Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দুর্ভিক্ষের সেই স্মৃতি এখনো কাতর করে

Icon

এলাহী নেওয়াজ খান

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্ভিক্ষের সেই স্মৃতি এখনো কাতর করে

১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ। ফাইল ছবি

বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান অতিথির ভাষণে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। মনে হলো, তিনি বুঝি চোখের পানিতে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের স্মৃতিচারণ করছেন। কিংবা বলা যায়, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রচণ্ড আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। যারা সে সময় চুয়াত্তরের সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং দুঃসহ কষ্ট নিয়ে দিন যাপন করেছিলেন, তারা নিঃসন্দেহে প্রফেসর ইউনূসের এ কান্নাকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। ঢাকায় সেই দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস ছিল খুবই ভয়াবহ। যারা তখন ঢাকায় বাস করতেন, তারা দেখেছেন সদ্য স্বাধীন দেশে মানবসৃষ্ট সেই মানবিক বিপর্যয় কতটা ভয়াবহ ছিল।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মার্চ মাসে আর শেষ হয়েছিল ডিসেম্বরে। ঠিক একইভাবে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছিল মার্চ মাসে আর শেষ হয়েছিল ডিসেম্বরে। অর্থাৎ নয় মাস ধরে প্রতিটি শহরে, নগরে, গ্রামে, পথে, প্রান্তরে চলেছিল ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার, আর মৃতদের শবযাত্রা।

তখন কঠিন নিবর্তনমূলক শাসন এবং সংবাদপত্রে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা সত্ত্বেও দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক সংবাদ, গণকণ্ঠ, সাপ্তাহিক হক কথা, ডেইলি অবজারভার ইত্যাদি দৈনিক পত্রিকাগুলোতে কমবেশি দুর্ভিক্ষের খবর ছাপা হতো। সেসব খবর ছিল হৃদয়বিদারক। ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না সহ্য করতে না পেরে পিতা তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে ছুড়ে মারছে পানিতে। খাবার দিতে অপারগ মা শিশুকে হত্যা করছে। যৎসামান্য যা কিছু ত্রাণ প্রদান করা হতো কিংবা যেসব নোঙরখানা খোলা হয়েছিল, সেখানেও খাদ্য ছিল অপ্রতুল। আর বেশিরভাগ নোঙরখানাই শহর এলাকায়। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ নোঙরখানায় ভিড় জমাত। প্রয়োজনের তুলনায় নোঙরখানার সংখ্যা ছিল অনেক কম। ফলে দীর্ঘক্ষণ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরও না খেয়ে ফিরে আসতে হতো অনেককেই।

আর তখন যারা গ্রামেগঞ্জে বাস করতেন, তাদের পরিণতি সম্পর্কে খুব কমই জানা যেত। কারণ সেসময় তো এখনকার মতো এত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না প্রযুক্তির এত উন্নততর ব্যবহার। আজ যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অত্যন্ত গ্রামের একটি ছোট্ট ঘটনার খবরও মুহূর্তের মধ্যে আমরা পেয়ে যাই। তাই ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কথা বলতে গিয়ে প্রফেসর ইউনূসের চোখে ভেসে উঠেছিল না খেয়ে মরে পড়ে থাকা কঙ্কালসার কৃষিজীবীর মুখোচ্ছবি। দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের করুণ দুর্দশার কথা হয়তো মনে পড়ায় প্রফেসর ইউনূস আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন, তখন গ্রামগঞ্জের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। ফি বছর পানিতে ডুবে যেত পথঘাট, মাঠ, পথপ্রান্তর। যে বছর আকস্মিক বন্যায় ধান-পাট নষ্ট হয়ে যেত, সে বছর কষ্টের আর সীমা থাকত না। ’৭৪ সালেও একটা বড় বন্যা হয়েছিল। বছরে একবারই ধান উৎপাদন হতো। ধানের মধ্যে ছিল আউশ, আমন ও বোরো। নগদ ফসল বলতে ছিল শুধু পাট। তখন গ্রামে নগদ টাকার প্রচলন খুব কমই ছিল। মানুষ ধান-চালের বিনিময়ে কেনাকাটা করত। একটু বড় গৃহস্থদের মধ্যে যারা পাট উৎপাদন করত, তারাই কেবল নগদ টাকা চোখে দেখত। কৃষিকাজ ছাড়া বিকল্প কোনো আয়ের উৎস ছিল না। এখন গ্রামে বিকল্প অনেক আয়ের উৎস সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, বছরে তিনবার ফসল উৎপাদিত হয়। রিকশা, ভ্যান-অটোরিকশা ছাড়াও অনেক ধরনের যানবাহন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বরং এসব কারণে এখন কৃষিকাজের লোকই খুঁজে পাওয়া যায় না। আগেই উল্লেখ করেছি, তখন নগদ টাকার প্রচলন ছিল খুব কম, এখন যেমন একজন ভিক্ষুকের পকেটেও নগদ টাকা থাকে। আর সে সময় তা কল্পনাও করা যেত না। গ্রামে গরিব মানুষ পেটে ভাতে জন দিত। অর্থাৎ দুবেলা খাবারের বিনিময়ে তারা কৃষিকাজে শ্রম দিত। এরকম এক সামাজিক পটভূমিতে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ কতটা মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছিল, তা সহজেই বোঝা যায়।

এসবের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং বিদেশ থেকে আসা কোটি কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী লুটপাট ও ভারতে পাচারের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছিল। আর স্বাধীনতার পর মাত্র এক বছরের মাথায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে যায়; যা ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো। তখনকার এ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি হিসাব আমরা দেখতে পাই প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ অলি আহাদের লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-’৭৫ শীর্ষক গ্রন্থটিতে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এক টাকার গামছার দাম হয় সাত টাকা। ৫ টাকার শাড়ির দাম হয় ৩৫ টাকা। ৩ টাকার লুঙ্গি ১৫ টাকা বা কুড়ি টাকা, দশ আনা বা বার আনার চাউল দশ টাকা। আট আনা সেরের আটা ৬-৭ টাকা। দুই আনা সেরের কাঁচামরিচ ৪০-৫০ টাকা। তিন-চার টাকা সেরের শুকনো মরিচ ৮০-৯০ টাকা। আট আনা সেরের লবণ ৪০-৫০ টাকা। পাঁচ টাকা সেরের সরিষার তেল ৩০-৪০ টাকা। সাত টাকা সেরের নারিকেলের তেল ৩০-৪০ টাকা। এক টাকা সেরের মসুরির ডাল ৮-৯ টাকা। সাত টাকার লাঙল ৩০-৪০ টাকা। ৬ টাকার কোদাল ৩০ টাকা। ১৩৭ কিংবা দেড়শ টাকা ভরি স্বর্ণ ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। ১৫ টাকার কাফনের কাপড় ৮০-৯০ টাকা। দেড় টাকার কাঁচা সাবান ৮-৯ টাকা।

স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মাথায় ওইভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি কৃষিভিত্তিক সমাজে কতটা আঘাত আনতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তার ওপর দুর্ভিক্ষের ভয়ানক থাবায় গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোতে নেমে এসেছিল অবর্ণনীয় দুঃখ ও দুর্দশা।

ভয়াবহ এ দুর্ভিক্ষের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারই দায়ী ছিল। কারণ সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের বাধা বন্ধনহীন লুটপাট, অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহ, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভয়াবহ দুর্বলতা পরিস্থিতিকে চরম সংকট পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং এ দুর্ভিক্ষের জন্য দেশে-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা দায়ী বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করা হয়, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কারণ সে সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রিলিফের মালামাল বিক্রি করে রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। ঢাকায় আরেকটি বিষয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হচ্ছে, রেশন শপে ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে মালামাল এলে আওয়ামী লীগ নেতারা রাতেই তা উধাও করে দিত।

আমরা তখন গুলবাগে থাকতাম। আমাদের বাসার কাছেই ছিল একটি রেশন শপ। আর মৌচাক মার্কেটে দিকে উলটো পাশে এখন যেখানে ইউএনবি বিল্ডিং, এখানে ছিল একটি ন্যায্যমূল্যের দোকান। ঢাকায় আরও বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ন্যায্যমূল্যের দোকান ছিল। রেশন শপে চাউল-ডাল আসছে শুনে আগের রাতেই লোকজন সারি সারি ইট দিয়ে লাইন বানিয়ে রাখত। ফজরের নামাজ পড়েই যার যার ইটে দাঁড়িয়ে লাইন ধরত। তারা জানতই না, রাতেই মালামাল এদিক-ওদিক হয়ে গেছে। সকাল ৯টায় রেশন শপ খোলা হতো। শুরু করার কিছুক্ষণ পরই বলা হতো সব শেষ হয়ে গেছে। তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা লাইনের বাকি লোকগুলোর মুখ হতাশায় ফ্যাকাশে হয়ে যেত। এখানে উল্লেখ করতে হয়, দুর্ভিক্ষে মূলত ছিন্নমূল মানুষ সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল। ঢাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূলত রেশন শপের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার লড়াই করছিল। পরিবারগুলোর পাঁচ-দশটা করে রেশন কার্ড থাকলেও সেসময় আওয়ামী লীগের নেতারা ১০০-১৫০ কার্ড বানিয়ে নিয়েছিল।

সে সময় সবচেয়ে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল শিশুরা। শিশু খাদ্যের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ছিন্নমূল মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছিল, আর মধ্যবিত্তের শিশুরা কোনোরকম এটা-সেটা, সুজি ইত্যাদি কিছু খেয়ে ধুঁকছিল। আমি দেখেছি ন্যায্যমূল্যের দোকানে দুধ এসেছে শুনে মহিলাদের লম্বা লাইন পড়ে যেত। সে লাইন মৌচাকের সামনে থেকে চলে যেত মগবাজার ওয়্যারলেস পর্যন্ত। এখানেও একই ঘটনা ঘটত। আগের রাতেই সব গায়েব হয়ে যেত। সকালে কিছু দেওয়ার পর বলা হতো শেষ, আর নেই। এভাবেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল।

এখন এটা কারও পক্ষে ভাবাই সম্ভব না যে, মানবসৃষ্ট একটা দুর্ভিক্ষ মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ১৫ লাখের মতো মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। আমরা সে দুর্ভিক্ষ দেখেছি। প্রত্যক্ষ করেছি, আল্লাহতায়ালার সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ কীভাবে না খেয়ে কিংবা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে রাস্তায় মৃত্যুবরণ করে রাস্তায় পড়ে থাকত। আর আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম কুড়িয়ে কুড়িয়ে দাফন করত। দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ক্ষুধার্ত মানুষের বমি খাওয়ার ছবি কিংবা কুড়িগ্রামে পরনের কাপড় বিক্রি করে জাল পেঁচিয়ে বাসন্তীর লজ্জা নিবারণের সেই ছবি অথবা একটি থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা হাড্ডিসার সেই শিশুটির ছবি এখনো চোখে ভাসে।

আমরা দেখতাম আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িতে লাশের স্তূপ। প্রতিদিনই তারা অসংখ্য লাশ দাফন করত। এটি ছিল প্রতিদিনের চিত্র। ঠিকানাবিহীন এসব মানুষের মৃত্যু কোথায় হয়েছিল কিংবা কোথায় দাফন করা হয়েছে, তা হয়তো তাদের স্বজনদের কাছে আজও অজানাই রয়ে গেছে।

এলাহী নেওয়াজ খান : সিনিয়র সাংবাদিক

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম