|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৯৫ সালের ডেটন শান্তি চুক্তি, যা বসনিয়ার যুদ্ধ শেষ করে; এটি অনুপ্রেরণা এবং একটি কঠোর সতর্কতা উভয়ই প্রদান করে। এটি রক্তপাত থামাতে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনেনি। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, অক্ষম, এবং চিরস্থায়ীভাবে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। ইউক্রেন সেই পথে চলার সামর্থ্য রাখে না। দ্রুত বা বাহ্যিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যা ‘সাম্য’কে অগ্রাধিকার দেয়-ইউক্রেনকে ভগ্ন, দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করার ঝুঁকিও রয়েছে। কাজেই যুদ্ধ শেষ করার জন্য যেকোনো শান্তি গ্রহণের প্রলোভন থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, সব শান্তি সমান নয়।
ডেটন চুক্তি বসনিয়ার মধ্যে দুটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তৈরি করেছিল, প্রতিটির নিজস্ব প্রেসিডেন্ট, সংসদ, প্রশাসন ছিল এবং একটি সম্মিলিত প্রেসিডেন্সির দ্বারা শাসিত হতো। ৩.৫ মিলিয়নের কম জনসংখ্যার জন্য ১৮০ জনেরও বেশি মন্ত্রী-ওই রাষ্ট্রের নানা বিভাজন আলোচনায় আসে। জাতিগত বিভাজন, জাতীয়তাবাদ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদের প্রচেষ্টা-এসব প্রশ্ন বসনিয়ার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
ইউক্রেন একই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হবে, যদি শান্তি চুক্তির আলোকে ডনবাসের মতো রুশ-অধিগ্রহণকৃত অঞ্চলে ‘বিশেষ মর্যাদা’ বা ফেডারেল স্বায়ত্তশাসন প্রদান কর হয়। এমন ব্যবস্থা ইউক্রেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে অকার্যকারিতা ও বিভাজন তৈরি করবে। রাশিয়াপন্থি প্রক্সিরা ভেটো প্রয়োগের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যা মস্কোকে যুদ্ধ ছাড়াই কিয়েভে প্রভাববিস্তারের সুযোগ করে দেবে। আরও খারাপ বিষয় হলো, এটি ইউক্রেনীয় সার্বভৌমত্বে অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থা সৃষ্টি করবে। বসনিয়ার অভিজ্ঞতা দেখায় কীভাবে কাঠামোগত আপস থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক অচলাবস্থা স্থিতিশীলতা নয়, অস্থিতিশীলতাকে গভীর করতে পারে। ইউক্রেনের জন্য এর অর্থ হবে এমন এক ভবিষ্যৎ, যা শান্তির পরিবর্তে স্থায়ী দুর্বল পরিস্থিতি মেনে নেওয়া।
এই গতিশীল আখ্যান সরাসরি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘বৃহত্তর রাশিয়া’ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলো মস্কোর নিয়ন্ত্রণে থাকে। যেমন: বলকান অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো বসনিয়ার সীমানা পুনর্নির্ধারণের চেষ্টা করছে; তেমনই রাশিয়া ইউক্রেনের সংঘর্ষকে সমাধান না করে স্থগিত রেখে সেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
বসনিয়া আরও একটি সতর্কবার্তা প্রদান করে-দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক অভিভাবকত্বের বিপদ। ডেটন চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ প্রতিনিধি কার্যালয় এখনো বসনিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোয় ব্যাপক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। পুনরায় সংঘাত রোধে এটি কার্যকর হলেও এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানগত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং বসনিয়াকে বিদেশের ওপর নির্ভরশীল করেছে। ইউক্রেনকে এমন কোনো শান্তি প্রত্যাখ্যান করতে হবে, যা তার স্বাধীনতা হরণ করে বা তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রাখে।
অস্থায়ী স্থিতিশীলতা প্রয়োজন হতে পারে, তবে কিয়েভকে তার আইন, শাসন এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ হিসাবে থাকতে হবে। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকতে পারে না, যেখানে বিদেশি রাজধানীগুলো তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসাবে কাজ করে।
এ কারণেই ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির ২০২২ সালের আদেশ ‘পুতিন ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় অস্বীকার’ পুনরায় বিবেচনার দাবি রাখে। নৈতিকভাবে এটি যুক্তিযুক্ত হলেও বিশ্ব শক্তির উৎস পরিবর্তিত হলে এটি ইউক্রেনের কৌশলগত সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করতে পারে। শান্তি নীতিগত হতে হবে, তবে কৌশলগতভাবে নমনীয়ও হতে হবে।। কূটনীতিও যুদ্ধের মতোই অভিযোজনের সুযোগ প্রয়োজন।
যখন মার্কিন রাজনৈতিক বাতাস বদলাচ্ছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিত্ব আবার সামনে আসছেন, তখন ইউক্রেনকে একটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক খেলায় বাণিজ্যিক চাল হিসাবে ব্যবহারের ঝুঁকি বাড়ছে। যে কোনো স্থায়ী শান্তি অবশ্যই সার্বভৌমত্ব, ন্যায়বিচার এবং জাতীয় ঐক্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে হবে। ইউক্রেনের বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রয়োজন-শুধু প্রতিশ্রুতি নয়।
অধিকৃত অঞ্চলগুলোকে ইউক্রেনের আইনের আওতায় পুনর্মিলিত করতে হবে-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বা প্রতিপক্ষ পরিচালিত এলাকা হিসাবে অচল অবস্থায় রাখা যাবে না। তাতে বিভাজন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ভবিষ্যতের সংঘাতের ভিত্তি তৈরি হবে।
ইউক্রেনের জন্য একটি সুসংগঠিত এবং ইউরোপীয় সমন্বয়ের পরিকল্পনাও জরুরি। ভৌত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ অপরিহার্য। কিন্তু ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করাও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ইউক্রেনকে সম্পূর্ণ কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে হবে-তার মিত্র নির্বাচন, প্রতিষ্ঠান গঠন এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার, যা মস্কো বা সদিচ্ছাসম্পন্ন পশ্চিমা অংশীদারদের বাধ্যতামূলক প্রভাব থেকে মুক্ত। ইউক্রেন একটি সার্বভৌম জাতি, যার জনগণ স্বনিয়ন্ত্রণের জন্য অসাধারণ মূল্য দিয়েছে। সেটাই যে কোনো শান্তিচুক্তির ভিত্তি হতে হবে- বিদেশি শক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা দ্রুত সমাধানের সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নয়।
ঝুঁকিপূর্ণ সমঝোতা কূটনীতির অংশ হলেও সব সমঝোতা শান্তি আনে না। বসনিয়া আমাদের শেখায়, ত্রুটিপূর্ণ শান্তি বিভাজনকে গভীর করে, আরোগ্য বিলম্বিত করে এবং একটি দেশকে যুদ্ধ ও প্রকৃত সমাধানের মাঝে আটকে রাখে। ইউক্রেনের লক্ষ্য স্পষ্ট, শান্তি অর্জন করা। তবে তা সার্বভৌমত্ব ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ছাড় দিয়ে নয়। যুদ্ধ শেষ করা কঠিন; ন্যায্যতা ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা আরও কঠিন। বসনিয়া প্রথমটিতে সফল হয়েছিল। ইউক্রেনকে দুটোতেই সফল হতে হবে।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মোহাম্মদ কবীর আহমদ
নাদিনা রঙ্ক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
