গঠনমূলক সমালোচনাই কাম্য
ড. এম এ সোবহান
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পুলিশিং হলো অনেক উন্নতমানের এক সেবা। পুলিশ ছাড়া কোনো সভ্য দেশ ও সমাজ চলতে পারে না। পুলিশ ও জনতা একত্রে কাজ করে যে কোনো সমাজের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ‘স্যার রবার্ট পিল’ যখন আধুনিক পুলিশিং চালু করতে যান, তখন যুক্তরাজ্যের অধিকাংশ জনগণ তাদের ক্ষমতা খর্ব হবে বা স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে বলে প্রথম অবস্থায় সে পুলিশি ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে চাননি। যা হোক, পুলিশের কাজে জনমানুষের স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সবকিছু করতে পারে না বা করা যায় না।
বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী মানা বা কমপ্লায়েন্স নিয়ে খুব কাজ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশকে ব্যবহার করে এবং আঘাত করে কিছু কিছু ইস্যু তৈরি করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং সমাজের একটা অংশের মানুষ কর্তৃক পুলিশের সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুলিশিং পুলিশের বাইরের লোকজন বেশি ভালো জানেন। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়ে কথা বলতে হলে, বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে মন্তব্য করলে সে প্রতিষ্ঠানটি নিঃসন্দেহে উপকৃত হবে।
অতি সম্প্রতি একটি ভিডিওতে দেখলাম, রাষ্ট্রীয় পোশাক পরা একজন পুলিশ সদস্যকে দুই লেডি ধাক্কা দিচ্ছেন এবং বলছেন, ‘আমাকে টাচ করিবে না’। এভাবে কাউকে অসম্মান করা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। একজন দুঃখ করে আমাকে বলেছেন, তারা পুলিশকে ধাক্কা দেবেন, এটাই স্বাভাবিক? তবে একটু ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করলে খুব খুশি হতাম। আবার একজন লেডিকে দেখলাম, পোশাকধারী ও বুলেটপ্রুফ পরিহিত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন। এর কারণ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। প্রতিবাদের তো একটা ভাষা বা পরিভাষা থাকবে। এভাবে কাউকে গালি দিয়ে তো বিখ্যাত বা নেতা হওয়া যায় না। মনে হয়েছে, হয়তো বা তিনি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ছিলেন অথবা তার পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব রয়েছে। উল্লেখ্য, এটা কিন্তু আমাদের সমাজের অবক্ষয়কে নির্দেশ করে। আর লেখাপড়া করে, পরিশ্রম দিয়ে, জনসেবা করে এবং মানুষকে ভালোবেসে বিখ্যাত বা নেতা হতে হয়। তাহলে সেই নেতৃত্ব টেকসই হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন অনেক বড় বড় নেতাকে পরবর্তীকালে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কারও কারও ধারণা, পুলিশকে আঘাত করলে বা পুলিশের সমালোচনা করলে এদেশে বুদ্ধিজীবীও হওয়া যায়। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, কেউ কেউ আবার পরিবেশগত ফ্যাক্টর দ্বারা প্রভাবিত হয়েও কাজ করে থাকেন মর্মে জানা যায়। পুলিশের ওপর হামলা করা হচ্ছে; অপবাদ দেওয়া হচ্ছে-পুলিশ অসৎ, অযোগ্য, সক্রিয় নয় ইত্যাদি। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশ পুলিশের ৯০ শতাংশ সদস্যের ঘুস নেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। তারা পুলিশ লাইন্স, ব্যাটালিয়ন্স, রিজার্ভ ফোর্স ও বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করে থাকেন। এভাবে ঢালাওভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করা শিষ্টাচারবহির্ভূত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। দেশের অনেকেই লেখাপড়া থেকে দূরে সরে গেছে। দীর্ঘদিন পর একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিউএস র্যাংকিংয়ে এবার বিশ্বের ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছে। তাই যে বা যারা সমালোচনা করেন, যদি একটু গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাহলে সব অংশীজন উপকৃত হবে।
বস্তুত পুলিশকে জনবান্ধব, সক্রিয় হতে হলে এবং মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা, মিথস্ক্রিয়া, যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং পাঠ্যক্রমবহির্ভূত বিভিন্ন বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া মব সাইকোলজি জেনে ও আবেগপ্রবণ জনতা ব্যবস্থাপনা অনুশীলন করে অসহিষ্ণুতা, মব জাস্টিস, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রয়াস ইত্যাদি থামাতে হবে। অপরাধবিজ্ঞানী টম টেলর বলেছেন, পুলিশের লেজিটিমেসি আনতে হলে পুলিশকে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। সেজন্য বাংলাদেশ পুলিশকে সর্বাগ্রে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। ক্রমাগত হামলা করলে পুলিশ কাজ করতে পারবে না। মান্যবর আইজিপি স্যার বারবার এ কথাই বলছেন, আমাদের কাজ করতে দেন, সহায়তা করুন। সবাই পুলিশকে সহায়তা না করলে কাজ করতে পারবে না। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবাই। একজন বিদগ্ধজন বলেছেন, ‘বন্যা এলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও রেহাই পায় না’, সেজন্য এখনই সবার সতর্ক হওয়া দরকার।
এটা অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশ পুলিশ একটি বড় ট্রমা পার করেছে, এ ট্রমা এখনো অনেকের মধ্য থেকে যায়নি। আমাদের দেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে একটু বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পুলিশেও কিছু বিচ্যুতি রয়েছে। এটাও সত্য, পুলিশের একটা অংশ (সদস্যরা) ১০-১৫ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন। যারা ১০-১৫ ঘণ্টা ডিউটি করবেন-সেখানে অনেক সময় ভালো ম্যানেজমেন্টও ব্যর্থ হয়ে যায়। তাছাড়া পুলিশ দেশের বাইরের কোনো দ্বীপ থেকে আসেনি, তারা এ সমাজের অংশ। সুতরাং পুলিশের একটি অংশের বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের দায় সমাজের কেউ এড়াতে পারে না, বরং এ দায় সবার।
পুলিশের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা যাক। কেউ কেউ বলছেন, এক মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে পুলিশে নিয়োগ দিতে। পুলিশকে নিয়ে পরীক্ষা না করে নিজের কাজটা সুচারুভাবে করলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। প্রায় ৭ বছর ধরে পুলিশের ফিল্ড প্রশিক্ষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার কারণে এবং সে সুবাদে বলা যায়, একজন প্রশিক্ষণার্থীর শারীরিক ফিটনেস আনতে কমপক্ষে ৪-৬ মাস সময় প্রয়োজন হয়। তাছাড়া পিটি, প্যারেড, সাঁতার, শুটিং, মার্শাল আর্ট, আইন, তদন্ত, তদন্ত-তদারকি, মানবাধিকার, ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট, শক্তিপ্রয়োগ, ফোর্স কনটিনিউয়াম, অপরাধ বিজ্ঞান, মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স, মনোবিজ্ঞান, ভিকটিমোলজি ইত্যাদি শিখতে বেশ সময়ের প্রয়োজন হয়। উত্তম প্রশিক্ষণ না দিতে পারলে সর্বোত্তম সেবা পাওয়া সম্ভব নয়।
পৃথিবীতে জাপানে সবচেয়ে অপরাধ কম। এর পেছনের মূল কারণ হলো, জাপানের মানুষের বিশেষ করে মা-বাবার মধ্যে শেইম বা লজ্জা খুব বেশি। যদি কোনো সন্তান অপরাধ করে, তাহলে ওই সন্তানের জাপানি পিতা-মাতা খুবই লজ্জিত হয়ে থাকেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকেন। আমাদের অনেক সমাজ ও সভ্যতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
সমসাময়িক পুলিশিংয়ের অন্তর্ভুক্ত হলো প্লুরাল পুলিশিং, প্রবলেম ওরিয়েন্টেড পুলিশিং, কমিউনিটি পুলিশিং, অ্যাভিডেন্স বেইজড পুলিশিং, ইন্টেলিজেন্স লেড পুলিশিং, ডেমোক্রেটিক পুলিশিং ইত্যাদি। সমসাময়িক পুলিশিংয়ের উপরোক্ত প্রতিটি মডেলের অনেক ভালো দিক রয়েছে। আমাদের সেগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
বিশ্বের সব অপরাধ বিজ্ঞানী বলেছেন, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অর্থাৎ ইনফরমাল সোশ্যাল কন্ট্রোল ম্যাকানিজম যদি কাজ না করে, তাহলে সমাজে শৃঙ্খলা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসে না। সুতরাং, আমাদের অনানুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বখে যাওয়া, অসুস্থ ও মাদকাসক্তদের বুঝিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে ও মমতা দিয়ে সুপথে ফেরাতে হবে। তাহলেই স্থিতিশীল ও আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
ড. এমএ সোবহান পিপিএম : কমান্ড্যান্ট (এডিশনাল ডিআইজি), পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল, বেতবুনিয়া, রাঙামাটি
