১টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হয়। একই বছর অক্টোবর মাসে দুটি দল নিবন্ধন লাভ করে। পরবর্তীকালে আরও ৪০টি দল নিবন্ধিত হলেও নিবন্ধনের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে যতগুলো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের উল্লেখ রয়েছে, বাস্তবে দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা আরও বেশি। সাধারণ মানুষের কত অংশ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের নাম জানেন, তা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলের সংখ্যা যাই থাকুক না কেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এভাবে দেশে গণতান্ত্রিক ভিত্তি মজবুত করা সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক পরিবেশের সুরক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া রাজনৈতিক সরকার নিজেও এ ধরনের চেষ্টায় সফল হতে পারবে না। কারণ গণতন্ত্রের সাফল্য শুধু সরকারের একক কর্তৃত্ব ও সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। এজন্য জনগণের প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারি দলসহ সব রাজনৈতিক দলের কমিটমেন্ট থাকতে হয়।

মো. মুজিবুর রহমান : অধ্যাপক (শিক্ষা) ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম