Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

গৌতম বুদ্ধের দর্শন : গণতন্ত্র ও যুক্তিবাদ

Icon

সুশীল বড়ুয়া

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গৌতম বুদ্ধের দর্শন : গণতন্ত্র ও যুক্তিবাদ

ইতিহাসবিষয়ক গবেষকদের মতে, গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩ সালে। তার পিতার নাম শুদ্ধোদন এবং মাতার নাম মায়াদেবী। পিতা শুদ্ধোদন ছিলেন শাক্যদের রাজা। উল্লেখ্য, তখনকার রাজ্যগুলো ছিল প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের আগে অন্তত দুই শতাব্দী ছিল চার্বাক দর্শনের (লোকায়ত) প্রভাব। চার্বাক দর্শন ছিল বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী। ইহজাগতিকতা ছিল চার্বাক দর্শনের মূল ভিত্তি। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বৌদ্ধ দর্শনের পশ্চাৎভূমি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যদিও বা লোকায়ত দর্শনের প্রভাব ছিল; কিন্তু সমকালীন সমাজব্যবস্থার মধ্যে অদৃষ্টবাদ ও ভক্তিবাদের প্রাধান্য ছিল ব্যাপক এবং সমাজ ছিল স্থবির। তখন বর্ণবাদ, জাতিভেদ, যাগযজ্ঞ ও দেবতার নামে পশুবলি-ধর্মের নামাবলি পরিয়ে সমগ্র সমাজব্যবস্থাকে নানা প্রথার শৃঙ্খলে বন্দি করে রেখেছিল ব্রাহ্মণ্য পুরোহিতরা। প্রাচীন ভারতীয় স্থবির সমাজে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব একটি বিপ্লবী ঘটনা, এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।

বৌদ্ধ দর্শন বুদ্ধের চার নীতির মধ্যে নিহিত-১. অদৃশ্য শক্তিকে (নিরীশ্বরবাদী) অস্বীকার করা; অন্যথায় ‘মানুষ স্বয়ং নিজের প্রভু’-এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয়, ২. আত্মাকে স্বীকার না করা, ৩. কোনো গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে স্বীকার না করা, ৪. জীবনপ্রবাহকে এ শরীরের মধ্যেই সীমিত মনে করা।

অদৃশ্য শক্তিকে (ঈশ্বর) স্বীকার করে নিলে মানুষ তার অধীন, মেনে নিতে হয়। বুদ্ধ মনে করেন, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা। তিনি মনে করেন, বিশ্ব বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তা মানুষেরই চেষ্টার ফসল এবং বিশ্বের ভবিষ্যৎও মানুষের হাতে। বুদ্ধের মতে, মানুষের নিজস্ব কর্মের স্বাধীনতার মধ্যে ধর্ম সার্থক হতে পারে।

বৌদ্ধ দর্শন হলো নিরীশ্বরবাদী অর্থাৎ পরমাত্মায় বিশ্বাসী নয়। মূলগতভাবে নিরীশ্বরবাদ বলতে বোঝায় সেই মতবাদ-যা আত্মা বা পরমাত্মার অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে না। মানবতাবাদ ও আত্মা বা পরমাত্মার অস্তিত্বকে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিধানকে মান্য করে না। নিরীশ্বরবাদে যুক্তিহীন আধ্যাত্মবাদী চিন্তাকে বাতিল করে। মানবতাবাদীর মধ্যে দার্শনিক আত্মোপলব্ধি রয়েছে। সে যুক্তির পথ ধরে সবকিছুকে বিচার করে, তার মধ্যে থাকে সুন্দর সমাজ বিকাশের প্রেরণা, মানুষকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রেরণা। ‘নিরীশ্বরবাদ’ মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ হয়ে ওঠে।

বুদ্ধ দর্শনের একটি ভিত্তিপ্রস্তর হলো ‘অনাত্ম’ তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুসারে মানুষের দেহের মধ্যে স্বতন্ত্র ও অপরিবর্তনীয় কোনো সত্তা নেই, যাকে সে ‘আমি’ বলে ভাবতে পারে। মানুষ মোহের বশে এ রকম একটি আমিত্বে বিশ্বাস করে এবং এ মোহই তার দুঃখের কারণ। বুদ্ধ মানুষকে পাঁচটি অংশে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করেন : রূপ (form), বেদনা (feeling), সংজ্ঞা (perception), সংস্কার (volitional action) ও বিজ্ঞান (consciousness)। এগুলোকে একেকটি স্কন্ধ বলা হয়। এ পঞ্চ মিলেই মানুষ। রূপ হলো মানুষের জড় দেহ, বেদনা হলো সব রকম অনুভূতি, সংজ্ঞা হলো কোনো বিষয়কে শনাক্ত করা, সংস্কার হলো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্ম এবং বিজ্ঞান হলো চেতনা। সুতরাং পঞ্চ স্কন্ধের কোনটি আত্মা নয়। বুদ্ধ দর্শন মতে, মানুষ যেহেতু পঞ্চ স্কন্ধের সমষ্টি, তাই মানুষের মধ্যে আত্মা বলে কিছুই নেই। যে দর্শনে অনাত্মাকে কেন্দ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে, সেই ধর্মীয় দর্শনে পুনর্জন্মের কোনো স্থান নেই। বুদ্ধ কোথাও পুনর্জন্মের কথা বলেননি।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ভারতবর্ষে যেসব জনগোষ্ঠী একের পর এক এদেশে এসে বসবাস করছে, তাদের অনেকের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও অভ্যাস এবং সংস্কার ও ধ্যান-ধারণা নবসৃষ্ট ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ভাবলোকে পুষ্ট হয়েছে। অস্ট্রীয়ভাষী আদি অস্ট্রেলীয়রা মৃত্যুর পর জীবনে বিশ্বাস করত-মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা কোনো পাহাড়, গাছ, জন্তু বা পাখির জীবনকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে। হয়তো কালক্রমে পরবর্তীকালে এ ধারণা পুনর্জন্মবাদ তত্ত্বে পরিণত হয়। তাই এখনো ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে যুক্তিহীন জন্মান্তরবাদ বিদ্যমান।

কর্মের স্বাধীনতার জন্য বুদ্ধির স্বাধীনতার প্রয়োজন। তাই বুদ্ধির স্বাধীনতার জন্য কোনো গ্রন্থের অধীনে আবদ্ধ থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। জিজ্ঞাসাই বিশ্বে বড় বড় আবিষ্কারের সৃষ্টিকর্তা। বিশ্বে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা, সাহিত্য, সংস্কৃতির যে প্রগতি ঘটেছে, তা ছিল মানুষের অনুসন্ধিৎসু কর্মের ফসল। কোনো গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ মানলে তা হতো না।

জীবনপ্রবাহকে এই শরীরের আগে ও পরে স্বীকার করে নিলে নিতান্ত নিষ্কর্মা ব্যক্তির কাছ থেকেও উন্নতি আশা করা যায়। কোনো উচ্চাদর্শের জন্য; লোক, সমাজ কিংবা অন্য ব্যক্তির উৎকর্ষের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত এ রকম ব্যক্তি পর্যাপ্ত সংখ্যায় পাওয়া যেতে পারে, যদি তারা বুদ্ধের এ দর্শনে আস্থাশীল হয়।

বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন এ চার সিদ্ধান্তের ওপর দণ্ডায়মান। প্রথম তিনটি সিদ্ধান্ত বৌদ্ধধর্মকে অন্যান্য ধর্ম থেকে পৃথক করে। কিন্তু চতুর্থ সিদ্ধান্তটি ব্যক্তির ভবিষ্যৎকে আশাপ্রদ রূপে দেখার এক সুন্দর প্রচেষ্টা, প্রকৃতপক্ষে যা না থাকলে কোনো আদর্শবাদই কার্যকর রূপ পেতে পারে না।

বৌদ্ধধর্ম হলো মধ্য পথের ধর্ম। বৌদ্ধধর্ম অতিরিক্ত ভোগ এবং অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রসাধন-এ দুই চরম পথকে পরিহার করে মধ্যবর্তী পথ অনুসরণ করে। গৌতম বুদ্ধ মানবসমাজের মঙ্গলের জন্য তথা প্রকৃতির মঙ্গলের জন্য এ মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেন।

বৌদ্ধ দর্শন হলো সাম্যবাদের মূল ভিত্তি। মার্কসীয় দর্শনে কমিউন প্রথাটা বৌদ্ধ দর্শনের ‘সংঘ’ থেকে নেওয়া। বৌদ্ধ দর্শনে সংঘের মধ্যে কোনো ব্যক্তিগত সম্পদের মালিক হওয়ার নিয়ম নেই। সংঘের সদস্যরা যা পাবে তা সংঘের কোষাগারে জমা হবে। একই পদ্ধতি মার্কসবাদীরাও মেনে চলে।

বুদ্ধের দর্শন উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা ও মহৎ জীবনব্যবস্থা, যেখানে সূক্ষ্ম নীতিবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে বুদ্ধ তার ধর্মের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেননি। তাই বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে একান্ত যুক্তিনির্ভর। বুদ্ধ বলেছেন, আমার দর্শন তোমরা গ্রহণ করবে কেবল যুক্তি দিয়ে, বিচার করে, কেবল আমার প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধার কারণে নয়।

বৌদ্ধ দর্শনের আরেকটি দিক হচ্ছে, এটি প্রকৃতিবাদী দর্শন। তার শিক্ষা বা চিন্তাধারা শুধু যে ঈশ্বরবাদী অতিজাগতিক ধারণামুক্ত তা নয়, তিনি যে দুঃখময় জগতের কথা বলেন, তা আমাদের অতিপরিচিত এ জগৎ। তার মতে, জীবনের পরমার্থ এবং সব ধরনের দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় যে নির্বাণ, তা এ জগতে লাভ করা যায়, অলৌকিক কোনো জগতে নয়।

বৌদ্ধ দর্শনের মূল বিষয় হলো ব্যক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ। মহাপরিনির্বাণ শয্যায় (মৃত্যু শয্যায়) শায়িত হয়ে বুদ্ধের শেষ বাণী তার শিষ্যদের উদ্দেশে-‘অত্ত দীপ ভব’। অর্থাৎ আপনারে দীপ করে জ্বালো।

সুশীল বড়ুয়া : গবেষক, প্রাবন্ধিক

গৌতম বুদ্ধ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম