চাণক্যনীতি বোধহয় এবার গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে গেল
মেজর (অব.) মনজুর কাদের
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত ২২ এপ্রিল অধিকৃত কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বাইসারানে বন্দুক হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই পর্যটক। ২০০০ সালের পর এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাগুলোর মধ্যে এটি একটি। ভারত প্রমাণ ছাড়াই হামলার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের বেসামরিক- সামরিক নেতৃত্ব এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে চাইলেও বাস্তবতা ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র জানে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। এখনো ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বললেও রাশিয়ার সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক রেখে চলে।
নিমা গুন্ডা মে ফাঁস গ্যায়া
আত্মবিশ্বাসী সুন্দরী মেয়ে নিমা কলেজে আসা-যাওয়ার সময় সহপাঠীদের পাত্তা দিত না, কোনো ছেলের সঙ্গেও কথা বলত না। কথা বললে হয়তো ছেলেদের মধ্যে ক্ষোভ কম সঞ্চারিত হতো, কিন্তু নিমা সেটা বোঝেনি। অতএব, পরিণতি যা হওয়ার তাই হলো; বিক্ষুব্ধ ছাত্র সহপাঠীরা গুন্ডা ভাড়া করে নিমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। নিমা মনে মনে ভাবতে থাকে কী করতে কী হয়ে গেল।
১৯৯৪ সালের দিকে আমরা (আমি এভিডেন্স পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে) বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধিরা কলম্বোয় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশনের সভায় মিলিত হয়েছিলাম, যেখানে পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল হামিদ ছাপারা (পাকিস্তান সাংবাদিক ফেডারেশনের সভাপতি এবং করাচি প্রেস ক্লাবের সভাপতি) ডিনার টেবিলে ভারতের সাংবাদিক ফেডারেশনের নেতা মি. পান্ডেকে এ গল্পটি শুনিয়েছিলেন। গল্পটির সারমর্ম হলো, কেউ মাঝেমধ্যে অবহেলার কারণে নিজের অজান্তেই নিজ কর্মের জন্য ফেঁসে যান। ভারতের অবস্থা হয়েছে অনুরূপ। অতি আত্মবিশ্বাসী ভারত সবসময় ভাবে, তারা সহজেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে ব্যর্থ করতে পারবে।
অপরদিকে, এ দাবিকে যদি নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, ভারতের আরেকটি প্রতিবেশী দেশ, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, সবসময় ভারতের দিকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে আছে, তার খবর নেই।
বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে চীনকে আরও জরুরি সীমান্ত চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিবেচনা করেছে, বিশেষ করে ২০২০ সালে হিমালয়ের উঁচুতে লাদাখের প্যাংগং হ্রদ এবং সিকিমের নাথু লা পাসের কাছে সৈন্যদের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষ ঘটে এবং এর ধারাবাহিকতায় ভারতীয় ভূখণ্ডে বারবার চীনা অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে।
ভারতের সামরিক নেতাদের দুই ফ্রন্টের যুদ্ধের আশঙ্কার জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে, যার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ ও সম্পদের। এ সম্পদ ভারতের আছে কিনা, সে প্রশ্ন তুলেছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। ভারতের ৫০ শতাংশ মানুষের কোনো টয়লেট নেই। ১১টি রাজ্যে মাওবাদীদের নেতৃত্বে শ্রেণিসংগ্রাম চলছে। পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বাংশের সেভেন সিস্টারে আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম চলছে। এগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি, হিন্দু জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা উড়িয়ে দিয়েছে।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভারত চলছে কোয়াসি ইউনিয়ন এবং কোয়াসি ফেডারেল শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। এতে করে রাজ্যগুলোর মধ্যে বৈষম্য বেড়ে গেছে। ভারত এখনো পর্যন্ত জাতিরাষ্ট্রে (Nation State) রূপান্তরিত হতে পারেনি। ভারত যদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের মতবাদ নিয়ে চলতে থাকে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ভারত খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত (pole apart) হয়ে যেতে পারে।
ভারত জাতিগত সমস্যায় জর্জরিত। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে (সেভেন সিস্টার) জাতিসত্তার আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এ আন্দোলন ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশকে ভারত ব্যবহার করতে চায়, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান তা অনুমোদন করে না। সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত প্যালেস্টাইনের মুক্তিকামী জনতাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেশী বদলে যায়
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশসংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে মুক্তিকামী আরাকান আর্মি।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের কারণে বহু দেশ বিলুপ্ত হয়েছে, আবার নতুন নতুন দেশের জন্ম হয়েছে-যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাংশ বিলুপ্ত হয়ে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরাজিত হওয়ার পর ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল।
যারা বলেন, ভারত বৃহৎ প্রতিবেশী এবং যেহেতু প্রতিবেশী বদল করা যায় না, তাই বড় দেশ ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই চলতে হবে, অর্থাৎ ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির পূজা করতে হবে সারাক্ষণ-এগুলো হলো জুজুর ভয় দেখানো। ভারতের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তার অখণ্ডতা রক্ষা করা।
২০২০ সালে লাদাখে চীন-ভারত সংঘর্ষের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শত চেষ্টা করেও মোদি চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে দাঁড় করাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাশিয়ার কাছে ধরনা দিতে হয় ভারতকে। রাশিয়া তার বর্তমান ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীনকে অনুরোধ করার পর ভারত রক্ষা পায়।
এবারের পরিস্থিতিও সেরকম। রাশিয়ার সম্মতি ছাড়া ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারবে না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে চীন এখন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি একথা নরেন্দ্র মোদি ভালো করেই জানেন।
এদিকে গত ২ মে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ফক্স নিউজের ‘স্পেশাল রিপোর্ট উইথ ব্রেট বেয়ার’ অনুষ্ঠানে বলেছেন : ‘আমাদের প্রত্যাশা হলো ভারত এ সন্ত্রাসী হামলার প্রতি এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, যাতে তা বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের দিকে না যায়।’
এ ঘটনায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় চতুর্দিক থেকে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও মোদি সরকার তেমন সমর্থন পাচ্ছে না।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পর্যটক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার
জেরে অভাবনীয় চাপে পড়েছে ভারত। চাণক্যনীতি বোধহয় এবার গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে গেল।
মেজর (অব.) মনজুর কাদের : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ-সদস্য
