Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রাজনীতিটা আর ঠিক হলো না!

Icon

মোহাম্মদ হোসেন

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনীতিটা আর ঠিক হলো না!

বাংলাদেশের রাজনীতি দূষণমুক্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতি এতদিনে একটি ঘৃণিত ও বিষাক্ত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা সাধারণ ভুক্তভোগীরা বুঝলেও বাংলাদেশে যারা রাজনীতির ব্যবসা করেন বা নিজেদের রাজনীতিবিদ দাবি করেন, তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারেন না। আর সাধারণ মানুষের অবস্থা হলো ‘আমি তো কম্বল ছাড়তে চাই, কিন্তু কম্বলতো আমাকে ছাড়ছে না’। সাধারণ মানুষ চাইলেও রাজনীতির এ বিষাক্ত আবহাওয়ার বাইরে অবস্থান করতে পারে না। মানুষ যেমন বায়ুমণ্ডলের বাইরে বসবাস করতে পারে না, তেমনই রাজনৈতিক পরিবেশের বাইরেও তার জায়গা নেই। মাঝে মাঝে ভাবি, নিশ্চুপ নিরুত্তাপ জীবন বহন করে তাকে মৃত্যুর বাড়ি, কবরে নিয়ে যাব; কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। তাই রাজনীতির দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে নিতে নিজে যখন বিষক্রিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ি, তখন দূষণমুক্ত হওয়ার চেষ্টায় কাগজ-কলম খুঁজে নিয়ে ওই দূষণ স্খলনের চেষ্টার অংশ এ লেখালেখি।

১৯৭১ সালে লাখ লাখ শহিদ এবং আহত মুক্তিযোদ্ধার রক্ত পান করে আওয়ামী লীগ হজম করে ফেলেছিল। তাই তারা পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আশার ফানুস ফুলিয়েছিল, তা থেকে সরে গিয়ে বাংলাদেশকে এক গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছিল। ফলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকেই সুস্থ রাজনীতির ধারা প্রস্ফুটিত বা বিকশিত হতে পারেনি। তাই রাজনীতি হয়ে যায় কিছু বেকার-বখাটে, চোর, ডাকাত, গুন্ডাদের অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। এভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থার যে অধোগমন শুরু হলো, তা আর রোধ করা সম্ভব হয়নি। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চেষ্টা করেছিলেন নতুন রাজনৈতিক আবহওয়া সৃষ্টির, কিন্তু তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সে ব্যবস্থাকে ভন্ডুল করে দেওয়া হলো। এরশাদ এসে রাজনীতিকে অধঃপাতে নেওয়ার বিষয়ে পিএইচডি করে ফেলল। এখনো তার উত্তরাধিকারীরা এরশাদের ওই থিসিসের ওপরেই চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।

৯০-তে এরশাদীয় রাজনীতির নষ্টামির পতনের পর, এদেশের সাধারণ মানুষ বড় আশায় ছিল যদি একটু বৃষ্টিস্নাত বিশুদ্ধ বাতাসে রাজনীতি দূষণমুক্ত হয়! কিন্তু না, তা হলো না। রাজনীতি তো আর সাধারণ বিষয় নয় যে সাধারণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত মতে সে চলবে! এ এক কুসাধারণ, কুৎসিত, কদর্য বিষয়, কাজেই ঘুরেফিরে ওই চোর, ডাকাত, বেকার-বাখাটে গুন্ডাদের হাতেই রাজনীতির চরকা ঘুরতে থাকে। সেখান থেকে ৯৬-এর উৎপত্তি হয়, উৎপত্তি হয় ২০০৬, ১-১১, ইত্যাদি। শুনেছি ১-১১ সময় অনেক বিজ্ঞ রাজনীতিককে অনেক পদ্ধিতর থেরাপি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তাতে বোধহয় তাদের আদি স্বভাব পরিবর্তন হয়নি। ইতোমধ্যে অনেক রাজনীতিক যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌঁছেছেন; কিন্তু রাজনীতির আবহাওয়া আর তাদের মনোজগতে যেন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

যাহোক, ১-১১ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হলো এক মহাজাগতিক ‘ব্ল্যাকহোল’। রাজনীতি কাহাকে বলে? কত প্রকার ও কী কী? আওয়ামী লীগ তা এ জাতিকে ‘কড়ায় গন্ডায়’ বুঝিয়ে দিয়েছে। ঢাকা শহরের চারপাশে শিল্পাঞ্চলে যেভাবে দূষণ ছড়িয়ে শীতালক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীর পানি দূষিত করে নিকষকালো হয়েছে গত ১৫ বছর ধরে, আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে তেমনই বিষাক্ত করে ফেলেছে। সার্কাসের বাজিকরের মতো কুসাধারণ ভেলকিবাজি দেখিয়ে ১৪, ১৮ ও ২৪-এ তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে যে ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল তা দিয়ে দেশের সব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হলো। অথচ ওই সময়ে সংসদে একজনও ছিল না এর প্রতিবাদ করার মতো। কবি সুকান্তের বোধন কবিতায় আছে ‘তেরশ সালে মধ্যবর্তী মালিক-মজুদদার, মানুষ ছিল কি? হিসাব মেলে না তার’। অনুরূপভাবে ভবিষ্যতে কোনো গবেষক হয়তো এ প্রশ্নই করবে; ২০০৯-২০২৪ সালের আওয়ামী লীগ মানুষ ছিল কি?’ তবে বর্তমানের আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগে কোনো মানুষ ছিল না বা নেই। কেননা এ সময়ে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, গুম, খুন এবং সর্বশেষ ২৪-এর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময়ে আওয়ামী লীগ আর তার সহযোগী দলগুলোর মধ্যে কমপক্ষে যাদের খাতাকলম (পোর্টফলিও) আছে, তাদের মধ্যে থেকে একজন মানুষও জুলাই গণহত্যার বিরুদ্ধে দাড়িয়ে একটা শব্দও উচ্চরণ করেনি।

বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসা পাক বা না পাক, তাতে রাজনীতিবিদদের কী-বা আসে যায়! ডাক্তাররা তাদের পক্ষে থাকলেই হলো। কাজেই বাংলাদেশের প্রায় সব ডাক্তার ঢাকাসহ সব পুরোনো বড় শহরে (বরিশাল বাদে) যে কোনো ব্যবস্থায় থাকবে, সেটা নিশ্চিত করাই স্বাস্থ্য প্রশাসন আর রাজনীতির মুখ্য লক্ষ্য। মানুষের জন্য প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জীবন থাকিলে মৃত্যু হইবে’ এ প্রবাদবাক্য। এটাই কি সাধারণ মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়! এ নিয়ে পাললিক সমভূমীয় বদ্বীপের রাজনীতিকদের কোনো ভাবনা নেই। তাদের দৃষ্টি বিদ্যমান কাঠামোতে আদিম সুখের যে গর্ত/ফুটো আছে, তা কথার ফুলঝুরিরূপী কেশকুঞ্জ দ্বারা আবৃত রাখা, যাতে প্রয়োজন মতো তারা অনন্ত সুখের মৃণয়া করতে পারেন।

দিনের আলোতে তারা যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে রাতকানা রোগ হলেও দিনকানা রোগ যে কী কারণে হয়, বিজ্ঞানীরা এখনো আবিষ্কার করতে পেরেছে কি না জানি না! ক্ষমতার মসনদে আরোহণের যত ধূর্তকৌশল আছে তার চর্চা করা এবং তখতে তাউসে বসার পর আর কোনোদিন তা না ছাড়ার সব জাদুমন্ত্র রপ্ত করা রাজনীতির একমাত্র সাধনার বিষয়। প্রয়োজনে মৃত্যুর পর ফেরাউনদের মতো মমি হয়ে হলেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার উপায়-উপকরণ রপ্ত করাই এ বদ্বীপীয় রাজনীতির আরাধ্য বিষয়। ক্ষমতা হারালে বা ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো হলে কীরূপে আত্মসম্মান সহকারে সমাজে বেঁচে থাকবেন, তার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই এদের হয় না, অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। ক্ষমতা হারিয়ে তখন কর্কশ স্বরযুক্ত প্রাণী বা পাখির মতো উচ্চৈঃস্বরে, কখনো অদ্ভুত স্বরে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করবে! অথবা উপযুক্ত থেরাপি পড়লে চিকার মতো চিঁচিঁ করবে বা দৌড়ে পালাবে। গত ৫৩-৫৪ বছরে এরা বক্তৃতার আর স্লোগানের ভাষাই পরিবর্তন করতে পারেনি।

স্থানীয় গুন্ডা বাহিনীর জন্য তহবিল সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়, যার শতকরা ৭০-৮০ ভাগ লুটেপুটে খায় রাজনৈতিক দলীয় স্থানীয় গুন্ডা-চোর-ডাকাতরা। জনগণের জন্য থাকবে কলার ছোলা। উপজেলা পর্যায়ের শতকরা ৯৫ ভাগ পৌরসভা অকার্যকর-অক্ষম। এ পৌরসভাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না, এ নিয়ে কোনো সভা-সেমিনার এরা করবে না। কেননা, রাজনীতির ক্ষমতা তো ওই গুন্ডাদের পেশিতে বিধৃত। কাজেই ওই পেশির শক্তি অটুট রাখার জন্য ঋণ করে হলেও ঘৃত সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। অনুৎপাদনশীল শিক্ষাব্যবস্থা আর অদক্ষ বেকার লোকদের জন্য নতুন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে কি না, এ বিষয়ে কোনো নীতি-পদ্ধতি বিশ্লেষণ এ দেশের রাজনীতির কাজ নয়। রাজনীতির কাজ হলো এ অক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা আর নিরুপায় বেকারদের কাছে থেকে কী কী ধান্ধা করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধি লাভ করা।

গত ২০০৭-০৮ ‘মই-ফখ’ সরকার এবং ২০০৯-২০২৪ পর্যন্ত ‘খাওয়ামী লীগ’ রাজনীতিকে পাচইনের ওপর রেখেছিল, তাই এর লেজ সোজা ছিল। এখন আবার লেজ বাঁকা হতে শুরু করেছে। ঘোলা রাজনীতির চরিত্র আরও ঘোলা হওয়ার লক্ষণ দৃশ্যমান। আমরা দেখেছি ৯৫-৯৬ এবং ২০০৬-এ আওয়ামী লীগ, বিএনপি আর জামায়াত মিলে পানি ঘোলা করেছে; কিন্তু মাছ শিকার করেছে আওয়ামী লীগ! পাড়া-পড়শিকেও দু-চারটা চেলা-পুঁটি দিয়েছে। রুই-কাতলা, চিতল-বোয়াল নিয়ে লীগ পালাইছে। জামায়াত-বিএনপি তো কিছু শিকার করতে পারেনি বরং নিজেরাই নির্দয়-নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হয়েছিল। এখন হালচাল দেখে মনে হচ্ছে, তারা তা ভুলে গেছে। অথবা অতীতের কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত-কর্মকাণ্ড যে ভুল ছিল, তা তারা বুঝতেই পারছে না বা বুঝতে চাচ্ছে না। এসব ভুলের দায়দায়িত্বও স্বীকার করতে চাচ্ছে না। তারা নিজেদের দুর্ভোগ-ভোগান্তির ছায়ায় জাতীয় দুর্ভোগ-সমস্যা আড়াল করে ফেলতে চাইছে। আমরা যারা বাইরে থেকে দেখছি, তাদের অনুধাবন হলো ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে জামায়াত বা বিএনপির পারদর্শিতা নেই, ওটা আওয়ামী লীগের কর্ম। বর্তমানে যে সাড়ে ত্রিশক্তি রাজনীতির মাঠের পানি ঘোলা করছে, তাতে ত্রিশক্তি কোন মাপের বোয়াল ধরবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তবে সাড়ে শক্তির পূর্ণাঙ্গ শক্তি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হচ্ছে। কাজেই সাধু সাবধান, স্বচ্ছতার পথে হাঁটুন।

মোহাম্মদ হোসেন : লেখক ও বিশ্লেষক

রাজনীতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম