ভারত-পাকিস্তান সংঘাত যদি সমুদ্রযুদ্ধে রূপ নেয়!
জেমস স্টাভ্রিডিস
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সপ্তাহ দুয়েক আগে সন্ত্রাসীদের হাতে ২৬ জন পর্যটকের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান একে অপরকে দোষারোপ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ, উচ্চ সতর্কতার পর এখন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। ভারতীয়রা বিশ্বাস করে, পাকিস্তান বহুদিন ধরেই জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বাকে সমর্থনের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট নামের দলটির একটি শাখা এ ঘটনার দায় স্বীকারও করেছে। বুধবার সকালে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পাকিস্তানের নয়টি ‘জঙ্গি অবকাঠামো’তে তারা কেন্দ্রীভূত, পরিমিত ও কম উত্তেজনাকর অভিযান শুরু করেছে।
যদিও কাশ্মীরের যে অংশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তা ভারতের নিয়ন্ত্রণে, তবে দুদেশই এ অঞ্চলটিকে নিজেদের দাবি করে এবং চলমান বিরোধের কারণে সেখানকার সীমান্তে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সৈন্য (যার মধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষিত বিশেষ বাহিনীও) মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। উভয়পক্ষ ভারত মহাসাগরে পণ্য বাণিজ্য ও তাদের শিপিং সম্পর্কিত চুক্তি লঙ্ঘন করছে। এছাড়া ভারত সিন্ধু নদের পানিবণ্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পানিচুক্তিও স্থগিত করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছে, তবে কোনো সুফল এখনো পাওয়া যায়নি।
পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের নেতারা ক্রমাগত উত্তেজনা বাড়াচ্ছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির বলেছেন, ভারতের যে কোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষ থেকে ‘দ্রুত, দৃঢ় ও তীব্র প্রতিক্রিয়া’ দেখানো হবে। সেক্ষেত্রে এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে? তাহলে সত্যিই কি বড় সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা আছে? ভারতের হাতে অবশ্য যুদ্ধের বাইরেও প্রতিশোধের অনেক অপশন রয়েছে। তারা পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমণ চালাতে পারে; ২০১৬ সালের মতো পাকিস্তানের ভূখণ্ডে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বিশেষ বাহিনী পাঠাতে পারে; ২০১৯ সালের মতো নিখুঁত বিমান হামলা করতে পারে; অথবা কাশ্মীর সীমান্ত বরাবর গোলাবর্ষণ শুরু করতে পারে। তবে কোনো পক্ষই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের চিন্তা করবে কিনা, এখন পর্যন্ত তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
ভারত মহাসাগরে বহু দীর্ঘযাত্রা করা একজন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা হিসাবে আমি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত তা হলো, এ সংঘাত সমুদ্র পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে কিনা। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর হিসাবে ভারত মহাসাগরে নৌসেনাদের সাহসী অভিযান চালানোর অনেক অপশন রয়েছে। দুই দেশের নেতারা নৌবাহিনীর ব্যবহারকে তুলনামূলকভাবে কম উত্তেজনাকর মনে করতে পারেন; কারণ এতে কোনো সাধারণ মানুষ নিহত হবে না, সাগরের যুদ্ধ মিডিয়ার নজরদারির বাইরেই ঘটবে এবং যুদ্ধের জন্য এ ক্ষেত্রটি সীমাহীন। ফলে সমুদ্রে যুদ্ধ বাধলে খুব সহজেই তা তীব্র আকার নিতে পারে। নৌবাহিনীর কঠোর অবস্থানের কৌশল দেশ দুটিকে বিস্তৃত যুদ্ধের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।
