তরুণদের রাজনৈতিক দল কি সফল হতে পারবে?
মোহাম্মদ আবদুল মাননান
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ক্ষমতাসীনদের অভিলাষ ও উদ্যোগে দুভাবে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘটনা এ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। প্রথমত, ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই একটি দল গঠনে মনোনিবেশ করেছিল। দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান অন্যান্য দলের লোক নিয়ে এবং সেই সঙ্গে একদমই রাজনীতিতে নতুনদের টেনেও দল গঠন করা হয়েছে।
ক্ষমতায় আসীন থেকে নিজেদের দুবার এ দেশে রাজনৈতিক দল গঠনের নজির আছে এবং এ বিষয়টি বহুলচর্চিত বটে। জিয়াউর রহমান যখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন-অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলেন আর তা মোটা দাগে তিন-চারটি কারণে। একটি হচ্ছে, পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন-উত্তর একটি রাজনৈতিক শূন্যতা। আওয়ামী লীগ ছিলই, কিন্তু দলটির প্রথম সারির বহুজন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল। বহু মানুষ তাদের প্রতি যেমন, তেমনি আওয়ামী লীগের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। রাজনীতির ময়দানে একটি নতুন দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জিয়াউর রহমান তাকে জুতসই কাজে লাগিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বহুজন একটি শক্তিধর রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিলেন, যারা ’৭১ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে হয় বিশেষ সুবিধা করতে পারছিল না কিংবা রাজনীতিসম্পৃক্তই ছিল না, অথচ রাজনীতি করার আগ্রহ ছিল। তৃতীয়ত, ’৭৫ ঘটনা-পরবর্তী একাধিক ছোট দলও জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দলে নিজেদের বিলীন করতে আগ্রহী ছিল। চতুর্থত, একটি নতুন দল গঠনে জিয়াউর রহমানের বিশেষ ধরনের কারিশমা ছিল; সেক্ষেত্রে ক্ষমতা একটি বড় নিয়ামক ছিল বটে। শেষত, আওয়ামী লীগবিরোধী জনগোষ্ঠী একটি আওয়ামীবিরোধী বড় দলের আকাঙ্ক্ষায় ছিল-আওয়ামী শাসন থেকে মুক্তির বাসনা ছিল তাদের।
ক্ষমতায় আসীন থেকে দ্বিতীয়বার নতুন দল গঠনের ঘটনা এরশাদের জমানায়। এরশাদের জমানা আরও লম্বা; কিন্তু জাপা গঠনকালটাও এরশাদের যুগ। একটি কারণেই এরশাদের দলটি সে সময়ে সাফল্য পেয়েছিল, এরশাদ ক্ষমতায় আর তখন তার দোর্দণ্ড প্রতাপ। জাপা গঠনকালে রাজনীতির মাঠে দল করার মতো কোনো শূন্যতা কিন্তু ছিল না। এরশাদ সাহেব কতবার মন্ত্রী বদল করেছেন, তা কেবল রেকর্ড দেখে বলতে হয়। এখনো অনেকের মৃত্যু সংবাদে লেখা হয় সাবেক মন্ত্রী। কেনাবেচার রাজনীতিতে এরশাদ সাহেব বিশেষ পারঙ্গম ছিলেন।
এ দুই ক্ষমতাসীনের দল গঠনের পার্থক্যটা দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে গেছে-জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার গঠিত দল কেবল দু’বার ক্ষমতায়ই যায়নি, বরং দলটির প্রাসঙ্গিকতা এ দেশের রাজনীতিতে শতভাগই থেকে গেছে; কখনো এক নম্বর দল, কখনো নিকটতম দ্বিতীয় দল। পক্ষান্তরে এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর দলটি রাষ্ট্রীয় মসনদে বসার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি-বরং সরকারি দলের সহযোগী হয়ে মুসলিম লীগের মতোই টিকে আছে। কতদিন থাকবে, সে কেবল সময়ই বলে দেবে। অন্যদিকে কথিত কিংস পার্টি আমাদের রাজনীতিতে বরাবরই গুরুত্বহীন ও অপাঙ্ক্তেয় এবং কতিপয় দলছুট মানুষের প্ল্যাটফর্ম, রাজনীতিতে তাদের সাফল্য শূন্যের ঘরে। সর্বদাই এরা ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছে। বলতেই হবে, এ কিংস পার্টি গঠনের উদ্যোগ বেশিরভাগ সময়েই নির্বাচনের প্রাক্কালে; যখন মূল রাজনৈতিক দলের কোনো কোনোটি নির্বাচন থেকে নিজেদের বিরত রাখে।
দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অরাজনৈতিক। উপদেষ্টাদের কেউই রাজনীতির মানুষ নন। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তথা সরকারের প্রধান একটি নতুন দল গঠন করবে, এমনটি এখনো মনে করার কারণ দেখা যায়নি। প্রাজ্ঞদের মতে, সেই সম্ভাবনা নেই। বাকি থাকে পরের অপশন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি একটি কিংস পার্টি বানাতে উদ্যোগী হবে? সে হিসাবও মিলছে না। এ সরকার বা তদ্বীয় উপদেষ্টারা একদিকে রাজনীতি করছেন না; ফলে সামনের জাতীয় নির্বাচনে জয়-পরাজয় এবং কে অংশ নেবে বা না নেবে, তা এ সরকারের এজেন্ডা নয়; বরং সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই তাদের লক্ষ্য। ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদে কিংস পার্টি গঠনের যেসব কারণ বিদ্যমান থাকে, তা আপাতত দেখা যায় না। যদিও ২০০৭ সালে একটি অরাজনৈতিক সরকারই কিংস পার্টি গঠনে ভূমিকা নিয়েছিল। তবে এখন জানা যায়, সেই সময়ের কেয়ারটেকার সরকার নয়, বরং সেনাবাহিনীর একাংশের মধ্যে এ বাসনা কাজ করেছিল। এ সরকারের যাবতীয় কিছুর বৈধতাপ্রাপ্তির লক্ষ্যে সরকারের কি পছন্দসই একটি দলের পরবর্তী সরকারে যাওয়া আবশ্যক? কিংবা সরকারে থাকা তিনজন উপদেষ্টার সঙ্গীদের রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার প্রয়াসে সরকার কি কোনো ভূমিকা গ্রহণ করবে? এ দুটি প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই তরুণদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে সরকারি ভূমিকা নির্ভর করছে। এখানে বলতেই হবে, এ দেশে কিংস পার্টি যেহেতু সরকারের ইচ্ছা আর উদ্যোগেই হয়েছিল, ফলে সরকারি যন্ত্রপাতিও ব্যবহৃত হয়েছিল। এ যন্ত্রপাতির একটির নাম সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এ রকমের কাজে সংশ্লিষ্ট থাকার নজির বেশি দেশে নেই।
তিনজন তরতাজা তরুণ উপদেষ্টার বন্ধু বা সহযোদ্ধারা একটি রাজনৈতিক বা অনুরূপ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুললে তাতে গোটা উপদেষ্টা পরিষদের নীরব সায় থাকলেও সেই প্ল্যাটফর্ম গঠনে সরকার সক্রিয় হবে কি? এ প্রশ্ন মাঠে আছেই। গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে নতুন দল গঠনের অভিযোগ ইতোমধ্যে বিএনপি থেকে উত্থাপিত হয়েছে। বাজারে এ কথাও ফেরি হচ্ছে যে, নতুন দল গোছাতে সময় দিতেই নির্বাচনকে বিলম্বিত করা হচ্ছে। তবে আপাতত এ রকমের কোনো নজির আমজনতার চোখে প্রতিভাত নয় বলেই এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ সীমিত। অন্যদিকে উপদেষ্টা পরিষদ কি অরাজনৈতিক সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা পেতে নির্দিষ্ট কোনো দলকে ক্ষমতায় বসাতে চায়? নির্বাচন ঘনিয়ে না এলে এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া দুরূহ বটে।
উপরের সব প্রশ্ন ছাপিয়ে আগস্ট-অভ্যুত্থানের তরুণ তুর্কিরা একটি দল গঠনের দিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। দিনে দিনে সেটির রূপ-রস-কাঠামো এবং প্রকৃতি বুঝতে সহজ হবে। অভ্যুত্থানের সমন্বয়করাই এ আয়োজনের নেতৃত্বে রয়েছেন এবং তাদের সবার কথার মধ্যে কম-বেশি অমিল যে নেই, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। ফলে, একটু সময় পেরোলেই নতুন দলটি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা মিলবে।
প্রশ্ন হতেই পারে, রাজনীতির ময়দানে এখন এমন কোনো শূন্যতা বিরাজ করছে কি, যাতে একটি নতুন দল গঠন (তা-ও আবার তরুণদের নেতৃত্বে) করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এবং দলটি বিএনপির মতো দীর্ঘ সময়ে টিকে যাবে? নাকি রণাঙ্গন কিছুটা অনুকূলে বলে একটি দলের আবির্ভাব, যা জাপার মতো কিছুকাল টিকে যাবে? কেউ কেউ মনে করেন, এ দুটির কোনো কারণই উপস্থিত নেই এবং কোনো কিছুকে ভরসা করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণরা নতুন দল করছে না। প্রথমত, প্রস্তাবিত তরুণদের দল গঠনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার নিশ্চয়তা এখনো স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ তাদের কৃত্যকাদির জন্য বেশ বিপাকে পড়লেও রাজনীতির পরিসর এমন নয় যে, একটি নতুন দল করা বাঞ্ছনীয়। তাহলে?
আমরা বয়স্করা যাই-ই ভাবি এবং মনে করি না কেন, তরুণদের ভাবনা-চিন্তা কিন্তু আলাদাই। ছাত্রদের কোটার আন্দোলন একদফায় মোড় নিয়েছিল বলেই স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে। একমাত্র ছাত্ররাই এ সাফল্যের দাবিদার নয়, ঠিক। বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত থাকলেও সাফল্য এসেছে ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন থেকে; অন্যরা অংশ নিয়েছিল। এ সময়ের তরুণদের রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ও সরকার কাঠামো নিয়ে আলাদা দর্শন আছেই আর এটাই ২০২৫ সালের রাজনীতি; সময়েরই দাবি। কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, সে বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগ-বামেরা অথবা অন্য কোনো দল, এ তরুণদের এবং তাদের চিন্তা-চেতনাকে স্পেস দিতে না পারলে নতুন দল হবেই-এ বাস্তবতাকে মান্যতা দিতে হবে; দিতে চাই। তবে এ দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা কাঠামোয় আগস্ট-অভ্যুত্থানের নায়কদের সৃষ্ট নতুন দলটি কতদূর যাবে কিংবা এ দেশের মানুষ-জনভোটার দলটিকে কীভাবে নেবে, সেটা শুধু আগামী দিনেই নির্ধারিত হবে। মনে রাখার দরকার আছে, এ দেশের একাধিক আন্দোলন তরুণরাই করেছিল, এসেছে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য, যদিও সেসবের নেতৃত্ব একচ্ছত্রভাবে তরুণদের হাতে ছিল না। আবার স্বাধীনতার পর এযাবৎকালের সরকারগুলোর নানা ব্যর্থতা আমাদের চোখের সামনে। তরুণরাও সেসব পাঠ করেছে। ফলে তরুণরাও দেখতে চায়; দেখুক। তরুণরা বরং পরীক্ষা দিক-এখনই তাদের পরীক্ষা দেওয়ার উপযুক্ত সময়। অপেক্ষা করে দেখতে চাই। তবে এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ হোক সম্পূর্ণ স্বনির্ভর; কোনো তরফের বিন্দুমাত্র পৃষ্ঠপোষকতা না থাকুক; তরুণদের দলে জায়গা না হোক পনেরো বছরের স্বৈরাচারের কোনো দোসরের।
মোহাম্মদ আবদুল মাননান : কথাসাহিত্যিক
