শিক্ষা সমাজ দেশ
দেওয়ালে পিঠ, সামনে এগোনোর সময় এখন
ড. হাসনান আহমেদ
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দূরপাল্লার বাসের পেছনে কাগজে লিখে কে সেঁটে রেখেছিল জানি না; তবে বয়ানটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল : ‘বাস লাইনে কাজ করে শান্তি নাইরে বাজান’! আমি তাদের বিরামহীন কষ্টের কাজগুলো নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছি, আসলেই এ পেশায় জীবনে শান্তি বলতে কিছুই নেই। স্বাধীনতা আন্দোলন যখন পুরোদমে শুরু হলো, আমি তখন হাইস্কুলের প্রায় শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। ভবিষ্যৎ স্বপ্নভরা বুকে মিছিলে যেতাম। অনেক বড় আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কত গর্ব ছিল বুকে! এখন আমি জীবনের প্রান্তসীমায়, এক পা কবরে। বেলাশেষে জীবনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে দেশ নিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতেই হতাশার রঙিন চাদরে চোখের দৃষ্টি ঢেকে যায়। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে। দেখি, পিছু হটার আর জায়গা নেই। জীবনের সেই প্রারম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত এ দেশে চলে-ফিরে, বাস্তবতা দেখে, করে-কম্মে, কোনো কিছুতেই কি একদণ্ড শান্তি পেয়েছি? হতাশায় কখনো ভাবি, নিশ্চয়ই আমি অপয়া। আমার জীবনের অতি মূল্যবান সময়গুলো এভাবেই দিনে দিনে পার হয়ে গেল, দেশের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। সেই ’৭২ সাল থেকেই দেশটা লাঠিয়াল বাহিনী ও আধিপত্যবাদীদের দখলে। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া কে-বা শোনে! শিক্ষক মানুষ, শিক্ষামানেরও বিতিকিচ্ছি অবস্থা। এ নিয়ে কারও কি কোনো চিন্তা আছে?
আমাদের রাজনীতিকরা মানুষের মানসিকতার নেতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। যারা খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ-তাদের শুধু ভোগান্তি। দেশচালকরা ব্যক্তিস্বার্থ ও দাসত্ব করার কারণে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা সমাজে বসবাসরত মানুষের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারতেন, যা সমাজ-উন্নয়নে তথা দেশের উন্নতির জন্য অবশ্যম্ভাবী, যা রাজনীতিকদের সদিচ্ছায় একমাত্র সুশিক্ষা, মানবতা-সঞ্চারক শিক্ষার মাধ্যমে করা সম্ভব। মাঝখানে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়া তার আদর্শভিত্তিক রাজনীতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ দিয়ে দুর্নীতি অনেকটা কমিয়ে মাত্র কয়েক বছর আন্তরিকভাবে দেশের উন্নতির চেষ্টা করে গেছেন। সেজন্য তাকে জীবন দিয়ে সে চেষ্টার মাশুল দিতে হয়েছে। তাছাড়া স্বাধীনতার প্রথম থেকেই দেশটা অপয়ার শ্যেনদৃষ্টিতে পড়েছে। এত সুন্দর একটা দেশকে অপয়া বলাটা বিবেকবর্জিত। আমরা অপয়া হয়েছি মূলত আমাদের কর্ম, নিজেদের মধ্যে অপ্রত্যাশিত-আত্মঘাতী অবনিবনা, মানসিক বিকৃতি, ‘রাজনীতি নিয়ে ব্যবসা’ করার প্রবল বাসনার কারণে।
অবস্থানগত দিক থেকেও অপয়া বলছি এ কারণে, দেশের অবস্থানটা হয়েছে বর্ণবৈষম্যবাদী, আধিপত্যবাদী, নিকৃষ্ট-প্রতিহিংসাপরায়ণ মুসলিমবিদ্বেষী ভারতের পাশে। বর্ণবৈষম্যবাদী সমাজ হওয়ায় প্রতিহিংসা তাদের মজ্জাগত; আর্য নামে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এ উপমহাদেশে আসার সেই প্রথম থেকে। এর পাশে বসবাস করে কোনো রাষ্ট্রই শান্তিতে নেই। আমাদের জন্য এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান’ নামের গন্ধ, যাদের ভূ-ভারত থেকে বিতাড়িত করা হিন্দুত্ব-আধিপত্যবাদী শাসনের বজ্রমুষ্টি প্রতিজ্ঞা; তা-ও আজ থেকে নয়, সেই ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে। ভারত সরকার ভারত থেকে মুসলমানদের সমূলে উচ্ছেদ করতে চায়; এ দেশকে তাদের তাঁবেদার ও সেবাদাস দিয়ে লুটপাট, শাসন করতে চায়, করদরাজ্য গড়তে চায়, বাণিজ্যিক পশ্চাদভূমি বানাতে চায়। যারা তাদের আনুগত্য, দাসত্ব ও বশ্যতা স্বীকার করে চলবে, তাদেরই ক্ষমতায় বসাতে চায়। কোনো স্বাধীন মানুষ কি দাস হতে চায়?
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী মিলে একসঙ্গে সাধারণ মানুষ শান্তিতে বসবাস করছে। আমরাও সেটা চাই। ভারত থেকে ‘মুসলমান খেদাও, সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করো’ অভিযান চলছে; পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোর প্রতিও অলিখিত অত্যাচার-নিগ্রহ চলছে। বাঁদর দুইটা খেয়ে দইমাখা হাত পাশে দাঁড়ানো ছাগলের মুখে মুছে দিচ্ছে; বিশ্বময় রটিয়ে দিচ্ছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, ওরা জঙ্গিবাদী। পুরো বিশ্বটা সর্বৈব মিথ্যা ও ক্ষমতার দাপটে চলছে। জিও-পলিটিক্যাল কনফ্লিক্টের বদৌলতে তথাকথিত সভ্যতার বর্তমান পশ্চিমা ধারকরা সে কথা আমলে নিয়ে আমাদের শাসাচ্ছে। কপালকে তো অপয়া বলবই। শ্রুতিকটু নিরেট সত্য এই-যতদিন এই প্রতিহিংসাপরায়ণ, পরখেকো, আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে না যাবে, তারা তাদের এ শোষণ, হিংসুটে স্বভাব, নিজস্ব সেবাদাস-প্রতিপালন প্রতিজ্ঞা বদলাবে না, এ উপমহাদেশেও শান্তি ফিরবে না।
আমরা অপয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কয়েকবার সুযোগ পেয়েছি: ’৭১ সালে স্বাধীন হয়ে সুযোগটা প্রভুর পদমূলে উৎসর্গ করে দিয়েছি। ’৭৫ সালের পরিবর্তন নিজেদের ভুলে জীবন দিয়ে ভুলের খেসারত দিয়েছি। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে দেশ গড়ার সুযোগ হাতছাড়া করেছে। ’২৪ সালে সুযোগ হয়েছিল বর্গিমার্কা-জরাজীর্ণ অপশাসন, সীমাহীন দুর্নীতি, অপহরণ-হত্যা-গুম, গণহত্যার একনদী জমাটবাঁধা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে পূর্ণাঙ্গ বিজয় সংঘটিত করা এবং সম্পূর্ণ নতুন মনমানসিকতা নিয়ে দলবদ্ধভাবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার। অনেকটাই ভুলতে বসেছি। এখনো বিনা বাধায় ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ-লালসা, জিদ ও পারস্পরিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে আমরা বাস করছি। রাজনৈতিক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ ইত্যাদি থেকে ভবিষ্যতে দেশ কতটা অপয়ামুক্ত হবে, সে বিষয় নিয়ে কোনো দলবাজদের মাথাব্যথা নেই। এসবই কোনো কোনো ব্যক্তির কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর দুরারোগ্য ব্যামো।
আমি কোনো গওস-কুতুব-আউলিয়া নই, সাধারণ একজন মাস্টারসাহেব। তিনটি কাজের সুচিন্তিত বয়ান আমি করতে পারি, যা দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার সঙ্গে মাত্র সাত বছর ধরে করতে থাকলে এ দেশ নিশ্চিত কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হবে। ১. নৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে খুব শক্ত শাসনের মধ্যে রাখতে হবে; দুর্জন ও অশিক্ষিতের জন্য উদার গণতন্ত্র প্রয়োগ করা যাবে না। যে কোনো দলের নেতা ও পোষ্যপুত্রদের প্রতিটি অন্যায় কাজের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা আইনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করতে হবে। সেমতো নির্বাচনের আগেই বিধিবিধান সংস্কার করতে হবে। এতে দেশে দুর্নীতি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাবে। ২. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পর্যন্ত পরিবর্তন করতে হবে। ৫৪ বছর ধরে শুধু উচ্ছন্নে যাচ্ছে। বিগত আট মাসেও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। শিক্ষার ভিত্তিমূল নির্ধারণ, কাঠামো পরিবর্তন, টেক্সট পরিবর্তন, শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধ বজায় রেখে করতে হবে এবং একটা সময়োপযোগী শক্ত বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। এটাই বড় সমস্যা। সামাজিক শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করতে হবে। এরও ব্যাপক পদ্ধতি ও ব্যবস্থা আছে। সামাজিক শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একত্রে গেঁথে ফেলতে হবে। সেখানেও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন কঠিন নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনতে হবে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জুড়ে দিতে হবে ‘সোশ্যাল এন্টারপ্রিনিউর’ ব্যবস্থা। প্রতিটি অঞ্চলে ‘সোশ্যাল এন্টারপ্রিনিউর’ জন্ম নেবে। তাতে বেকার সমস্যা কমপক্ষে ৬০ শতাংশ কমে যাবে। এক্ষেত্রে সুনিয়ন্ত্রিত সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে হবে। সবকিছুরই পরিকল্পনা, প্রয়োগ ও সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অতি অল্প সময়ে তৈরি করা ও বাস্তবায়ন সম্ভব। ৩. চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া যথাসম্ভব চালিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়ে শুধু রাজনীতিকদের মতামতের ওপর নির্ভর করা যাবে না। রাজনীতি করে না এমন অসংখ্য দূরদর্শী-চিন্তাশীল ব্যক্তি এ দেশে রয়ে গেছেন। তাদের সুচিন্তিত মতামতও গ্রহণ করতে হবে। দেশটা শুধু রাজনীতিবিদদের নয়, সাধারণ মানুষসহ সুশিক্ষিত সব মানুষের। পচা রাজনীতির দুর্গন্ধ দেশময় ভরপুর। রাজনীতিবিদরা অধিকাংশ সময় দলীয় স্বার্থের বাইরে যেতে চায় না, দলের লাভ দেখতে গিয়ে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। রোগী অনেক সময়ই তেতো ওষুধ খেতে চায় না, যদিও এর মধ্যে তার রোগমুক্তি ও পরিবারের কল্যাণ নিহিত আছে।
ড. হাসনান আহমেদ : শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ
pathorekhahasnan.com
