Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মিঠে কড়া সংলাপ

আশা-নিরাশার দোলাচলে

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আশা-নিরাশার দোলাচলে

কিছুদিন হলো আমেরিকায় মেয়ের বাড়িতে এসে দেশের খবরাখবর রাখার জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে যা জানতে ও বুঝতে পারছি তাতে মনে হচ্ছে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করছে। সামনে কী ঘটতে চলেছে, দেশ কোনদিকে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে কে বা কারা কীভাবে দেশ চালাবেন ইত্যাকার প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। আজকাল হোয়াটসঅ্যাপসহ কথা বলার বিভিন্ন পদ্ধতি ও মাধ্যম থাকায় পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকেই দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। তেমনি আমিও আমার পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, তাতে রীতিমতো অবাক হয়েছি বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ একজন সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘ভাই দেশের ভবিষ্যৎ কী?’ প্রত্যুত্তরে আমি তাকে বললাম, সেসব সংবাদ তো আমাদেরই আপনাদের কাছ থেকে পাওয়ার কথা। আবার পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি আমাকে বললেন, ‘দেশের পুঁজিবাজার তো ধ্বংস হয়ে গেল, পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ শোনার মতো কোনো লোকও তো এখন নেই, সরকারপ্রধানসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তাদের কেউই পুঁজিবাজারের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন না বা এদিকটা দেখার সময় পাচ্ছেন না।’ আমাদের বর্তমান সরকারপ্রধান শুধু একজন দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ নন, সারা পৃথিবীর মানুষ তাকে একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ হিসাবে জানেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের পুঁজিবাজারের এমন দশা কেন, সেটা আমি নিজেও সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছি না।

আরও অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানের পর যেভাবে মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিলেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে আশায় তারা বুক বেঁধেছিলেন, সেসব ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও তারা যেন আশাহত হয়েছেন। যদিও বলা হতে পারে, গত সরকার সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে; কিন্তু তারা যেখানে শেষ করে যতটুকু রেখে গেছে, সেখান থেকে শুরু করলেও তো বর্তমান সরকারের এতদিনে অন্তত কিছুটা হলেও সাফল্য দেখানো উচিত; কারণ মেঘে মাঘে এ সরকারের বয়সও তো নয় মাস পূর্ণ হলো।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের তরুণ তুর্কিরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কায়েমি স্বার্থবাদীদের হঠানোর পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তরুণ তুর্কিরা সেদিন অমিত তেজ এবং অকুতোভয় চিত্তে লড়াই করে শেখ হাসিনার লালিত-পালিত পুলিশ বাহিনীকে তুলাধোনা করে ফেলায় শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সে অবস্থায় শত শত তরুণ তুর্কিকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় এবং হাজার হাজার বিপ্লবী ছাত্র-জনতা আহত হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেন। কারণ শেখ হাসিনা অবৈধভাবে তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য বেসরকারি পেটোয়া বাহিনীসহ হাজার হাজার পুলিশ সদস্যকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। ফলে আহত ও নিহতদের কাতারে অসংখ্য বিপ্লবী ছাত্র-জনতাকে যেমন আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল, তেমনি কায়েমি স্বার্থবাদী শেখ হাসিনার গদি রক্ষার জন্য অবৈধ কাজে নিয়োজিত প্রচুর পুলিশ সদস্যও আহত ও নিহত হয়েছিলেন। তাছাড়া অনেক পুলিশ সদস্য পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। শেখ হাসিনার ভুল রাজনীতি এবং অতিরিক্ত ক্ষমতালিপ্সার কারণেই এসব কর্মকাণ্ডসহ ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল।

অতঃপর নয় মাস অতিবাহিত হয়েছে। ইতোমধ্যে তরুণ তুর্কিদের একদল সদস্য একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যতদূর জানতে ও বুঝতে পারা যাচ্ছে তা হলো, কিছুটা সময় নিয়ে ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে নির্বাচন করতে হলে যতটা সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজন হয়, কূটকৌশল আয়ত্ত করতে হয়, এনসিপির মতো ছাত্রসমাজ দ্বারা গঠিত একটি নতুন দলের পক্ষে তা সম্ভব কিনা। কারণ রাজধানীর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মফস্বল শহরের কলেজ শিক্ষার্থীরা নবগঠিত রাজনৈতিক দলটির পক্ষাবলম্বন করে নির্বাচনি ময়দানে নামলেও থানা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে তাদের সংগঠিত কোনো শক্তি থাকবে বলে মনে হয় না। আর সে অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি মহাযজ্ঞে নেমে নবগঠিত এনসিপি কতদূর কী করতে পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

অপরদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির শক্তি সম্পর্কে বোধহয় কারও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কারণ শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দলটি এখনো স্বমহিমায় ভাস্বর। জিয়াউর রহমানের সরল জীবনযাপন ও সততার কারণে তার মৃত্যুর এতদিন পরও তিনি দেশের মানুষের মনে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। যদিও বর্তমান অবস্থায় দলটির একশ্রেণির নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই নয় মাসে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারামারি, হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ায় বিএনপির দলীয় ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে। যদিও দলীয় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। আমরা যারা লেখালেখি করি, তারা নিজেরাও অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পাঠকদের সামনে সেসব ঘটনা উপস্থাপন করে থাকি। এখানে আমি তেমনই একটি উদাহরণ তুলে ধরে বিএনপি হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

গত রমজান মাসে এক ব্যক্তি তার নিজ গ্রামের দরিদ্র মানুষের মধ্যে কিছু বস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে গেলে জনৈক বিএনপি কর্মী ফোন করে তার কাছে চাঁদা দাবি করে বলেন, ‘তার সঙ্গে থাকা এবং চলাফেরা করা ছেলেদের জন্য তাকে কিছু টাকা দিতে হবে!’ সে অবস্থায় ভদ্রলোক তাকে জানান, তিনি কোনো নগদ টাকা তাকে দিতে পারবেন না, প্রয়োজনে কিছু শাড়ি, লুঙ্গি এবং কয়েকটি পাঞ্জাবি নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ জানালে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে রাগত স্বরে বলা হয়, ‘ওসব আপনি দেন, আমাদের টাকা দিতে হবে।’ অতঃপর ভদ্রলোক কোনো টাকা-পয়সা না দেওয়ায় ঘটনাটি অনেকদূর পর্যন্ত গড়ায়। কয়েকদিনের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে অজ্ঞাত একটি ব্লগের মাধ্যমে অপপ্রচার শুরু হয়ে যায় এবং সেই ব্লগে লেখা মিথ্যা তথ্যগুলো একটি ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। ভদ্রলোক বিষয়টি জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট ব্লগারকে শনাক্ত করতে না পারলেও ফেসবুকের অ্যাডমিনদের শনাক্ত করে দেখতে পান যে, তাদের সবাই চাঁদা দাবিকারীর অত্যন্ত কাছের মানুষ।

ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করার কারণ হলো, বিএনপি হাইকমান্ড যাতে জানতে ও বুঝতে পারেন, তাদের অজ্ঞাতসারে কীভাবে একশ্রেণির বিএনপি নামধারী তলে তলে তাদের ক্ষতি করে চলেছে। বিএনপির হাইকমান্ড এসব লোকদের জানে বা চেনে কিনা জানি না, তবে দেশের মানুষ কিন্তু ইতোমধ্যেই তাদের কার্যকলাপে ভীত হয়ে উঠেছেন। কারণ এই শ্রেণির মানুষ যেহেতু কোনো দলীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতি করে না বা দলের প্রতিষ্ঠাতা এবং দলীয় হাইকমান্ডের আদর্শ ধারণ না করে শুধু অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে রাজনীতি করে, তাই তাদের সম্বন্ধে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগেই দলের নাম ভাঙিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করা এই শ্রেণির মানুষকে দল থেকে বহিষ্কার করতে না পারলে দেশের মানুষের কাছে ভুল মেসেজ পৌঁছে যাবে।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা

আশা নিরাশা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম