Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা : সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল

Icon

মেজর জেনারেল মো. মাহবুব-উল আলম

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাব্যবস্থা হলো একটি দেশ ও জাতির অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়; বিবেককে শানিত করে। দেশের উন্নতি সাধনে ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে প্রত্যেক নাগরিককে সুনাগরিক হিসাবে যোগ্য ও তদনুযায়ী কর্মে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার ভূমিকা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। একজন শিক্ষার্থী তার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় অতিক্রম করার পর স্নাতক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ভবিষৎ পরিকল্পনা, মেধা ও যোগ্যতানুসারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্নকরণের ক্ষেত্রে, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ লাঘব ও আর্থিক সাশ্রয়ের জন্য দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে নির্দিষ্ট পরিসরে গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়। এ ভর্তি প্রক্রিয়ায় দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করেছে, আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে। গুচ্ছ পদ্ধতি কী, কেন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এতে অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক এবং গুচ্ছ পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিবন্ধকতাগুলো ও তার সম্ভাব্য সমাধান কী হবে সে ব্যাপারে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের আলোকে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে অনুমিত।

‘গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা’ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক বার্ষিক সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। স্নাতক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার ধরন অনুসারে অথবা সমজাতীয় বিষয়ের ভিত্তিতে গুচ্ছ তৈরি করা হয়। সে অনুযায়ী সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আলাদাভাবে বিভিন্ন গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত করে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। কোনো কোনো দেশে একই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একক ভর্তি পরীক্ষার প্রচলন থাকলেও দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয়/একক ভর্তি পরীক্ষার প্রচলন খুব বেশি দেশে পরিলক্ষিত হয় না। স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি কোন দেশে কিভাবে সম্পন্ন হচ্ছে, সেদিকে কিছুটা দৃষ্টিপাত করা যাক।

পাকিস্তান ও ভারতে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিভিন্ন কমিশন ও এজেন্সির তত্ত্বাবধানে আলাদা আলাদা গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন হয়ে থাকে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে। জাপানে কেন্দ্রীয় একক ভর্তি পরীক্ষার প্রচলন দেখা যায়। The National Center for University Entrance Examination-এর তত্ত্বাবধানে সম্মিলিতভাবে National Center Test for University Admission পরিচালিত হয়। চীনে শিক্ষার্থীদের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় পর্যায়ে The Nationwide Unified Examination for Admissions to General Universities and Colleges অনুষ্ঠিত হয়; দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এ পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত নাম ‘Gaokao’। দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য প্রচলিত রয়েছে College Scholastic Ability Test (CSAT), যাকে কোরিয়ান ভাষায় বলা হয় ‘Suneung’।

চীন, জাপান, পাকিস্তান, ভারত কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ায় এ ধরনের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি পরিলক্ষিত হলেও অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে-এসব দেশের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ে একক/কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করার বিষয়টি অনেক দেশে বিদ্যমান। দেশভেদে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির প্রক্রিয়া বিভিন্ন রকম। কেননা একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ভর্তি প্রক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন, পরিচালনা পদ্ধতি এবং সেদেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনাসহ আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল। এখানে দেশের ‘সার্বিক ব্যবস্থাপনা’ বলতে ভর্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি পর্যায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথা বোঝানো হয়েছে, যেমন-অবকাঠামোগত সুবিধা, তথ্যপ্রযুক্তিগত সুবিধা, সুনির্দিষ্ট নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়া, স্পষ্ট ও জবাবদিহিতামূলক পদক্ষেপ ইত্যাদি।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ‘সাধারণ গুচ্ছ’, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ‘কৃষি গুচ্ছ’ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গুচ্ছ’ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া প্রকৌশল বিষয়ের জন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ‘প্রকৌশল গুচ্ছ’ করা হয়েছে। গত বছর ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে অনুষ্ঠিত গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় তিনটি গুচ্ছে সাধারণ বিষয়ে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষিভিত্তিক ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে অনুষ্ঠেয় গুচ্ছ পদ্ধতি ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় দুটি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে। নতুন যুক্ত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি গুচ্ছে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হলো ৩৩। কিন্তু এ গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেনি, বিশেষ করে পুরোনো ও বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অন্তর্ভুক্তিহীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসসহ অন্য আরও কিছু সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব একাডেমিক কার্যক্রম সংক্রান্ত নীতিমালা, একাডেমিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, প্রশাসন পরিচালনা পদ্ধতি এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন যৌক্তিক সুস্পষ্ট কারণ বিদ্যমান।

মূলত শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও আর্থিক ব্যয় হ্রাস করতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলেও এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বস্তি আনতে পারেনি, বরং শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে! এ পদ্ধতিতে একজন পরীক্ষার্থী শারীরিক অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হলে তার জীবন থেকে একটি বছর নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া ভর্তি প্রক্রিয়ার জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা, দেরিতে ক্লাস শুরু হওয়া, সেশনজট, মাইগ্রেশন জটিলতা, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষার্থী না পাওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী পেলেও অনেক দেরিতে পাওয়াসহ নানা সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে; যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের ভুক্তভোগী হয়েছে শিক্ষার্থীরাও। ভর্তি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণ করে অংশগ্রহণকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তী ‘গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া’য় অংশগ্রহণ করতে অনীহাও প্রকাশ করেছে। বস্তুতপক্ষে এ পদ্ধতির ভর্তি প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল সমন্বিত, কেন্দ্রীয় অথবা একক ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু প্রাথমিকভাবে অনুষ্ঠিত এ গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন পর্যায়ে যে সমন্বয়হীনতা ও অসামঞ্জস্য অবস্থা দেখা দিয়েছে, তাতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছে। ভবিষ্যতে সমন্বিত একক ভর্তি পরীক্ষা যদি অনুষ্ঠিত হয়, তবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, প্রুফ রিডিং, বিভিন্ন সেটের প্রশ্ন বাছাই, প্রশ্ন প্রিন্টিং, প্রশ্ন সংরক্ষণ, প্রশ্নের গোপনীয়তা রক্ষা ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নে অস্পষ্টতা ও নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কিত উল্লেখিত প্রতিটি পর্যায় কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করা একটি ব্যাপক ও সময়সাপেক্ষ কর্মযজ্ঞ, যা সম্পন্ন করার মতো দক্ষ জনবল, উপযুক্ত কাঠামো, সর্বোপরি সক্রিয় ব্যবস্থাপনা এখনো প্রস্তুত নয় বলে জানা যায়।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা পরিচালিত হয়, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য, নীতি বা কর্মপরিকল্পনা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইনানুযায়ী প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব, কর্মপদ্ধতি ও পরিচালনার ক্ষেত্র অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুটা হলেও আলাদা হয়ে থাকে। তাছাড়া কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন একাধিক অধিভুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রে মূল ক্যাম্পাসের কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন করা হয়। ফলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারের সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মিল না থাকায় সম্মিলিতভাবে গুচ্ছের জন্য প্রস্তুতকৃত একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। করোনাকালীন যখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত ছিল, তখন বিইউপিসহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। সে সময় তারা কোনো সেশনজট ছাড়াই একাডেমিক কার্যক্রম চলমান রেখেছে এবং অন্যদের থেকে এগিয়ে আছে। ফলে গুচ্ছ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করলে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটে পড়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার মানদণ্ড এক নয়; অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফল বিবেচনার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পার্থক্য বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়; যেমন-কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি পৃথক মন্ত্রণালয় থেকে বাজেট প্রাপ্তির বিধান রয়েছে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ আছে, আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের প্রতিষ্ঠার পেছনে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। গুচ্ছ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করলে এসব উদ্দেশ্য অর্জন ব্যাহত হতে পারে। তাছাড়া সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়ায় নতুন ও আঞ্চলিক বা জেলা পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তুলনামূলকভাবে মেধাবী শিক্ষার্থী পাওয়ার সম্ভাবনা কম। একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ সাধন কিংবা তার ভাবমূর্তি উন্নয়নের জন্য ভালো শিক্ষকের পাশাপাশি ভালো শিক্ষার্থীও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়ার যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে, সেটাকে পদ্ধতিগতভাবে আরও স্বচ্ছ ও ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির সমন্বয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষাকে পর্যবেক্ষণের জন্য কয়েক বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। কর্মপরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় গুচ্ছ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বয়ে গুচ্ছ/একক পদ্ধতির ভর্তি কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে। নতুন পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়ার কার্যক্রমটি সফল হলে এবং এর কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তাব করা যেতে পারে। তাই স্থায়ী সুফল দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব ভর্তি কার্যক্রম চলমান রাখতে পারে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত না করে দুটি ধারায় ভর্তি প্রক্রিয়া চলমান রাখা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। সম্পূর্ণ নতুন এ পদ্ধতি ক্ষুদ্র পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করে সফল হওয়ার পর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে অংশগ্রহণ করানো যৌক্তিক বা বাস্তবসম্মত হবে বলে অনুমেয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়গুলো স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রম, যা বিশেষভাবে বিবেচ্য। কেন্দ্রীয়/একক ভর্তি প্রক্রিয়া/গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ধারাবাহিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে; এবং শিক্ষার্থীদের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এ অবস্থায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বকীয়তার ধারাবাহিকতায় শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকল্পে যৌক্তিকতার পরিপ্রেক্ষিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম চলমান রাখতে পারে। ক্রমান্বয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে যাচাইকৃত পদ্ধতির সফলতা পরিলক্ষিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগ্রহ পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিক্ষেত্রে যে পদ্ধতিই ব্যবহার করা হোক না কেন, সেটি মানসম্পন্ন ও টেকসই করার জন্য সবার ঐকমত্য খুবই জরুরি এবং পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও স্বকীয়তা বজায় রাখা প্রয়োজন।

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় মূলত একজন শিক্ষার্থীকে কোনো একটি বিষয়ে শিক্ষাদানের মাধ্যমে বিশেষভাবে যোগ্য করে তোলা হয়। শিক্ষার্থীদের মানবিক শিক্ষাকে ধারণ করতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রে এর প্রতিফলন রাখতে হবে। নীতি-নৈতিকতার নিরিখে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে আদর্শ মানুষের প্রতিফলন দেখতে পারলেই সে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হিসাবে গণ্য হবে।

বর্তমান সময়ে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দুর্নীতি রোধের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সবাইকে দেশপ্রেমের মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে জীবনকে উৎসর্গ করার মনোভাব প্রত্যেক নাগরিকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করার বোধ থাকতে হবে এবং মিথ্যাকে পরিত্যাগ করে নীতি-নৈতিকতাকে ধারণ করতে হবে। পরচর্চা, পরনিন্দা, সামাজিক অবক্ষয় ও অসাধুতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করতে পারলে দেশের উন্নয়ন অনিবার্য বলে অনুমেয়। এক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার সংস্কারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষাঙ্গনে তাদের কী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে এবং এ শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ ও জাতির মৌলিক গুণগত পরিবর্তন ঘটছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা। পরিবার ও সমাজ থেকে যথাযথ শিক্ষা না পেয়ে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলো শুধরে দিয়ে ন্যায়-নীতিসম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে হবে-যে শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ মিথ্যা বলা বা চুরি করার মতো গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে নিবৃত রাখতে পারবে; বিপদের আশঙ্কা থাকলেও সত্যি বলার সাহস রাখবে এবং দেশ ও জাতির প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করতে কখনো পিছপা হবে না। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো কে শেখাবে; এ দায়িত্ব কে নেবে? পারিবারিক সুশিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মহাপবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল হোক, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে, সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে আর এরাই সফলকাম’ (সূরা আল ইমরান : ১০৪)। নতুন সকাল দেখার জন্য কাউকে না কাউকে প্রথমে জাগতেই হবে। আমাদের বুঝতে হবে একজন নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত আদর্শহীন পেশাগতভাবে দক্ষ লোক প্রয়োজন, নাকি মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন, সৎ, দেশপ্রেমিক মানুষ প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে-লর্ড হ্যালিফক্সের উক্তি : ‘দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য।’ সত্য ও ন্যায়নীতি ত্যাগ করে কেউ অসত্য ও অসদুপায়ে অট্টালিকা গড়লেও দুর্জন একদিন ভুল ঠিকই বুঝতে পারবে এবং তার আফসোস হবে। তবে সে সময় ফেরত আর পাওয়া যাবে না, প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব হবে না। যেমনটি গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখায় পাওয়া যায় : ‘ভুল সবই ভুল; এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সবই ভুল।’ তখন এ ধরনের আত্মসমালোচনা হয়তো কোনো কাজে আসবে না।

মেজর জেনারেল মো. মাহবুব-উল আলম : উপাচার্য, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম