শতফুল ফুটতে দাও
নব আয়োজনে পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা অমর হোক
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রফেসর শামসুল হক যখন জীবিত ছিলেন, তখন তার ইস্কাটনের বাসভবনে এক সন্ধ্যায় দীর্ঘক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এ মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, মিষ্টভাষী। কর্মজীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা বিভাগে মধ্যস্থানীয় কর্মকর্তা হিসাবে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। তিনি স্কুল শিক্ষা পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো এলাকায় স্কুল পরিদর্শনে গেলে তাকে সেখানে এক রাত বা দুরাত কাটাতে হতো। কিন্তু তিনি কখনো কারও বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেননি। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন তার রান্নার বাস্কেট। এতে দু-একটি হাঁড়ি-পাতিল, খাবার প্লেট ও পানির গ্লাস থাকত। আরও থাকত একটি স্টোভ। তিনি খাদ্য হিসাবে সঙ্গে নিতেন গোল আলু, ডিম ও একটু লবণ। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে সিদ্ধ ডিম সহযোগে আহার সেরে নিতেন। এ ছিল তার সততার পরাকাষ্ঠা। কর্মজীবনে তিনি আরও ছিলেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষা বিভাগের ডিপিআই (Director of public instruction), বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী। তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই সে দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষা, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থও রচনা করেছেন।
এবার আসা যাক আমার সঙ্গে তার কী আলাপ হয়েছিল সেই প্রসঙ্গে। আমি তাকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। জবাবে তিনি বললেন, ভারত সফরকালে তার সঙ্গে তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কথা হয়েছিল। এক অনানুষ্ঠানিক আলাপে প্রফেসর শামসুল হক অটল বিহারী বাজপেয়ীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অখণ্ড ভারতের ধারণা সম্পর্কে তিনি কী মত পোষণ করেন।’ জবাবে বাজপেয়ী হেসে বলেছিলেন, অখণ্ড ভারতের ধারণা অবাস্তব, একমাত্র অর্বাচীনরাই এমন ধারণা পোষণ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটু যোগ করা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের এক সময়কার মার্কসবাদী কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কখনো কি যুক্তবঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হবে? জবাবে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, আমাদের জীবদ্দশায় তো নয়ই, আগামী পাঁচশ বছরের মধ্যেও নয়। জ্যোতি বসুর এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক ভোরের কাগজে। সেসময় ভোরের কাগজের সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন বর্তমানের প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
মনে রাখা উচিত, অটল বিহারী বাজপেয়ী সমসাময়িক ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপিপন্থিদের উত্তরসূরি। বাজপেয়ী একজন কবি ছিলেন। কবি হওয়ার ফলে তার সুকুমারবৃত্তি অত্যন্ত উন্নতমানের ছিল। তারই সময়ের ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোরারজি দেশাই। তার একটি অদ্ভুত অভ্যাস সম্পর্কে নানা রকমের গাল-গল্প হয়। এ দেশাইকে পাকিস্তান সরকার সর্বোচ্চ বেসরকারি পদক ‘নিশানে হায়দার’ উপাধি দিয়েছিল। মোরারজি দেশাইকে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ জানিয়েছিল, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার একটি পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। এ পরিকল্পনার সূচনা হয় এর আগে যখন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ খবরটি বের হয়েছিল ভারতের একটি বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিকীতে। মোরারজি দেশাই ‘র’-এর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ কথা শুনে তাজ্জব বনে যান! কী কথা! প্রতিবেশী দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করতে চায় তার নিজের দেশেরই একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ‘র’কে এই পরিকল্পনা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার আদেশ দেন। দেশাইয়ের পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদ অলংকৃত করেন। জিয়া হত্যা পরিকল্পনা পুনরুজ্জীবিত করে এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে প্রেসিডেন্ট জিয়া কতিপয় বিপথগামী সামরিক অফিসারের এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হন।
কথা বলছিলাম অখণ্ড ভারত প্রসঙ্গে। পাকিস্তানি নেতারা অনেক সময় বলেছেন, India has not reconciled to the idea of partition of India. অতি সাম্প্রতিককালে ভারতীয় নেতারা, বিশেষ করে বিজেপিওয়ালারা অখণ্ড ভারত পুনরুদ্ধারের কথা বলে চলেছেন। তাদের দৃষ্টিতে মুসলমানদের ভারতে থাকার অধিকার নেই। মুসলমানরা আজ ভারতের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছে। গো-মাংস ভক্ষণের অভিযোগে তাদেরকে মেরেপিটে তক্তা করে ফেলা হচ্ছে, এমনকি হত্যা করা হচ্ছে। গো-মূত্র পানে বাধ্য করা হচ্ছে। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি উচ্চারণে মুসলমানদের বাধ্য করা হচ্ছে। অনেক মসজিদ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে। শতাব্দীপ্রাচীন ওয়াক্ফ আইন পরির্বতন করা হয়েছে। এককথায়, ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। এসব নিপীড়ন হলো অখণ্ড ভারতের পথে মুসলিম নিপীড়নের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া। অখণ্ড ভারতের ধারণাটি খুব নতুন নয়। ভারতের অন্যতম নেতা ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তার ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে কালচারাল ইন্ডিয়ার বক্তব্য হাজির করেছেন। এ কালচারাল ইন্ডিয়া মধ্য এশিয়া থেকে আফগানিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া হয়ে ইন্দোচীন অর্থাৎ থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্রমান্বয়ে এ কালচারাল ইন্ডিয়া সুদূর ফিজি, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার গায়েনা পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। দুনিয়ার দেশে দেশে প্রবাসী ভারতীয়রা ডায়াসপোরা হয়ে ভারতীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারে সক্রিয় হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, হিন্দু অধ্যুষিত ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ভারতীয় পতাকার মাঝখানে রয়েছে বৌদ্ধদের প্রতীক অশোক চক্র। কেন ভারতের জাতীয় পতাকায় অশোক চক্র স্থান করে দেওয়া হলো। এর একটি শক্তিশালী ব্যাখ্যা হলো, বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোকে ভারতীয় ছাতার নিচে আহ্বান জানানো এবং ভারতের প্রতি আকৃষ্ট হতে প্রণোদিত করা।
বাংলাদেশে একশ্রেণির সংস্কৃতিসেবী বেশ ক’বছর ধরে নববর্ষের দিনে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে চলেছে। তাদের বক্তব্য হলো, নতুন বছরে মঙ্গল বয়ে আনার আকাঙ্ক্ষায় তারা মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করছে। তাদের আপ্তবাক্য শুনে মুগ্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ শ্রেণির লোকরা বাংলাদেশের মানুষকে বিজ্ঞানী পাভলোভের এক্সপেরিমেন্টে ব্যবহৃত কুকুরের মতো করে তুলতে চায়। পাভলোভের এক্সপেরিমেন্টে দেখা যায়, কুকুরের সামনে পশুর গোস্ত দিলে কুকুরের জিহ্বা থেকে লালা ঝরতে থাকে। তারপর সে গোস্তের সঙ্গে কলিংবেল বাজালেও কুকুরের লালা ঝরতে থাকে। তৃতীয় ধাপে শুধু কলিংবেল বাজালে এবং কোনো ধরনের গোস্ত না দিলেও কুকুরের লালা ঝরতে থাকে। একেই জীববিজ্ঞানে বলা হয় Conditioned reflex. অর্থাৎ একটি প্রাণীকে সুনির্দিষ্ট আচরণে ধাতস্ত করে তোলা।
নববর্ষের শোভাযাত্রা যখন প্রথম শুরু করা হয়, তখন এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। এক দল বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লোক এ শোভাযাত্রার অনুষ্ঠানে অনুপ্রবেশ করে এবং শোভাযাত্রাটির নাম পরিবর্তন করে নাম দেওয়া হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ‘মঙ্গল’, ‘মাঙ্গলিক’ শব্দগুলো বিশেষ বোধমুক্ত নয়। এরপর শুরু হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে শোভাযাত্রার পুরোভাগে এমন সব মোটিভ বিশাল আকারে তুলে ধরা, যা পৌত্তলিক ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে সাঝুজ্যপূর্ণ। কিন্তু তা হলে কি হবে? এই শোভাযাত্রায় ঢোল, ডগর ও বাদ্যের তালে তালে আত্মভোলা যেসব মানুষ অংশগ্রহণ করে, তারা মনের অজান্তে একশ্রেণির কুশীলবদের ইচ্ছার অধীনে চলে যায়। তারা তাদের নিজস্ব চৈতন্যের জগৎ থেকে হেলুসিনেশনের জগতে প্রবিষ্ট হয়। পাভলোভ যেভাবে তার কুকুরকে মোহাবিষ্ট করেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষদেরও পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে এবং এতে ব্যবহৃত পৌত্তলিকতার মোটিভ দিয়ে মোহাবিষ্ট করে তোলা হচ্ছিল। এ মোহাবিষ্টকরণ সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অখণ্ড ভারতীয়করণের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর অখণ্ড ভারতপন্থিরা বিশাল চপেটাঘাত পেয়েছে। এবারের ১ বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রা তারই দৃষ্টান্ত। ১ বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। এটাকে আমরা বর্জন করব না কোনোমতেই। কিন্তু আমরা চাই, সত্যিকার অর্থে এ দিবসটি আমাদের সব মানুষের প্রাণের উৎসবে পরিণত হোক।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

