Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের যুদ্ধ

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের যুদ্ধ

ইতিহাসকে মুছে ফেলা যায় না। অনেক পেছনের ইতিহাসের ধারাক্রম বাদও যদি দেই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না জানলে আমরা আমাদের অস্তিত্বকেই হারিয়ে ফেলব। আমাদের ছাত্র-জনতা জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি অপশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করেছে। এ ত্যাগ ইতিহাসে নিশ্চয়ই জায়গা করে নেবে। এ নবীন প্রজন্মের উচ্ছ্বাসের পরও উদ্বেগের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, তাদের অনেকের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা অনেকটাই অনুপস্থিত। এর বড় দায় নিতে হবে পতিত আওয়ামী লীগ নেতাদেরই। তাদের দীর্ঘ শাসনকালে মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ না দেখা প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে দায়িত্ব তারা পালন করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধকে একটি গোষ্ঠী ও পরিবারের গণ্ডিতে আটকে ফেলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সঠিক চেতনা তৈরি করতে পারেননি তারা।

ইতিহাসের বড় শিক্ষা হচ্ছে, অতীতের ধারাবাহিকতা চর্চার মধ্য দিয়ে বর্তমানকে বুঝতে হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই মূর্খের মতো বর্তমান দিয়ে অতীতকে মূল্যায়ন করি।

মুক্তিযুদ্ধের একটি নিষ্পত্তিমূলক পরিণতি অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র ১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অন্তরালে রাজনৈতিক কারণ কিছুটা ভূমিকা রাখলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সহানুভূতি ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির প্রতি।

ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ও অস্ত্র সহায়তা করে গেরিলা যোদ্ধাদের এগিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে নভেম্বরের মধ্যে কোণঠাসা করে ফেলেছিল পাক বাহিনীকে। কিন্তু এ সত্যটিও মানতে হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর মতো একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে হলে সম্মুখযুদ্ধের বিকল্প ছিল না। ট্যাংক, কামান, মর্টারসহ ভারী অস্ত্র ও বিমানবাহিনীর সমর্থন ছাড়া এ যুদ্ধের নিষ্পত্তি এতটা অল্প সময়ে সম্ভব ছিল না। এ সত্য মেনে একাত্তরের শেষদিকে এসে মুক্তিপ্রত্যাশী বাঙালির চাওয়া ছিল ভারতীয় বাহিনী সরাসরি আমাদের পাশে থেকে সাহায্য করুক। বিষয়টি নিয়ে সেসময়ের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে ভেবেছে। যুদ্ধে ভারত সরাসরি অংশ নিলে এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এসব নিয়েও ভাবতে হয়েছে।

এমন একটি বাস্তবতায় ২৬ অক্টোবর থেকে ছাব্বিশ দিন ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ সফর করেন। এ সময়ে তিনি বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, বাস্তব কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বনেতারা অনেকেই এতদিন আশা করেছিলেন, পাকিস্তান একটি রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে। কিন্তু ক্রমে সে আশা ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। অবস্থা যে পর্যায়ে চলে গিয়েছে, তাতে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সঙ্গে কোনো আপস করতে হলে সেনাশাসকদের ক্ষমতা ত্যাগ করে আসতে হবে। কিন্তু সে পথে হাঁটবে না ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন।

এটি ঠিক, ভারতের মতো একটি বিদেশি রাষ্ট্রের সৈন্যরা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করায় ভূমিকা রাখলে এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সে আশঙ্কাও করছিলেন অনেকে। কিন্তু এ আশঙ্কা থেকে সবাইকে মুক্ত করেছিলেন দুপক্ষের নেতারা। শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষরিত একটি দলিল তৈরি করা হয়েছিল। তাতে ছিল বেশ কয়েকটি শর্ত। একটি শর্তে ছিল, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর যারা ভারতে প্রবেশ করেছে, স্বাধীন দেশে শুধু তারাই ফেরত আসবে। অন্য আরেক শর্তে ছিল, বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে ঢুকতে পারবে না এবং বাংলাদেশ সরকার যতদিন চাইবে, শুধু ততদিনই ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাকতে পারবে (এস এ মোহাইমেন, ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর, ঢাকা, পাইওনিয়ার পাবলিকেশন্স, ১৯৮৯, পৃ. ১৪৮-১৪৯)। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপ ভারতের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। ফলে ভারতও চাইছিল বাংলাদেশ সংকটের দ্রুত নিষ্পত্তি হোক; যা হয়তো পাক-ভারত যুদ্ধের একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। এ প্রসঙ্গে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপর ৫ ডিসেম্বর অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখা লন্ডন সানডে টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে যৌক্তিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। ‘রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অথচ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো নীরবতার ভূমিকা পালন করছে। ইন্দিরা গান্ধীর আমেরিকা ও ইউরোপ সফর আশানুরূপ ফল দেয়নি।

পাকিস্তানের প্রতি রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের ভারতীয় অনুরোধে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া ছিল হতাশাব্যঞ্জক। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ভারত আপসের দিকে না গিয়ে বরং যুদ্ধের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। একজন ভারতীয় মুখপাত্রের মতে, আমরা সাহায্য প্রার্থনা করে যা পেয়েছি, তা শুধু ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ধরনের উপদেশ।

পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা ভারতের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। জিনিসপত্রের মূল্য অনবরত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারের সংখ্যা। ছয় মাস আগে দিল্লিতে রাস্তার পাশে মাদ্রাজি দুটি দোসা ও দুটি ইডলি এবং দু’কাপ চা-কফি তিন টাকায় (২৫ পেনি) পাওয়া যেত, এখন তা সাড়ে আট টাকা।...উদ্বাস্তুদের সাহায্যার্থে যে ট্যাক্স বসানো হয়েছে, তা এখন সবাইকে আক্রান্ত করছে। কারণ প্রতিটি ভারতীয়কে একটি চিঠি লেখার জন্য ৫ পয়সা করে উদ্বাস্তু কর দিতে হয়। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধে যত টাকা খরচ হয়েছিল, বর্তমানে শরণার্থীদের জন্য ভারতের তার চেয়ে বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সুতরাং, উদ্বাস্তুদের আর্থিক সাহায্য করার বদলে যুদ্ধ করাই শ্রেয়।

কয়েকজন ব্যক্তি যেমন সম্পাদক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাসহ দিল্লিতে যার সঙ্গেই আলাপ করি, তারা সবাই একবাক্যেই বলেন, ২৪ বছর ধরে ভারত পাকিস্তানের বোঝা টানছে। এখন চিরতরে সব সমস্যা সমাধানের সময় এসেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের সমস্যা এবং ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য প্রদানে ব্যর্থতা ও জাতিসংঘের অকার্যকারিতা ভারতকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এর মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারতের অভ্যন্তরে সরকারের ওপর চাপ ছিল। মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত বেসরকারি নানা সংগঠন থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি উঠে আসে। বিশেষ করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, বুদ্ধিজীবীদের নানা সংগঠন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিক্ষক সমিতি এবং রাজ্য বিধানসভাগুলোও স্বীকৃতির পক্ষে দাবি উত্থাপন করে।’

বাংলাদেশকে অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীকে সরাসরি সাহায্যের জন্য এ স্বীকৃতিরও প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধাবস্থা তৈরি না হলে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য প্রবেশ করা বৈধতা পাবে না। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ঘোষণার প্রথম প্রত্যক্ষ কারণ ঘটিয়ে দিল পাকিস্তান।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এর আগেও দু’বার সংঘটিত হয়েছিল। তবে এ তৃতীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটটিই ছিল আলাদা। পাকিস্তান বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সম্মান দেখায়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর ক্ষমতা হস্তান্তর না করে গণহত্যা চালিয়ে পাকিস্তানি শাসক বাঙালির ওপর মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। মে মাসের মধ্যেই পাকিস্তান বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলতে থাকে। এর মধ্যে আগস্ট মাসে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ২০ বছরব্যাপী শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে প্রত্যেক দেশ অপর দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে পারস্পরিক সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করে। পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) সীমান্ত রেখায় ভারতীয় ভূখণ্ডে ভারত স্বাভাবিক কারণেই সৈন্য ও সমরাস্ত্র সমাবেশ করেছিল। সম্ভবত ভারতের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর উদ্দেশ্যে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তান আচমকা বিমান হামলা করে।

বিকাল সাড়ে ৫টায় পাকিস্তান বিমান হামলা করে। মিরেজ-৩ বিমানগুলো পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে ছিল। এতে রানওয়ের কিছুটা ক্ষতি হয়। এরপর বিমান হামলায় পাঞ্জাবের অমৃতসরের রানওয়েরও ক্ষতি হয়, তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা মেরামত করা সম্ভব হয়। এ সময়ই ভারত সিদ্ধান্ত নেয়, এ রাতেই তারা পাকিস্তানে বিমান আক্রমণ করবে। সামান্য বিরতি পরে পাকিস্তানের দুটি বি-৫৭ বিমান বোমা ফেলে হরিয়ানার আম্বালাতে। এ হামলায় সামান্যই ক্ষতি হয়েছিল। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাজস্থানের উত্তারলাই এবং পাঞ্জাবের হালওয়ারা বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানি বোমাবর্ষণে। এছাড়াও পাকিস্তানি বোমারু বিমান হামলা করে কাশ্মীরের উধামপুরে, জয়সালমির ও জোধপুরে। এভাবে প্রায় ১২টি বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানি বিমান হামলা পরিচালিত হয়। নিক্ষিপ্ত বোমার সংখ্যা ছিল ১৮৩।

এ রাতেই ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রেডিওতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এ ভাষণের মধ্য দিয়েই যুদ্ধ ঘোষিত হয়ে যায়। পরদিন ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আগে থেকেই যুদ্ধ কৌশল নির্ধারিত ছিল ভারতের। ভারতীয় বিমানবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের নানা বিমানঘাঁটি ছাড়াও একযোগে বিমান হামলা চালিয়ে বোমাবর্ষণে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর অকেজো করে দেয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিংয়ের ওপর পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণের প্রধান দায়িত্ব ছিল। তিনি ৮, ২৩ ও ৫৭ ডিভিশন নিয়ে আক্রমণ পরিকল্পনা করেন। ভারতের পশ্চিম সীমান্তেও যুদ্ধ পরিচালিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির চূড়ান্ত সাফল্যের পথ এভাবেই রচিত হয়েছিল।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

মুক্তিযুদ্ধ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম