বিরাজনীতিকরণের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?
সাঈদ খান
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা রাষ্ট্রবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী। রাজনীতি ছাড়া গণতন্ত্র হয় না, গণতন্ত্র ছাড়া জনগণের মুক্তি অসম্ভব। তাই রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনুন-জনতার পক্ষে, মুক্তির লক্ষ্যে। রাজনীতি হোক জনগণের, দেশের ও ভবিষ্যতের। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নির্বাচন, যা জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে। নির্বাচন ব্যতীত কোনো সরকার জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হতে পারে না। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন না হলে তা অবৈধ শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারে-যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এখন একটি অপাঙ্ক্তেয় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, যার প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে পড়েছে। অপরদিকে, বিএনপিকে পরিকল্পিতভাবে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ দুই দলের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, তারা অনেকেই সাহসী কণ্ঠস্বর হলেও তাদের সাংগঠনিক শক্তি ও জনসম্পৃক্ততা দুর্বল। তারা এখনো দেশের নেতৃত্ব গ্রহণের মতো সক্ষমতা তৈরি করতে পারেনি।
দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া মানে গণতন্ত্রকে কফিনে বন্দি করা। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, টেলিভিশনের টকশো কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম-রাজনীতিকে ঘৃণার, অবজ্ঞার ও বিদ্বেষের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। অথচ এদেশের রাজনীতি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চালিকাশক্তি, গণতান্ত্রিক চেতনার অভিভাবক, জনগণের অধিকার আদায়ের প্রধান হাতিয়ার।
বিএনপির রাজনীতির লক্ষ্য শুধু ক্ষমতায় যাওয়া নয়, বরং এমন একটি দেশ গড়া, যেখানে সবার জন্য সমান অধিকার থাকবে। তরুণ ও যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, নারীদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সবাইকে সমান রাষ্ট্রীয় অধিকার দেওয়া বিএনপির অন্যতম লক্ষ্য। বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের মূল ভিত্তি হলো গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং আর্থ-সামাজিক মুক্তি। বিএনপি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, রাজনীতি জনগণের জন্য, তাদের স্বার্থে এবং কল্যাণে পরিচালিত হওয়া উচিত। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক এবং সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তিনি বিভাজনের রাজনীতির পরিবর্তে ঐক্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিকে তার দর্শন হিসাবে গ্রহণ করে তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। তার যোগ্য উত্তরসূরি তারেক রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি যুক্ত করে ‘সবার বাংলাদেশ’ নির্মাণের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। দলটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মানবাধিকার রক্ষা এবং বহু সমস্যার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করেছে। বড় দল হিসাবে তার কিছু ত্রুটি থাকলেও সেগুলোর সংশোধনে দলটি আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, এখন আরও পরিণত ও দায়িত্বশীল পথে অগ্রসর হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই।
গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সবচেয়ে দৃঢ় ও কার্যকর অবস্থান বিএনপির। বাস্তবতা বুঝে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার সঠিক বাস্তবায়নে দলটি যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছে, তা অন্য কোনো দল এখনো দেখাতে পারেনি। এ কারণে অনেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে টার্গেট করে নেতিবাচক প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছে-চলছে মিডিয়া ট্রায়াল, সামাজিক বুলিং ও অপপ্রচার। পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন, নেতাকর্মীদের দুর্নাম এবং সর্বত্র এক ধরনের বিদ্বেষমূলক প্রচার চালিয়ে রাজনীতি বাইরে রাখার চেষ্টা চলছে। মতভেদ থাকতেই পারে, সমালোচনাও গণতন্ত্রের অংশ। কিন্তু কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে পরিকল্পিতভাবে হেয় করা কিংবা দেশের রাজনীতিকে নেতিবাচক পথে ঠেলে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের প্রতি জনগণের একাংশের অবিশ্বাস বা বিতৃষ্ণা তৈরি করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এ যেন রাজনীতিকে গালি বানানোর মতো একটি প্রক্রিয়া-‘জনগণ বিরক্ত’, ‘সব রাজনৈতিক দল এক’, ‘নেতা মানেই দুর্নীতিবাজ’ ইত্যাদি মোহাচ্ছন্ন স্লোগান ব্যবহার হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই-মানুষকে রাজনীতিতে আগ্রহহীন ও নেতিবাচক করে তোলা, যাতে গণতন্ত্র নামমাত্র থেকে যায়। এ প্রক্রিয়ার প্রধান চালিকাশক্তি হলো কিছু মিডিয়া, এনজিও, করপোরেট-বন্ধুসুলভ সুশীলসমাজ এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চক্র। তারা জনগণের চোখে রাজনীতিকে ‘অশুভ শক্তি’ বানিয়ে উপস্থাপন করে। তারা রাজনীতিকদের ‘দাগি’, ‘লুটেরা’ হিসাবে আখ্যায়িত করে; কিন্তু যেসব অনির্বাচিত সুবিধাভোগী রয়ে যান, তারা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।
সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার একটি ভয়াবহ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এ প্রবণতা আসলে হঠাৎ জন্ম নেয়নি-এটি বহুদিনের চর্চিত একটি চক্রান্ত, যার শিকড় ব্যবসায়ীদের পুঁজিবাদী দর্শনের রাজনীতির ভেতরে প্রোথিত। উদ্দেশ্য একটাই-পুঁজির স্বার্থরক্ষা করা, আর সেজন্য দরকার জনগণকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা তাদের স্বার্থরক্ষায় এমন একটি সমাজ কাঠামো গড়তে চায়, যেখানে জনগণ কখনো রাজনীতিসচেতন হয়ে উঠবে না; বরং রাজনীতিকে ঘৃণার বস্তু হিসাবে দেখবে। কারণ, রাজনীতিসচেতন জনগণ দাবি তোলে-ন্যায্য মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা, দুর্নীতির জবাবদিহি, সম্পদের সুষম বণ্টন ইত্যাদির। আর এগুলোই স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তাই শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম, এনজিও, সুশীলসমাজের ছদ্মবেশে দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি ‘অরাজনৈতিক চেতনা’ গড়ে তোলা হয়েছে, যা রাজনীতিকে ঘৃণার বস্তু হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি স্কুল পর্যায়েও রাজনীতিকে ঘৃণার বিষয় হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। ছাত্ররা যাতে রাজনৈতিক আলোচনায় না আসে, মত প্রকাশ না করে, সংগঠিত না হয়-এ উদ্দেশ্যেই পাঠ্যবই থেকে ইতিহাস ও রাজনৈতিক শিক্ষার জায়গা সংকুচিত করা হয়েছে। মিডিয়াতে ছাত্ররাজনীতির শুধু নেতিবাচক দিকগুলোই ফলাও করে তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রথম শ্রেণির কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এমন একটি ‘অরাজনৈতিক আধুনিকতা’ সৃষ্টি করেছে, যা রাজনীতিকে এড়িয়ে চলাকেই ‘ভদ্রতা’ মনে করে।
সুশীলসমাজ ও এনজিওদের একাংশ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক সচেতনতার পরিবর্তে ‘সুশাসন’ ও ‘উন্নয়ন’-এর মোড়কে একটি ‘রাজনৈতিক নির্বাক সমাজ’ গঠনের কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৭ সালের ১/১১ সরকারের সময়ে এ প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করে। তখন ‘রাজনীতিমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ চালু করে ‘দুই নেত্রীকে মাইনাস তত্ত্ব’ দিয়ে রাজনীতির মূলধারাকে কলুষিত ও দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়। সেনাসমর্থিত সেই সরকার এনজিও, মিডিয়া ও সুশীলসমাজকে পাশে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভ্রান্ত করে তোলে। এরপর দীর্ঘদিন এর রেশ থেকে যায়; যা এখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
দেশের প্রধান কিছু মিডিয়া বিরাজনীতিকরণের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। তারা রাজনীতিকে ‘হাস্যকর’ বানায়, প্রকৃত রাজনীতিকদের মঞ্চ থেকে সরিয়ে তথাকথিত ‘বিশেষজ্ঞ’ দিয়ে জাতীয় প্রশ্নের জবাব খোঁজে। এনজিওদের একাংশ রাজনীতি না করে ‘উন্নয়ন’ করার নামে একটি তথাকথিত নিরপেক্ষ বৃত্ত গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন মহল থেকে ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’র নামে জনগণকে রাজনীতির বাইরের অন্যকিছুতে মনোনিবেশ করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে-যেমন প্রযুক্তি, ফ্রিল্যান্সিং, ব্যবসা বা বিনোদন। অথচ জনগণের জীবনের মৌলিক প্রশ্ন-ভোটাধিকার, মত প্রকাশ, আইনের শাসন, দুর্নীতি, মানবাধিকার-এসবই মূলত রাজনৈতিক, যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য বিষয়।
বৈশ্বিক পরাশক্তিরাও চায় একটি ‘পরনির্ভরশীল’ বাংলাদেশ-যেখানে গণতন্ত্র থাকবে কাগজে-কলমে, কিন্তু নীতিনির্ধারণ হবে কিছু গোষ্ঠীর ইচ্ছামতো। এজন্য তারা রাজনীতিকে দুর্বল রাখে, নেতৃত্বহীন সমাজ চায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা একদলীয় শাসনের সুযোগে তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত স্বার্থে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। একটি দুর্বল গণতন্ত্র ও দুর্বল বিরোধী দল মানে, বিদেশি সিদ্ধান্ত ও প্রভাব সহজে কার্যকর করা সম্ভব।
বাংলাদেশের ১৯৭২ থেকে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক ইতিহাস শুধু উত্থান-পতনের গল্প নয়, বরং এটি সংগ্রাম, প্রত্যাশা এবং শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য কাহিনি। এ দীর্ঘ যাত্রাপথ একদিকে যেমন উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাক্ষী, অন্যদিকে তেমনি ভুলের মিশেলে জর্জরিত রাজনীতি। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বারবার গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ এক ধারাবাহিক চক্র, যা কখনোই থামছে না, তবুও এ জাতি প্রতিটি সংকট মোকাবিলা করতে করতে এগিয়ে চলেছে।
জাতীয় নির্বাচনের তারিখ দ্রুত ঘোষণা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সময়মতো নির্বাচন, যা জনগণের মতামত প্রতিফলিত করে। জাতীয় নির্বাচন কেবল ভোটগ্রহণ নয়, এটি জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের সুযোগ এবং গণতন্ত্রে জনগণের আস্থা পুনর্বহাল করবে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের উচিত দায়িত্বশীলভাবে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত-এখন প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ। নির্বাচনের বিকল্প নেই, এটি অবশ্যই জরুরি। যেখানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং গণতন্ত্রই শেষ কথা।
সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে
