Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

মে দিবস অমর হোক

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মে দিবস অমর হোক

ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহ্যগতভাবে, ১ মে হলো ইউরোপীয় বসন্তকালীন মে দিবসের উৎসবের তারিখ। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেস, সমাজতান্ত্রিক এবং মার্কসবাদী দলগুলোর জন্য দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা করে। এটি ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের শ্রমিক শ্রেণির দাবির সমর্থনে ‘মহান আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ’ করার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার কর্তৃক ১ মে তারিখটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সাধারণ ধর্মঘট হিসাবে স্মরণ করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। স্মর্তব্য, ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো নগরীর হে মার্কেটে শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। এ বিক্ষোভ থেকে এজেন্ট প্রভোকেটিয়াররা পুলিশের ওপর উসকানিমূলক হামলা চালালে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। পুলিশ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বোমা হামলার অভিযোগে মামলা করলে আদালত স্যামুয়েল ফিল্ডেন, আলবার্ট পারস্নস, লুই লিন্গ, অগাস্ট স্পাইন, এডল্ফ ফিশার এবং জর্জ এঞ্জেলকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এছাড়া অস্কার নিব ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। হে মার্কেটের ঘটনাটি ইতিহাসের একটি বড় বিতর্কের অংশ হয়ে আছে। কারা ন্যায়ের পক্ষে, শ্রমিক-জনতা, না পুলিশ সে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। তবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বেশির ভাগ দেশের মানুষের সহানুভূতি হে মার্কেটকেন্দ্রিক মে দিবসের বিক্ষোভকারীদের প্রতি। তারা রক্ত দিয়ে এবং ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির একটি বড় দাবি প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। আজ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস হিসাবে পালিত হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার ‘লেবার ডে’ হিসাবে পালিত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভলেন্ড ১ মে দিবসটির সঙ্গে মার্কসবাদীদের সংশ্লেষ রয়েছে মনে করে শ্রমিক দিবস পালনের জন্য ভিন্ন একটি দিন নির্ধারণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠানে মার্কসবাদীদের প্রতি এতই ঘৃণা রয়েছে যে, মার্কিন এস্টাবলিশমেন্ট ১ মে’র সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখতে নারাজ। ১৮৮৯ সালে সমাজতান্ত্রিক ও ট্রেড ইউনিয়ন গ্রুপগুলো আন্তর্জাতিক ফেডারেশন শ্রমিকদের সমর্থনে ও হে মার্কেট শহিদদের স্মরণে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

ইউরোপে ঐতিহ্য অনুযায়ী ১ মে পালিত হতো মূর্তি পূজারিদের উৎসব হিসাবে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে দিবসটি আধুনিক আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে পরিণত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্র ছিল, তখন তারা ১ মে ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করে। তারা মনে করতেন, মে দিবস পালনের মধ্য দিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সাবেক পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হতো এ দিবসটিতে। মস্কোর রেড স্কয়ারে সোভিয়েত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা এই কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করতেন। এ কুচকাওয়াজের উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক শক্তিমত্তা প্রদর্শন। জার্মানিতে ১৯৩৩ সালে শ্রমিক দিবসটি নাজি পার্টির ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ছুটির ঘোষণার পর নাজি জার্মানিতে স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন উচ্ছেদ করা হয়, আর এভাবেই জার্মানিতে হিটলার শ্রমিক আন্দোলন ধ্বংস করে দেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে কমিউনিস্ট শাসনের পতন হলে গোটা অঞ্চলজুড়ে মে দিবসের উৎসব গুরুত্ব হারায়। তা সত্ত্বেও বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস সরকারি ছুটির দিন এবং দিবসটিতে পিকনিক ও ভোজসভা অনুষ্ঠিত হয়। এর পাশাপাশি শ্রমিক ও শ্রমিক স্বার্থের সমর্থনে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়।

ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের প্রথম শতাব্দীতে শ্রমিক শ্রেণির জীবন ছিল অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত। নারী, শিশুসহ শ্রমিকরা দৈনিক খুব স্বল্প মজুরিতে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য থাকত। তাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু ছিল না। অনেক ইউরোপীয় আমার কাছে স্বীকার করেছেন, তৎকালে তাদের দেশের বস্তিবাসী শ্রমিকরা ঢাকার বস্তিবাসী শ্রমিকদের তুলনায় অনেক মানবেতর জীবনযাপন করত। এ অবস্থার নিরসনকল্পে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির ইউনিয়ন ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা সংগঠনের কাজ করার দাবি তোলে। শ্রমিক শ্রেণির এ দাবি ছিল খুবই ন্যায্য। কারণ বিশ্রাম ছাড়া একজন শ্রমিক পরবর্তী দিনে কীভাবে দৈহিক শ্রম করতে পারে? অন্যদিকে সাংগঠনিক কাজে জড়িত হয়ে শ্রমিকরা একদিকে যেমন তাদের দাবি-দাওয়া আদায় নিয়ে মতবিনিময় করতে পারে, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে সংহতি সৃষ্টি করে উন্নত সংস্কৃতি ও উন্নত জীবন মানের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। শ্রমিক শ্রেণির এ দাবির ফলে সমাজতন্ত্র অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে এমনটি নয়, বরং শ্রমিকদের এ ন্যায্য দাবি পূরণ হলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনেকগুণ উৎপাদনশীল এবং সুশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য এ নিয়ম অপরিহার্য। শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতির পাশাপাশি পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রম আইন প্রবর্তিত হয়েছে। এ আইন বলে দেয় শ্রমিকরা কী করতে পারবে অথবা কী করতে পারবে না। তবে অনেক দেশে শ্রম আইন শ্রমিক স্বার্থবিরোধী। এজন্য সেসব দেশে শ্রম আইনের গণতন্ত্রায়নের জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। তাদের এ আন্দোলন খুবই ন্যায্য এবং উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে সহায়ক।

ব্রিটিশশাসিত ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয়। ব্রিটিশ ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা এসএ ডাঙ্গে একজন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা ছিলেন। তিনি বোম্বে অঞ্চলে শ্রমিকদের সংগঠিত করেছিলেন। এই বোম্বেতেই শ্রমিকরা প্রথমবারের মতো একটি সংগঠিত ও শক্তিশালী শ্রমিক ধর্মঘটের আয়োজন করে। লেনিন শ্রমিকদের এ ধর্মঘটকে ভারতের শ্রমিক শ্রেণির প্রথম রাজনৈতিক ধর্মঘট হিসাবে অভিনন্দিত করেছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তৈরি হলে ডাঙ্গের শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থবিরোধী কিছু কিছু কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা হয়। আমার প্রয়াত বড় খালার এক চিঠিতে পড়েছি, কমরেড মুজফ্ফর আহমদ আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের শ্রমিকদের আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়লে তার গ্রামের বাড়িতে আসার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। আমার খালা তাকে কাকা বাবু বলেই সম্বোধন করতেন। সারা ভারতের কমিউনিস্টরাও তাকে শ্রদ্ধাভরে কাকা বাবু বলেই সম্বোধন করেন।

পাকিস্তান আমলে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন খুব সংগঠিত ছিল। কামরুদ্দিন আহমদের লেখায় পাকিস্তানে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রথম পর্ব সম্পর্কে অনেক কথা জানা যায়। উৎসাহী পাঠক তার বই থেকে পাকিস্তানে শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম পর্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। ডাক্তার এমএ মালেক, যিনি অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়েছিলেন, পাকিস্তানের শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম পর্বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শ্রমিক নেতা হলেন আলতাব আলী, মাহবুবুল হক, অনিল মুখার্জি, সুনীল দে, মোহাম্মদ তোয়াহা, সিরাজুল হোসেন খান, কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো, আবুল বাসার, নিজাম উদ্দিন আহমদ, আব্দুল সালেহ, দেবেন শিকদার, মোনিন্দ্র মহাজন, তাজুল ইসলাম প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সিলেটের চা শ্রমিকদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন আসাদ্দর আলী ও রাধা কৃষন কৈরী। আরও কয়েকজন শ্রমিক নেতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আব্দুল মান্নান, রুহুল আমীন ও মিসির আলী। এসব শ্রমিক নেতার সবাই যে সত্যিকারের শ্রমিকদরদি ছিলেন, এমন নয়। কেউ কেউ শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কিছু কাজ করেছেন।

পাকিস্তান আমলে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হতো। এ দিন লাল ঝাণ্ডা নিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক রাজপথে মিছিলে অংশগ্রহণ করত। তারা স্লোগান দিত, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, আমাদের বাঁচার দাবি মানতে হবে মানতে হবে,’ ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’। মে দিবসের মিছিলে শুধু শ্রমিকরা নয়, ছাত্র-ছাত্রী ও নারীরা অংশগ্রহণ করত। লাল ঝাণ্ডা মিছিলকারীদের সংগ্রাম ও বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করত। আমি নিজেও মে দিবসের অনেক মিছিলে অংশগ্রহণ করেছি। পাকিস্তান আমলে রেলওয়ে, লঞ্চ ও স্টিমার, জুট মিল, স্পিনিং মিল, কটন মিল, রিকশা শ্রমিক, বেবিট্যাক্সি শ্রমিক ও মোটরযান শ্রমিকসহ শিল্পকারখানার প্রতিটি সেক্টরে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। চা শ্রমিকদের ছিল ‘চা শ্রমিক সংঘ’। শ্রমিকরা সংগঠিত ও রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ থাকার ফলে সেই সময় শ্রমিক অঞ্চলে কোনো ধরনের নৈরাজ্য ঘটতে দেখা যায়নি।

অথচ বাংলাদেশ আমলে আদমজী জুট মিলসহ প্রায় সব কলকারখানায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। আদমজী জুট মিলে কমপক্ষে ১৫ হাজার ভুয়া শ্রমিক ছিল, যারা নিয়মিত বেতন-ভাতা নিত। ফলে এশিয়ার বৃহত্তম এই জুট মিলটি সমূহ ক্ষতি ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। লাল বাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপ ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণে এই শিল্পের কর্মকর্তারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকতেন। চট্টগ্রামের আর আর জুট মিলে রাতের অন্ধকারে প্রায় আড়াইশ শ্রমিককে হত্যা করে বস্তাবন্দি করে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। ১৯৭২-৭৫-এর আওয়ামী-বাকশালী অন্ধকার যুগের পর এদেশে আর কখনো সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠতে পারেনি। পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত থাকলেও, যাদের বেশির ভাগ নারী শ্রমিক, তারা প্রায়ই অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের মধ্যে সুসংগঠিত স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন না থাকার ফলে পোশাক খাতের শ্রমিক আন্দোলন নৈরাজ্য, অগ্নিসংযোগ ও বিশৃঙ্খলার পথে ধাবিত হয়। শিল্প সেক্টরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত আদর্শবাদী ট্রেড ইউনিয়নের কোনো বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমান উদার বিশ্ব পুঁজিবাদের কবলে পড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ভেঙে পড়েছে। আজ মহান মে দিবসে ডাক হলো, দুনিয়ার মজদুর এক হও। সর্বহারা শ্রমিকদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

মে দিবস

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম