Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পরিস্থিতি আমাদের যেন লক্ষ্যচ্যুত না করে

Icon

সাইফুল হক

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পরিস্থিতি আমাদের যেন লক্ষ্যচ্যুত না করে

একটা প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক কথা আছে, নারীর মন বোঝা ভার। এখন দেখছি সরকারের মন বোঝা আরও কঠিন। জনপরিসরে দেওয়া ভাষণ, বক্তৃতা, বিবৃতি তাদের মনের কথা কি না, তা বোঝা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। কদিন আগে সরকারপ্রধান শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশের যুদ্ধ প্রস্তুতি রাখার কথাও বললেন। কেন এ যুদ্ধ প্রস্তুতি বা কার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ, তা তিনি পরিষ্কার করেননি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দেশবাসীকে জানালেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক করিডর প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এরপর জানালেন, সরকার এ ধরনের কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়নি। সরকার একদিকে বলছে, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন; আবার অন্যদিকে বলছে মানুষ তো এ সরকারকে চলে যেতে বলছে না। আবার বলছে, জনগণের কাছে এ সরকার একটা ভালো বিকল্প হতে জন্মাতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন জোরালোভাবে জাতীয় নির্বাচনের নির্দিষ্ট সূচি দাবি করে আসছে, তখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের দ্বিমুখী ও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বড় ধরনের বিভ্রান্তি ও সন্দেহ তৈরি করছে; সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সরকার আরও লম্বা সময়ের জন্য ক্ষমতায় থেকে চাইছে কি না, জনগণের মধ্যে এটি বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথটা খানিকটা অনিশ্চিত ও পিচ্ছিল হয়ে উঠছে কিনা, রাজনীতিসচেতন মহলে এ প্রশ্নও দানা বাঁধতে শুরু করেছে। নতুন নতুন ইস্যু দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার আসল কাজগুলোকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে।

এদিকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি যে সরকার কার্যকরভাবে সামাল দিতে পারছে, তা আর জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল ও জনগণের বিপুল সমর্থনে গঠিত সরকার এখন তার বিপুল ক্ষমতার নয় মাস পার করছে, তার অকার্যকারিতার কোনো অজুহাত দেশের মানুষ নিশ্চয় আর শুনতে চাইবে না। অথচ সরকারের ওপর মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল, সরকারের প্রতি সমর্থনও ছিল নজিরবিহীন। কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের পরও মানুষের প্রত্যাশা ইতোমধ্যে ফিকে হতে শুরু করেছে।

নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশার পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ক্রমে একধরনের সামাজিক নৈরাজ্যের বিস্তৃতি ঘটছে। খুন, রাহাজানি, সংঘাত, সহিংসতা থামছে না, বরং বাড়ছে। জবরদস্তি, জবরদখল, মাস্তানি, চাঁদাবাজি উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক নিরাপত্তা এখনো বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের জীবন-জীবিকা নানা দিক থেকে হুমকির মুখে। গণ-অভ্যুত্থানে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি জীবন দিলেও অন্তর্বর্তী সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই; গণ-অভ্যুত্থান তাদের নিদারুণ অমানবিক কষ্টের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি; বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।

আর্থিক খাতে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পর্কে গঠিত শ্বেতপত্র কমিশন ছ মাস আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে লুটপাট ও দুর্নীতি সম্পর্কে রোমহষর্ক রিপোর্ট জমা দিলেও এ ব্যাপার সরকারের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। এসব ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে কোথায় সরকারের সমস্যা তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। ছয় মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে তারা যদি অর্থপূর্ণ কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারেন, তাহলে আর কখন পদক্ষেপ নেওয়া হবে, জানা মুশকিল।

রক্তেভেজা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা বিদায় নিয়েছে, কিন্তু গোটা ফ্যাসিবাদীব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে তারা আবার নতুনভাবে সংগঠিত হতে শুরু করেছে। কেবল তাই নয়, ভিন্ন ভিন্ন চেহারায়, ভিন্ন ভিন্ন আদলে রাষ্ট্র ও সমাজের নানা স্তরে নতুন ফ্যাসিবাদী ধ্যানধারণা আবার জায়গা করে নিচ্ছে। সাধারণ এক বিশ্ব অভিজ্ঞতা হচ্ছে গণজাগরণ, গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব মানুষকে মুক্ত করে, তাদের অধিকার ও মুক্তির পথ প্রশস্ত করে। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসও তার সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু এবারকার গণ-অভ্যুত্থানের বিশাল অর্জনের পরও তার স্ববিরোধিতা এই যে, এবারকার গণ-অভ্যুত্থান অল্পদিনের জন্য এক ভয়ংকর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মানুষকে মুক্ত করেছে, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে সত্য; বাধাহীন মুক্ত পরিবেশের অনুভূতিও জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু মুক্তির এ আবাহন ছিল স্বল্পস্থায়ী, ক্ষণিকের। মুক্তির সবুজ বর্ণিল রং কিছুদিন যেতে না যেতেই ধূসর আর বিবর্ণ হতে শুরু করে।

এটা তো লুকানোর কিছু নেই, এ গণ-অভ্যুত্থান মতাদর্শ, রাজনীতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এক ধরনের আরও দক্ষিণপন্থার উত্থানের জমিন তৈরি করেছে, সামাজিক-রাজনৈতিক ভারসাম্য আরও খানিকটা ডাইনে নিয়ে গেছে। মুখে অস্বীকার করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদ ও কর্মকাণ্ড এ প্রক্রিয়াকে জোরদার করেছে, সহায়তা জুগিয়ে আসছে। ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান রাষ্ট্র ও সমাজের গণতান্ত্রিক উত্তরণের এক বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে সন্দেহ নেই। গত নয় মাসে এ সুযোগ অনেকখানি নষ্ট হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম কমাসে বাস্তবিক অর্থে পরিবর্তনের যে সুযোগ ছিল, তা এখন আর নেই। মাফিয়া ও দুর্বৃত্তকবলিত অর্থনীতি ও রাজনীতির খানিকটা গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল; প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও সিদ্ধান্তমূলক উদ্যোগের অভাবে তা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক দুর্নীতির মেগাস্টার দুর্বৃত্ত মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে সুযোগ ছিল, তাকে কাজে লাগানো হয়নি। জানা-অজানা নানা ধরনের অশুভ আঁতাতের মধ্য দিয়ে তারা আবার জেঁকে বসেছে। অর্থনীতি ও রাজনীতির অনেকখানি এখন আবার তাদের নিয়ন্ত্রণে। এরাই যেখানে এখনো অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ামক শক্তি, সেখানে গত জুলাই-আগস্টের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিপ্লব দেখার অবকাশ নেই। যারা এ পরিবর্তনকে বিপ্লব বলছেন, তাদের একাংশের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিপ্লবের সাইনবোর্ডে তাদের কাজ-অকাজ, জবরদস্তি ও অনাকাঙ্ক্ষিত তৎপরতাকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়া।

তবে গণ-অভ্যুত্থান দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের যে সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তাকে এখনো খানিকটা কাজে লাগানোর সুযোগ ও সময় রয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন-উত্তর বাংলাদেশ উদার গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির দিকে হাঁটতে পারে। সংবিধানসহ গোটা শাসনব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতির গণতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশে জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কেবল ভোটের শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের নিশ্চয়তা বিধান করা গেলে কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনের বিপদ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

উচ্চাভিলাষী না হয়ে রাজনৈতিক দিক থেকে অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা গেলে উত্তরণের কাজটা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। গণতান্ত্রিক উত্তরণের বাইরে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কোনো এজেন্ডা থাকার কথা নয়। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব কমিয়ে এনে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সংস্কার ও নির্বাচনের লক্ষ্যে বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াই এখন প্রধান কাজ।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় নয় মাস পার হলেও এখনো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতা ও বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ কী হবে, তা নির্ভর করছে নির্বাচনের আগের কাজগুলো কী হবে তার ওপর। নির্বাচন কমিশন বলছেন, ডিসেম্বর ২০২৫ কে লক্ষ্য ধরে তারা যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজও আগামী দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে গুছিয়ে আনা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমঝোতা সনদও এর মধ্যে স্বাক্ষর করা সম্ভব। আর আইসিটি ট্রাইব্যুনালের কাজে গতি আনতে পারলে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারের কাজও আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দৃশ্যমান করে তোলা সম্ভব। বাকি থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের প্রস্তুতি। সরকার উপযুক্ত মাত্রায় তৎপর হলে আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের জন্য যাবতীয় প্রশাসনিক প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা সম্ভব। বাকি থাকে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকলে এ বছরের মধ্যেই, এমনকি ডিসেম্বরের আগেও দেশের মানুষের বহুল কাঙ্ক্ষিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।

আমাদের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের আট মাস পার হলেও দেশের ভেতরে-বাইরে এ গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তিসহ নানা অশুভ গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। ৫ আগস্টের পরিবর্তনকে এখনো তারা মেনে নিতে পারেনি। তাদের বাংলাদেশবিরোধী বহুমাত্রিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সংস্কার ও নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশে আরও অস্থিশীলতা বেড়ে যেতে পারে, আমাদের সম্মিলিত অর্জনও বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। নানা রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্যেও জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের অবশ্যই জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে হবে। আমরা আশা করব, এ ব্যাপার অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। দেশের মানুষ দেখতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে নতুন করে আর হোঁচট খাবে না, পথ হারাবে না।

এ মুহূর্তে আমাদের আঞ্চলিক পরিস্থিতিও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ও কিছুটা জটিল। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা। আমরা কোনোভাবেই উত্তেজনার অংশ হব না। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেও আধিপত্যবাদী পরাশক্তিগুলোর রয়েছে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত পরস্পরবিরোধী নানা স্বার্থের টানাপোড়েন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কভাবে তার পথ চলতে হবে; বিশেষ কোনো দিকে আমাদের ঝুঁকে পড়ার অবকাশ নেই। বাংলাদেশ কারও বিশেষ কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের গুটি হবে না। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, এরকম যে কোনো পদক্ষেপ আবশ্যিকভাবে আমাদের সযত্নে এড়িয়ে চলতে হবে।

সাইফুল হক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

গণঅভ্যুত্থান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম