Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্বাধীনতার সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করতে হবে

Icon

আবু আহমেদ

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীনতার সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করতে হবে

ছবি: সংগৃহীত

আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির দিবস। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে এবং স্বৈরাচারী শোষণের জুলুম থেকে মুক্তির দিবস। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় চলে গেছে। অনেক চড়াই-উতরাই পার করেছে আমাদের দেশ। গত স্বাধীনতা এবং বর্তমান স্বাধীনতার অর্থনীতির মধ্যে একটু পার্থক্য তো রয়েছেই। আগের স্বাধীনতা দিবসগুলোয় বাংলাদেশকে যতটা উজ্জ্বল দেখাত, প্রকৃত অর্থে অতটা উজ্জ্বল ছিল না। কারণ, অর্থনীতি ব্যাপকভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে। দেশ-বিদেশে কর্মরত জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ পাচার হয়েছে। অর্থনীতিতে একটি অলিগার্ক শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যাদের কাছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৯০ শতাংশই কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তারাই আবার অর্থ পাচার করেছে। ব্যাংক লুট করেছে। এরা ছিল সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট। তাই এসব তারা করতে পেরেছে নির্দ্বিধায়। কোনো বড় ব্যবসা দাঁড়াতে পারেনি সরকারের আনুগত্য ও আশীর্বাদ ছাড়া। স্বাধীনভাবে কেউ ব্যবসা করতে পারেনি। যেহেতু সরকার ছিল বিনা ভোটের সরকার, জনগণের ম্যান্ডেট ছিল না ওই সরকারের প্রতি। যারা সুবিধাভোগী এবং যারা অন্ধ সমর্থন করত সরকারকে, তারাই সুবিধা পেয়েছে তাদের কাছ থেকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ শোষিত ও নির্যাতিত হয়েছে। এটা আমাদের বুঝতে হবে।

যে প্রবৃদ্ধি হারের কথা বলা হয়েছে, সেটা ছিল অনেকটা ফেইক। ৭.৫ বা ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারের কথা যেটা বলা হয়েছে, ওটা আসলে বানানো হয়েছে অনেকটা। বরং প্রবৃদ্ধি হার এ থেকে অনেক কমই ছিল। এমনকি ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের যে জিডিপির আকারের কথা স্বৈরাচার সরকারের শেষ সময়ে বলা হচ্ছিল, সেটাও ছিল অনেকটা ফেইক। এখন তো বলা হচ্ছে, জিডিপির সাইজ অতটা কখনোই ছিল না। এই যে মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয়েছে, সেটা তো ওই সময় থেকেই শুরু হয়েছে। শেয়ারবাজারের পতন যে শুরু হয়েছিল, সেটা ওই সময়ই শুরু হয়েছিল। যে সরকার বিদায় নিয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে, সেই সরকারের শেষের দুই বছরে রিজার্ভ দ্রুত নিচের দিকে নেমেছে। এটা প্রায় ১৫ বা ১৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে এসেছিল।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫ আগস্টের পরপর অর্থনীতির পরিসংখ্যানগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আদানি গ্রুপের বহু টাকা, প্রায় ১ বিলিয়ন টাকার পেমেন্ট বাকি ছিল। বিদেশি এয়ারলাইন্সের পেমেন্টের টাকা বাকি ছিল। শেভরনের পাওনা টাকা বাকি ছিল। ৫ আগস্টের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন যে সরকার এসেছে, তাদেরকে এর সবকিছুই পরিশোধ করেতে হয়েছে গত ৭-৮ মাসে। আদানি গ্রুপের লম্ফঝম্ফ শেষ এবং তারা স্বস্তির সঙ্গে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিয়ে যাচ্ছে, যেটা তারা একসময় বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। আদানির টাকার জন্য আমেরিকাও খুব উদ্বিগ্ন ছিল। বিদেশ থেকে ডেলিগেশন আসছিল শুধু শেভরনের টাকা কেন বাকি থাকছে এবং আদৌ বাংলাদেশ সে টাকা পরিশোধ করতে পারবে কি না, তা দেখতে। এগুলো তাদের দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল।

এসব দুশ্চিন্তা এখন কেটে গেছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে এখন ২১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। টাকার মূল্যমান ওই যে ধপাস করে পড়া শুরু হয়েছিল, সেটা তো জোর করে ধরে রাখা হয়েছিল কিছুদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। এটা এখন ১২০-১২২ টাকার মধ্যেই আছে। বহুদিন ধরে সেটা আছে। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। এই যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়া এবং চলতি হিসাব আমাদের পক্ষে আসা, এটা খুবই আশাব্যঞ্জক। আমাদের আমদানি বাড়ছে। আমদানি বৃদ্ধি খারাপ নয়। আমদানি কখন বাড়ে, যখন পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকে। আমাদের তা পরিশোধ করার সক্ষমতা আছে বলেই আমদানি বাড়ছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক, মূল্যস্ফীতি খুব যে কমেছে তা নয়, তবে এ রমজানের মধ্যে মানুষ অনেকটা স্বস্তিতে ছিল বলা যায়। পণ্যের দাম কোনোটাই বাড়েনি, বরং কমেছে। শীতের শাকসবজি অনেক কম দামে অনেক লম্বা সময় পাওয়া গেছে। টমেটো ও আলুর দাম অনেক কমে গেছে।

স্বৈরাচারী সরকারের আমলে, বিশেষ করে শেষের ৩ বছরে ব্যাপকভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে বলে আমাদের চারদিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল। বিদেশি ঋণের পাহাড় রেখে গেছে ওই সরকার। এর একটা বিশাল অঙ্ক বিদেশে পাচার হয়েছে। ব্যাংক খাতের কথা ধরা যাক। এটা কি কেউ বিশ্বাস করবে যে, সরকারের উচ্চমহলের আনুকূল্য ছাড়া এতগুলো ব্যাংক একটা হাতে যেতে পারে? ইসলামী ব্যাংকের দোষ কী ছিল? এটা ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টরের পথিকৃৎ ছিল। ইসলামী ব্যাংকের যে ডিপোজিট গ্রোথ, সেটা অন্য সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। ওটা তো আস্থার জন্য হয়েছে। মানুষ আস্থা পেয়েছিল বলেই সেখানে আমানত রেখেছে। ব্যাংকটির জন্য সেটাই কাল হয়ে গেল-সরকার ভাবল, ওখানে এত রিসোর্স কেন থাকবে! এটা এত ভালো কেন করে! সেজন্য ওটাকে দখল করে নিল সরকার। এর পরেরগুলো যেমন-ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, এসআইবিএল-এগুলো তো ভালোই যাত্রা শুরু করেছিল। পরে কেন ধস নামল? লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় সবগুলো থেকে ফেইক কোম্পানিকে লোন দেওয়া হয়েছে। তারা বোর্ড কন্ট্রোল করত, ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল করত। বোর্ড কন্ট্রোল, ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল করে আবার ফেইক কোম্পানি সৃষ্টি করে তারা এসব ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে নতুন করে বোর্ড গঠন হয়েছে। এগুলো থেকে অন্তত লুণ্ঠন তো বন্ধ হয়েছে।

ব্যাংক থেকে জনগণের আস্থা হারিয়ে গিয়েছিল। পুরো ব্যাংকিং সেক্টরের ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমটাকে কিছু লোকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল এবং জনগণের আস্থার ওপর প্রচণ্ডভাবে আঘাত করা হয়েছিল। আজ যে ক্লাসিফায়েড লোন, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, যার ক্লাসিফায়েড লোন বেশি, তাকে ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না, এটা বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক কাজ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলো অনুমতি নিয়ে মালিকদের জন্য কিছু ডিভিডেন্ডের ব্যবস্থা করত। সেটা এখন বন্ধ করে ভালোই হয়েছে। এতে ভালো ব্যাংকগুলো ভালো ডিভিডেন্ড দিতে পারবে।

সবকিছু মিলিয়ে আমাদের অর্থনীতি নিয়ে এ স্বাধীনতা দিবসে এসে হতাশার কোনো কারণ দেখছি না। এখন ব্যবসায়ীরাও তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে ধীরে ধীরে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের কাছাকাছি আসার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সেখানে ব্যবসায়ীরা তাদের মনের কথা খুলে বলতে পরবেন, আশা করি। সিস্টেমে কিছু দুর্বলতা থাকতে পারে। সেটাকেও দেখা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ওই যে আগের মতো তোষামোদ করা, ঘুস দেওয়া, সরকারের উচ্চমহলের আনুগত্য ছাড়া ব্যবসা করতে না পারা ইত্যাদি কালচার এখন আর নেই। সেগুলো থেকে আমরা অনেকটা দূরে সরে আসতে পেরেছি। সুতরাং আমাদের অর্থনীতির বিষয়ে আমি আশাবাদী। রাজনৈতিকভাবে যদি আমরা একটা ডিসিপ্লিনের দিকে যেতে পারি, তহলে আরও ভালো করবে আমাদের অর্থনীতি।

এই স্বাধীনতা দিবসকে আমরা স্বাগত জানাই। এ স্বাধীনতার জন্য যারা ’৭১-এ এবং জুলাই-আগস্টে শহিদ হয়েছেন, আমি তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি। যারা হাসপাতালে আছেন, তাদের চিকিৎসার জন্য সরকার সবকিছু করছে, আরও করুক, এটাই আমাদের কামনা। ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের মূল চেতনাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, জবাবদিহিতা, ভোটাধিকার, মোট কথা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হতে হবে। যেমন, ভারতীয় অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে আমাদের স্বাধীন থাকতে হবে। আমাদের বিজয় তো ’৭১ সালে হয়েই গেছে। গত ১৫ বছরে যেটা হয়েছে সেটা হলো, ভারত একতরফাভাবে আমাদের থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে এবং ওই সুবিধা দিয়েছে স্বৈরাচারী সরকার। ভারতকে অতটা দোষ দিই না। দোষ দিতে হবে ওই সময়ের সরকারকেই। ওই সরকার মনে করেছে যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র যতদিন তাদের সমর্থন করবে, ততদিন তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে। পরে যেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যাহোক, এই স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার হলো, জুলাই-আগস্টের সংগ্রামী চেতনাকে আমাদের বুকে ধারণ করা এবং আমাদের দেশকে ভালোবাসা। (অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)

আবু আহমেদ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম