ক্রমেই মসৃণ হচ্ছে আগামীর পথ
এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি রাজনৈতিক দল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেটি ছিল ২০০৭ সালের ঘটনা। দেশে তখন চলছিল ওয়ান-ইলেভেন সরকারের শাসন। প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দলটির নাম ছিল নাগরিক শক্তি। কিন্তু বেশি দূর তিনি এগোতে পারেননি। কারণ সে সময় জনগণ যেমন ড. ইউনূসকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি; তেমনই প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কায়েমে স্বার্থবাদীরাও তাকে গ্রহণ করতে চাননি।
তখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রফেসর ইউনূসের দল গঠনের পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ ছিলেন। সে সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্স আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিল, ‘রাজনীতিতে যারা নতুন আসে, তারা ভয়ংকর হয়। তাদের তৎপরতা সন্দেহ করার মতো। তারা জাতির ভালো করার চেয়ে আরও বেশি খারাপ করে।’
এসব ছাড়াও বিভিন্ন মহল থেকে তাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছিল; কিন্তু তাতেও তিনি পিছপা হননি। মূলত সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে যে ধরনের সাড়া পাওয়ার প্রত্যাশা তিনি করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি তা পাননি। এসব বিবেচনা করে শেষমেশ সবকিছু ছেড়ে তিনি তার নিজস্ব চিন্তা ও মননের জগতে ফিরে যান। তারপর ঘুরে বেড়ান বিশ্বময়। পৃথিবীর নানা দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভাষণ দিয়ে উজ্জীবিত করেছেন তরুণ ছাত্রদের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানকে দিয়েছেন ক্ষুদ্র ঋণ সম্পর্কে পরামর্শ। আর এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অবিরাম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে বেড়িয়েছে। মামলার পর মামলা দিয়ে তাকে নিদারুণ এক কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল, তাকে জেলের ভাত খাওয়াবে।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যে শেখ হাসিনা একদিন ক্ষমতার মদমত্ততায় বিভোর হয়ে ড. ইউনূসকে জেলে পুরতে চেয়েছিলেন; তিনি আজ জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন সেই ক্ষমতার মসনদে বসে আছেন প্রফেসর ড. ইউনূস। যাকে একদিন শেখ হাসিনা ভয়ংকর ভেবেছিলেন, যাকে একদিন রাজনীতিবিদরা মেনে নিতে পারছিলেন না, যাকে একদিন জনগণও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি, সেই তিনি ড. ইউনূস এখন জনগণের নয়নের মণি। ক্ষমতায় বসে তার জননন্দিত হওয়ার গল্পটা বেশ চমৎকার। যেন এলেন, দেখলেন, জয় করে নিলেন। তিনি গত আট মাসে শব্দের ঝংকার দিয়ে মানুষকে বিমোহিত করার চেষ্টা করেননি। কিংবা তিনি স্লোগান ও কথামালার রাজনীতির চিরাচরিত পথেও হাঁটেননি ।
প্রফেসর ইউনূসের কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, চিন্তা, উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নের দৃঢ়তা। সাধারণত রাজনীতিবিদরা জনগণকে অকল্পনীয় স্বপ্ন দেখাতে পছন্দ করেন; কিন্তু ক্ষমতায় গেলে বাস্তবায়নের পথে খুব কমই হাঁটেন। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস শুধু স্বপ্ন দেখানো ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস। কিন্তু প্রফেসর ইউনূস রূপকথার গল্পের মতো স্বপ্নচারী না হয়ে স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটি খুবই ইতিবাচক একটা দিক। আগামীতে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারাও এ ধারার বাইরে যেতে পারবেন না।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ক্ষমতায় থেকে নন্দিত হওয়ার ঘটনা খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় এসে অল্পদিনের মধ্যেই নিন্দিত হয়ে পড়েন এবং কখনো কখনো গণ-অভ্যুত্থানে উৎখাত হন কিংবা অন্য ঘটনায়। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্ষমতায় থেকে একজন সামরিক শাসকের জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠার গল্পটাও কম চমকপ্রদ নয়। তিনি হচ্ছেন শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তুলনাহীন সততা, নিষ্ঠা, দূরদর্শিতা দিয়ে তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে তুলেছিলেন। এখন আমরা আরেকজন রাষ্ট্রনায়ককে দেখতে পাচ্ছি, যিনি রাজনীতির ধারে-কাছেই ছিলেন না কখনো। তিনি হচ্ছেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঠিক ঠিক জিয়াউর রহমানের মতোই তিনি ক্ষমতায় থেকে খুব দ্রুতই জননন্দিত হয়ে উঠেছেন।
এ প্রসঙ্গে পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে দুজন নেতা নিজ নিজ দেশের উন্নতি ঘটিয়ে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। তারা উভয়েই ক্ষমতায় থেকেই এ বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাদের একজন হচ্ছেন, মালয়েশিয়ার ডাক্তার মাহাথির মোহাম্মদ, অন্যজন সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ। এ দুজনের দৃষ্টান্ত থেকে এটি প্রমাণিত হয়, একজন নেতাই পারেন দেশের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে। অর্থাৎ একজন নেতার ব্যক্তিত্ব, সততা, চিন্তাশক্তি, দূরদর্শিতা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দৃঢ়তা একটি দেশকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে পারে। প্রফেসর ড. ইউনূস ঠিক সে ধরনেরই একজন নেতা, যাকে মানুষ বিশ্বাস করতে পারে। তিনি তার দূরদর্শিতা শেয়ার করে বিশ্বের নানা দেশের সরকারপ্রধানকে উপকৃত করেছেন; কিন্তু নিজ দেশে তা কখনো পারেননি। এখন সেই সুযোগ তিনি পেয়েছেন। সুতরাং তাকে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। ইতোমধ্যে প্রফেসর ইউনূস এবং তার টিম সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বপ্ন বাস্তবায়ন দেখাতে শুরু করেছে। মাত্র আট মাসের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়ে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছেন। তলানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উঠে এসেছে স্বস্তির জায়গায়। যেটি মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে, সেটি হচ্ছে, প্রফেসর ইউনূস একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ভাবনা নিয়ে তার সরকারকে পরিচালিত করছেন। এখানে উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় ছাত্র-জনতা একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনের যে স্লোগান তুলেছিলেন, সম্ভবত প্রফেসর ইউনূস সেই লক্ষ্যেই তার সরকারকে পরিচালনা করছেন।
আমার মনে হয়েছে, প্রফেসর ইউনূসের বিশাল ক্যানভাসে ছোট্ট বাংলাদেশ সত্যি সত্যি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে। তিনি আগামী বাংলাদেশের যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে যাচ্ছেন, তাতে সামনের নির্বাচিত সরকারের জন্য হবে একটি মসৃণ যাত্রা।
এলাহী নেওয়াজ খান : সিনিয়র সাংবাদিক