আমি করাচিতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটিতে বেশ কয়েকবার সফর করেছি এবং আরব সাগরেও ভারতীয় যুদ্ধজাহাজে চড়েছি। দুটি বাহিনীকেই শক্তিশালী ও পেশাদার হিসাবে আমি দেখেছি। ভারতীয় নৌবাহিনী অত্যন্ত সক্ষম, যাদের রয়েছে দুটি বিমানবাহী রণতরী, বহু পৃষ্ঠতলবিশিষ্ট যুদ্ধজাহাজ, ১৬টি আক্রমণাত্মক সাবমেরিন এবং ৭০ হাজারের বেশি নৌযোদ্ধা। তারা দীর্ঘ পরিসরের পি-৮ পোসেইডন নজরদারি বিমানের পাশাপাশি প্রচুর যুদ্ধবিমান এবং পানিপথে সক্ষম হেলিকপ্টার পরিচালনা করে। অপরদিকে, পাকিস্তানের নৌবাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট, মাত্র প্রায় ৩০ হাজার নৌসেনা নিয়ে গঠিত এবং তাদের মূল ফোকাস উপকূলীয় নিরাপত্তায়, যা দেশের স্বল্প উপকূলরেখার জন্য উপযুক্তই বটে। তবে চীন ও তুরস্কের সমর্থন থাকায় তাদের হাতে রয়েছে বহু যুদ্ধজাহাজ এবং আটটি সক্রিয় সাবমেরিনসহ ক্রমশ বাড়তে থাকা সাবমেরিন বাহিনী। পাকিস্তান বাহিনী সমুদ্রে নজরদারির জন্য মার্কিন পি-৩ ওরিয়ন বিমানও ব্যবহার করে। এমনকি উভয় পক্ষেরই মার্কিন সিল বাহিনীর মতো উচ্চ প্রশিক্ষিত বিশেষ সামুদ্রিক বাহিনী রয়েছে।
পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে করাচিতে সপ্তাহান্তে আসা শক্তিশালী তুর্কি যুদ্ধজাহাজ বুয়ুকআদা। এছাড়াও খবর এসেছে যে, আধা ডজন তুর্কি সি-১৩০ পরিবহণ বিমান সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে পাকিস্তানে অবতরণ করেছে। যদিও তুরস্কের সরকার এ দাবিকে অস্বীকার করেছে। তবে যাই হোক, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান স্পষ্টভাবেই পাকিস্তানের প্রতি সমর্থনের সংকেত দিয়েছেন। আশা করা যায়, চীনও শেষ পর্যন্ত ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়াবে। এরপরও ভারতীয় নৌবাহিনী পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর এবং ২ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার কেন্দ্র করাচির কাছাকাছি গিয়ে তীব্র নজরদারিতে এবং বিমান অভিযানে নিয়োজিত থাকবে। সম্ভবত ভারতীয় সাবমেরিন এর আশপাশের পানির নিচে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য থাকবে।
যদিও ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি নৌবাহিনীতে কোনো অপ্ররোচিত, সরাসরি হামলা চালানো সম্ভব নয়। সেটা বন্দরেই হোক কিংবা খোলা সাগরে, ভারতের সামরিক শক্তির প্রদর্শনী নিজের জন্যই অত্যন্ত উত্তেজনাকর হতে পারে এবং তা পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজগুলোর তরফ থেকে আক্রমণাত্মক অভিযান চালানোর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আমার উদ্বেগ, উভয়পক্ষ এটিকে সমুদ্রে ‘চিকেন গেম’ হিসাবে দেখবে, যা কোনো না কোনোভাবে স্থলভিত্তিক সামরিক অভিযানের তুলনায় কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করবে।
যদিও বিষয়টি নিয়ে এতটা নিশ্চিত হওয়া ঠিক নয়; কিন্তু আমার শুধুই শীতল যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস ‘দ্য বেডফোর্ড ইনসিডেন্টে’র কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, যেখানে মার্কিন ও সোভিয়েত নৌবাহিনী গ্রিনল্যান্ডের উপকূলে উত্তেজনাকর ও বিধ্বংসী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কম পরিসরে হলেও ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতি ভারত মহাসাগরের উত্তর অংশে ঘটতে পারে। সেটি ঘটলে মার্কিন নৌবাহিনীর ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের অবস্থানও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমার মতে, তাই ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্যই কাশ্মীর এবং এ অঞ্চলই শুধু নয়, ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে উত্তেজনা বৃদ্ধিকেও এড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ব্লুমবার্গ থেকে ভাবানুবাদ : খালিদ বিন আনিস
জেমস স্টাভ্রিডিস : টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোম্যাসির ডিন ইমেরিটাস, কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল, ন্যাটোর সাবেক সুপ্রিম অ্যালাইড কমান্ডার
