Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

ওরা আমাদের বিজয় ছিনতাই করতে চাচ্ছে

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গত সোমবার ১৬ ডিসেম্বর আমরা বাংলাদেশে বিজয় দিবস পালন করেছি। এ দিবসটি আমাদের জন্য যুগপৎ আনন্দ ও বেদনার। দীর্ঘ ৯ মাস হানাদার বাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞের সঙ্গে অপরিসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। এ যুদ্ধে শত-সহস্র প্রাণ ঝরে গেছে। বয়ে গেছে রক্তের বন্যা। মা সন্তানকে হারিয়েছে, স্ত্রী স্বামীকে হারিয়েছে, ভাই বোনকে হারিয়েছে, বোন ভাইকে হারিয়েছে, বন্ধু বন্ধুকে হারিয়েছে, ছাত্র শিক্ষককে হারিয়েছে, শিক্ষক ছাত্রকে হারিয়েছে এবং যোদ্ধা সহযোদ্ধাকে হারিয়েছে। এমন হারানোর বেদনার সঙ্গে অন্য কোনো বেদনার তুলনা হয় কী? ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর এ দেশে হারানোর বেদনার একটি পর্বের অবসান হয়েছিল। সে জন্যই দিনটি ছিল আনন্দের। একে অপরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে সেই আনন্দকে উদযাপন করেছে।

১৬ ডিসেম্বর দিনটি ছিল গভীর বেদনার। এই দিনে আমরা ৯ মাসের প্রতিটি দিনে যা কিছু হারিয়েছি, তার হিসাব কষতে গিয়ে গভীরভাবে বেদনাপ্লুত হয়েছি। আমাদের বেদনা আরও তীব্র হয়, যখন আমরা জানতে পারলাম পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। এই বুদ্ধিজীবীদের অসামান্য অবদান ছিল। পঞ্চাশের দশক থেকে এ বুদ্ধিজীবীরা ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত সাহসিকতার সঙ্গে একটি বয়ান তৈরি করেছিলেন। এ বয়ানে বিবৃত হয়েছে পাকিস্তানের শাসকরা কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শাসন ও শোষণ করছে। তারা জানতেন তাদের এ প্রয়াস পাকিস্তানি শাসকরা ভালো চোখে দেখছে না। তা সত্ত্বেও তারা পিছপা হননি, থেমে যাননি কিংবা মাথা নোয়াননি। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য তারা এই পথে পা রাখেননি। শেষ পর্যন্ত এ মানুষগুলোর অনেককেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে! রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন/বক্ষে তার বেদনা অপার। এমন অনুভূতিই হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয়ের দিনে। সেদিন পাক হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৩টি বয়ান আছে। এ বয়ানগুলো যথাক্রমে পাকিস্তানি বয়ান, ভারতীয় বয়ান এবং বাংলাদেশি বয়ান। তবে এ বয়ানগুলোর মধ্যে কোন বয়ান আপেক্ষিকভাবে অধিকতর আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হয়েছে তা নির্ভর করেছে প্রচারের ব্যাপকতা এবং বয়ান উপস্থাপনায় সূক্ষ্মদর্শিতার ওপর। পাকিস্তানি বয়ানের মূল কথা হলো, শত্রুরাষ্ট্র ভারত পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ করেছে এবং পাকিস্তানের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে ঢাকায় আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে। ভারতীয় বয়ান হলো, ’৭১-এর ৯ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুর্দশা ও রক্তক্ষরণে সমব্যথী হয়ে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রাণপণ যুদ্ধ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের চরম লজ্জার সঙ্গে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশি বয়ানটি হলো, বাংলাদেশিদের জন্য ’৭১-এর যুদ্ধটি ছিল একটি জনযুদ্ধ। এ জনযুদ্ধে বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, বাঙালি সৈনিক ও বাঙালি পুলিশ অংশগ্রহণ করেছে। তারা দেশপ্রেম এবং জীবনবাজি রেখে প্রাণপণ যুদ্ধ করার ফলে দুর্ধর্ষ রক্তপিপাসু পাকিস্তানি বাহিনী ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হত্যার উৎস গুটিয়ে ফেলে রাজধানী ঢাকায় অবসন্ন ও আশাহীন হয়ে জমা হতে বাধ্য হয়েছে। ভারত অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এবং যুদ্ধোপকরণ জুগিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে। এই যুদ্ধে ভারতের সহায়তা সহায়ক ছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে নির্ধারক ছিল না। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যদি ভারতীয় সেনাদলকে পথ চিনিয়ে নিয়ে না আসত, তাহলে ভারতীয় বাহিনীর বড় বড় কথা বলার সুযোগ থাকত না। অবশ্য ভারতের সামরিক বাহিনীর কোনো কোনো অধিনায়ক যুক্তিসংগতভাবেই মুক্তিসেনাদের অবদানের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। শেষ বিচারে বাংলাদেশি লড়াকুরা তাদের বিজয় তাদের আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু সেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিসেনাদের কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল এমএ জি ওসমানী উপস্থিত হতে পারেননি। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারসহ বাংলাদেশ বাহিনীর মেজর কে এম শফিউল্লাহ ও মেজর হায়দার উপস্থিত থাকলেও সম্মানজনক কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেননি। ভারতীয় সেনা কমান্ডার সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল।

ঢাকায় সেদিন পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল যেদিন, সেদিন সিলেটের আকাশে জেনারেল ওসমানীকে বহন করা হেলিকপ্টারটি গুলিবিদ্ধ হয়। এ হেলিকপ্টারে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গী ছিলেন মেজর জেনারেল রব, ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও শেখ মুজিবুর রহমান তনয় শেখ কামাল। হেলিকপ্টারটির ওপর কোথা থেকে গুলি লেগেছিল, তা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ফলে হেলিকপ্টারটির তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে যায় এবং তেল ঝরতে থাকে। ফলে হেলিকপ্টারটি সিলেটের একটি গ্রামে জরুরি অবতরণে বাধ্য হয়। এ হেলিকপ্টারে যেভাবে আক্রমণ চালানো হয়, তা ছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মহিমা যাতে বাংলাদেশের জনগণ উপভোগ করতে না পারে, তার জন্যই একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে প্রতিবছর ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড ডে পালিত হয়ে আসছে। এবার অবশ্য এ উৎসবটি উদযাপনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে আখাউড়া সীমান্তে বাংলাদেশি সামরিক ও বিজিবি কর্মকর্তা ও ভারতের সামরিক বাহিনী ও বিএসএফ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি মিলন অনুষ্ঠান হয়েছে। তবে মিডিয়াতে এর চেয়ে বেশি কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ফোর্ট উইলিয়ামে পালিত ইস্টার্ন কমান্ড ডে ভারতের পক্ষ থেকে তাদের ইস্টার্ন কমান্ড ডে’র বিজয় দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতের এ আধিপত্যবাদী মনোভাবের কোনো প্রতিবাদ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হয়েছে বলে দেখা যায়নি। জানি না, এটা বাংলাদেশি শাসকগোষ্ঠীর হীনম্মন্যতা কিনা।

অতীতের সব ধরনের আধিপত্যবাদী আস্ফালনকে হার মানিয়ে বাংলাদেশের বিজয় দিবসে ফেসবুক ও এক্সে দেওয়া পোস্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুক্তিযুদ্ধকে উল্লেখ করেছেন ‘ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়’ বলে। নরেন্দ্র মোদি ওই পোস্টে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণকে ‘ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের জনগণ যেভাবে মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গ্লানিকর পরাজয়ের চূড়ান্ত নির্ধারক শর্ত তৈরি করেছিল, তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই মোদির পোস্টে। এটাকে কী বলা যায়? বাংলাদেশের প্রতিবেশী বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের অবহেলা এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য, নাকি আধিপত্যবাদী মনোভাবের নোংরা বহিঃপ্রকাশ? আমাদের দুর্ভাগ্য, বিশ্ববাসীরও দুর্ভাগ্য, ভারত কখনো ছোটলোকি মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এর কারণ নিহিত রয়েছে ভারত রাষ্ট্রটির চরিত্রে। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও এক্স হ্যান্ডলে নরেন্দ্র মোদি ১৬ ডিসেম্বর সোমবার লিখেছেন, ‘আজ বিজয় দিবসে ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রাখা সাহসী সেনাদের সাহস ও আত্মত্যাগকে আমরা সম্মান জানাই। তাদের নিঃস্বার্থ আত্মোৎসর্গ ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে রক্ষা করেছে এবং আমাদের গৌরব এনে দিয়েছে। এ দিনটি তাদের অসাধারণ বীরত্ব ও তাদের অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাদের আত্মত্যাগ চিরকাল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।’

ভারতের লোকসভায় একই দিনে বাংলাদেশ বিষয়ে বক্তব্য দেন কংগ্রেসের সংসদ-সদস্য প্রিয়াংকা গান্ধী। তিনিও ভারত বিজয় পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের আওয়াজ তখন কেউ শুনছিল না। ভারতের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ভারতের নেতৃত্ব ও সেনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে বিজয় অর্জিত হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে উল্লেখ করে ভারত সরকারকে আওয়াজ উঠাতে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলার আহ্বান জানান।

এসব মন্তব্য ও বক্তব্য শুনে কি মনে হয় না ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে চিন্তা-চেতনার মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই? একটিকে ছেড়ে অন্যটিকে আলিঙ্গন করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ উভয়কেই আলিঙ্গন করেছে এবং দেশের ও নিজের সর্বনাশ করেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ভারত ছিল এ বিজয়ের মিত্র, এর বেশি কিছু নয়। আসিফ নজরুল স্পষ্ট করেননি ভারত কেমন মিত্র ছিল, কী ছিল এর উদ্দেশ্য?

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম