কলকাতার চিঠি
ধর্মের নামে আধিপত্যবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
সৌমিত্র দস্তিদার
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম তখন, তখনই বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ আছড়ে পড়েছিল উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে-জঙ্গলে। উচ্চকিত স্লোগানে মুখরিত তখন কলকাতা-তোমার বাড়ি আমার বাড়ি নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি। তরাইয়ের ছোট্ট তিনটি গ্রাম নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া ও খড়িবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করল।
আপনি মানুন না মানুন, একমত না হলেও এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, নকশালবাড়ি রাজনীতি আজও নানা ধারায় বিভক্ত হয়েও শাসকশ্রেণির রাতের ঘুম কেড়ে নিতে সক্রিয়। ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি নামের নেপালসংলগ্ন গ্রামে স্থানীয় ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বামপন্থি কৃষক সভার নেতৃত্বে হাজার হাজার কৃষক ও চা শ্রমিক। তখন পশ্চিমবঙ্গে সবে ক্ষমতার মসনদে এসেছে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
অন্যদিকে কৃষক বিদ্রোহের নেতা চারু মজুমদার, কানু সান্ন্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল ও অন্যান্য বাম নেতা। আলোচনার টেবিল ছেড়ে চারু মজুমদাররা চাইলেন কৃষকরাজ প্রতিষ্ঠা। সিপিআইএম দলে রাজনৈতিক মতবিরোধ তুঙ্গে উঠল। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি খোলাখুলিভাবে চারু বাবুদের সমর্থন করল।
সিপিআইএম ভাগ হয়ে গেল। জন্ম নিল সিপিআইএমএল। সে এক অন্য সময়। কলকাতা তখন অগ্নিগর্ভ। প্রতিদিন প্রতিরাতে তখন খুন হয়ে যাচ্ছেন কলকাতার তারুণ্য। বরানগর, কাশীপুর, বারাসাতে লাশের পর লাশ। বাতাসে বারুদের গন্ধ। শিল্প, সাহিত্য, নাটক, সিনেমায় প্রতিফলিত হচ্ছে নকশালবাড়ি। আনমনে, অস্ফুটে স্বগতোক্তি করছি-উত্তরে হাওয়া, করুক না ধাওয়া, লাল হয়ে যাক বসুন্ধরা।
সেসব দিন এখন অতীত। উত্তরবঙ্গের গ্রামগঞ্জে এখন পতপত করে উড়ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গেরুয়া পতাকা। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ১৯৬৭-এর পর পুরোপুরি বদলে যাওয়া এক উত্তরবঙ্গ দেখছি। ফারাক্কা বাঁধ পার হলেই ভৌগোলিক উত্তরবঙ্গ। মালদা ছিল একদা প্রাচীন গৌড়বঙ্গের রাজধানী।
বাংলার রাজনীতিতে গৌড়ের ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। দ্বাদশ শতাব্দীতে গৌড়ের গোড়াপত্তন হয়েছিল সুলতানী শাসনের। এর আগে সেনবংশীয় শাসকরা ছিলেন চরম হিন্দুত্ববাদী। আজ হিন্দুসমাজে যে কুৎসিত বর্ণ ব্যবস্থা, তার সূচনা হয়েছিল সেন রাজাদের দৌলতেই।
যত বড় সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা ইতিহাসে ঘটেছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিপর্যয়ের কারণ নিহিত থাকে সমাজের অভ্যন্তরে। তা সে অখণ্ড বঙ্গের মধ্যযুগেই হোক, বা সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতন, দুই-ই জনগণের সঙ্গে শাসকদের বিপুল দূরত্ব না ঘটলে এমন বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে না।
সেন রাজারাও সে যুগে বণিকদের ওপর অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল। ঈশ্বরের নামে মানুষে মানুষে চরম বিভেদের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল বলেই মাত্র অষ্টাদশ অশ্বারোহী নিয়ে বখতিয়ার খিলজির অনায়াসে বঙ্গ বিজয় সম্ভব হয়েছিল।
নীরদ সি চৌধুরী বলেছিলেন, বাঙালি আত্মঘাতী জাতি। বঙ্কিমচন্দ্র বলতেন, বাঙালির ইতিহাস নেই। আসলে ইতিহাস চেতনা নেই বলেই সে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে তো বটেই আত্মঘাতী। এই যে হালে নতুনভাবে বঙ্গ সমাজে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে, তা অনেক কমে যাবে আপনি যদি অখণ্ড বঙ্গের ইতিহাস অনুরাগী হন। হিন্দু-মুসলমান পারস্পরিক বিদ্বেষ তো অনেক পরের কথা। হিন্দুসমাজে শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, জৈন, বৌদ্ধ পরস্পরের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আজও গবেষণার বিষয়।
ফলে যে একমাত্রিক সনাতনী ধর্মের কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো বাস্তবসম্মত ভিত্তি নেই। কিন্তু উত্তরবঙ্গের গ্রামগঞ্জে গেরুয়া ঝান্ডার যে বিপুল উপস্থিতি, তা দেখে বোঝা কঠিন আমি পশ্চিমবঙ্গ না উত্তর প্রদেশের কোনো জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। শিলিগুড়ি অনেক দিন ধরেই বদলে যাচ্ছিল। পুরোনো অলিগলি, সাবেক বাড়ি, মহল্লা ভেঙে শহরের মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটতে লেগেছিল আশির দশক থেকেই। চা বাগাননির্ভর অর্থনীতির জায়গায় ফাটকা পুঁজি প্রাধান্য নিতে শুরু করায় শিলিগুড়ি ক্রমশ পেল্লায় ফ্ল্যাট, বিরাট বাজার, ঝকঝকে সেতুর শহরের চেহারা নিচ্ছিল বাম আমলেই।
পরবর্তীকালে দ্রুত শহরটির রাজনীতি, সংস্কৃতিও অন্যরকম হয়ে গেল। একদার বাম রাজনীতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেরুয়া রাজনীতির পায়ে নিজেদের সমর্পণ করল। শিলিগুড়ির অর্থনীতিতে বাঙালির দাপট অনেক দিন ধরেই অন্তর্হিত। তার জায়গা নেওয়া উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অর্থনীতি যত দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে, তত বাঙালি সংস্কৃতির জায়গা নিয়েছে গো-বলয়ের সংস্কৃতি। রাজধানী শিলিগুড়ি শহরের প্রভাবেই সারা জেলার গ্রাম-শহরে বিজেপির রমরমা বেড়েছে।
আরও একটি কারণ বিজেপির উত্থানের পেছনে কাজ করে থাকতে পারে, যা নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা হলে অন্তত অপর একটি অজানা বিষয় সামনে আসবে। সারা দেশেই ইদানীং বাংলাদেশ থেকে ‘অনুপ্রবেশকারী’দের নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত নাগরিক আইনের সুযোগে নেপাল, ভুটানের মতো দেশ থেকে এদেশে অনুপ্রবেশের তালিকা স্পষ্ট নয়। অথচ পাহাড়ের গ্রামগঞ্জে সাবেক জনবিন্যাস যে বদলে যাচ্ছে, তা সাদা চোখেই আন্দাজ করা যায়।
পাহাড়ের প্রাচীন বাসিন্দা, লেপচা, মেচ, সাঁওতাল, টোটো, দুকপা ও অন্যান্য জনজাতির লোকজন প্রায়ই অভিযোগ করেন, নেপালিদের অনুপ্রবেশের কারণে তারা ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এ স্পর্শকাতর বিষয়টির সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি জড়িত থাকলে অবাক হওয়ার নেই। পড়শি নেপালে কয়েক বছর আগে মাওবাদীদের উত্থান ওদেশের রাজভক্ত নেপালিদের অনেককেই ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল।
একই মঙ্গোলয়েড সাদৃশ্য, ভাষা, চেহারা ও সাংস্কৃতিক মিল থাকায় খুব সহজেই এদেশের জনস্রোতে মিশে যেতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয়নি এদেশে ঢুকে পড়া নেপালিদের। মনে রাখতে হবে, নেপালের রাজভক্ত অধিবাসীদের অধিকাংশই কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদী। তারা পৃথিবীর একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র বদলে সংবিধানে সেক্যুলার শব্দ জায়গা পাওয়ায় স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ ছিলেন।
হালে নেপালে ফের রাজতন্ত্র ফিরিয়ে দাও বলে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার পেছনেও এ রাজভক্ত গোষ্ঠীর মদদ আছে বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। হতে পারে এই নেপালি বংশোদ্ভূত লোকজনের সংখ্যাধিক্যের কারণেই আজ সারা উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং-পাহাড়ের সর্বত্রই গেরুয়া রাজনীতির বিপুল দাপট। পাশাপাশি এটাও ঠিক, আমরা সমতলের বাবুরা কখনোই সেভাবে পাহাড়ের মন বুঝতে পারিনি। পারিনি বলেই কখনো সুভাষ ঘিসিং, কখনো আবার বিমল গুরুংয়ের নেতৃত্বে আইডেন্টিটি পলিটিকস পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঝড় তুলে দিয়েছে।
শুধু নকশালবাড়ি রাজনীতি নয়, পাহাড় দীর্ঘদিন ধরেই বামপন্থি রাজনীতির ঘাঁটি। তরাই, ডুয়ার্সে চা শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে লড়াইয়ের ময়দানে নিয়ে আসার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে বামদের। ব্রিটিশ যুগ থেকেই চা শ্রমিকদের মধ্যযুগীয় শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বামপন্থিরা। রতনলাল ব্রাহ্মণ থেকে আরএসপির বেস্টার উইচ, শুকনা ওঁড়াওদের লড়াই আজও অবিস্মরণীয়।
পরবর্তীকালে নিছক সংসদীয় চোরাপথে চলতে গিয়ে বামদের মুখ্য দল সিপিআইএম আইডেন্টিটি পলিটিকসের কাছে যেভাবে হার মানল বা তাদের শক্তিশালী ঘাঁটি সুভাষ ঘিসিংয়ের মতো আনকোরা এক নেতার কাছে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল, তা নিয়েও নতুনভাবে বিশ্লেষণ দরকার। পাহাড়কে আমরা কলকাতার লোকজন দেখি নিছক ট্যুরিস্টের চোখ দিয়ে। ম্যল, কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য, ঐতিহ্যবাহী কেভেন্টাস বা গ্লেনারিস রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে আমরা যে পাহাড়কে দেখি, সেটাই তার পুরো চেহারা নয়।
ঘোড়ার লাগাম ধরে যে ছেলেটি ট্যুরিস্টদের অনুনয়-বিনয় করছে যাত্রী হতে, তার আয় কত, আমাদের জানা নেই। পিঠে অসম্ভব ভারী বস্তা নিয়ে যে নেপালি তরুণ বা তরুণীটি পথে চলেছে, তার রোজগার কত সামান্য, আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের অধিকাংশ সিনেমা, সাহিত্যে নেপালি বলতেই হয় বাহাদুর দারোয়ান বা লাস্যময়ী চা শ্রমিক, যে সবসময় খিলখিলিয়ে হাসে। ইদানীং পাহাড়জুড়ে অসংখ্য হোম স্টে পাহাড়ের বিকল্প আয়ের পথ দেখিয়েছে।
সবই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সরকারের কোথাও কোনো ভূমিকা নেই। অর্থনীতি যত রুগ্ণ হবে, ধর্ম তত আগ্রাসী চেহারা নেবে। এ তো ধর্ম নয়। ধর্মের নামে মনুবাদী আধিপত্যবাদ পাহাড়ের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। পাহাড়ের মানুষ সরল, বোকা নয়। গেরুয়া রাজনীতি কিছুদিন তাদের বোকা বানাতে পারলেও চিরদিন পারবে না। মাথার উপর স্থায়ী ছাদ, নিশ্চিত অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো ইস্যুর সমাধান করতে না পারলে আগামী দিনে পাহাড় হাসবে তা হলফ করে বলা যায় না।
সৌমিত্র দস্তিদার : প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
