গাজা গণহত্যায় মার্কিন কংগ্রেসের নীরবতার নেপথ্যে
বার্নি স্যান্ডার্স
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমি এমন একটি বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই, যা বিশ্বজুড়ে মানুষ ভাবছে, ভয় পাচ্ছে; কিন্তু কোনো অদ্ভুত কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী বা কংগ্রেসের কক্ষে এ নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়। আর সেটি হলো গাজার ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। গাজায় কোনো মানবিক সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি ৭০ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। নয় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইল সব সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছে : খাবার নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই, জ্বালানি নেই। শত শত ট্রাক জীবনের জন্য অপরিহার্য সরবরাহ নিয়ে গাজার পাশেই অপেক্ষা করছে; কিন্তু ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাদের প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছে।
এখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই, নেতানিয়াহুর উগ্র সরকার মানবিক সাহায্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার কথা প্রকাশ্যেই বলছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেছেন, ‘ইসরাইলের নীতি স্পষ্ট : কোনো মানবিক সাহায্য গাজায় প্রবেশ করবে না এবং এ সাহায্য বন্ধ করাই প্রধান চাপের হাতিয়ার।’ যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে শিশুদের ক্ষুধার্ত করে মেরে ফেলা জেনেভা কনভেনশন, ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্ট এবং মৌলিক মানবিক শিষ্টাচারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। সভ্য মানুষ শিশুদের ক্ষুধায় মরে যেতে দেয় না। গাজায় যা ঘটছে তা হলো যুদ্ধাপরাধ, যা প্রকাশ্য দিনদুপুরে এবং প্রতিদিন অব্যাহত রয়েছে।
গাজায় ২২ লাখ মানুষ বসবাস করে। আজ তারা আটকা পড়েছে। সীমান্ত বন্ধ। ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ক্রমেই ছোট একটি এলাকায় ঠেলে দিচ্ছে। ইসরাইল সব সাহায্য বন্ধ করার পর আমরা যা দেখছি তা হলো ধীরে ধীরে, নির্মমভাবে ব্যাপক ক্ষুধায় ও মৌলিক প্রয়োজনীয়তা থেকে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুর প্রক্রিয়া। এটি পরিকল্পিত, ইচ্ছাকৃত এবং নেতানিয়াহু সরকারের ঘোষিত নীতি। জ্বালানি ছাড়া পানি পাম্প করা সম্ভব নয়; ফলে মানুষ পরিষ্কার খাবার পানি, ধোঁয়া বা রান্নার পানির অভাবে ক্রমেই হতাশাগ্রস্ত। গাজায় আবারও রোগ ছড়াচ্ছে। বেশির ভাগ বেকারি এখন বন্ধ, কারণ জ্বালানি ও আটা শেষ হয়ে গেছে। বাকি থাকা কয়েকটি কমিউনিটি রান্নাঘরও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ এখন দুষ্প্রাপ্য টিনজাত খাবার, যেমন এক ক্যান শিম বা লেন্টিলস পরিবারে ভাগ করে একবার খেয়ে বেঁচে আছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২২ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ লাখেরও বেশি তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে। ক্ষুধা শিশুদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। অন্তত ৬৫ হাজার শিশুর মধ্যে এখন পুষ্টিহীনতার উপসর্গ দেখা যাচ্ছে এবং কয়েক ডজন শিশু ইতোমধ্যে ক্ষুধায় মারা গেছে। মার্চ মাসে যখন নেতানিয়াহু অবরোধ শুরু করেছিলেন, তখন পুষ্টিহীনতার হার ৮০ শতাংশ বেড়েছিল এবং তারপর থেকে পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে খারাপ হয়েছে।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, ‘পরিস্থিতি প্রতিদিন আরও খারাপ হচ্ছে’ এবং তারা প্রায় ১০ হাজার শিশুকে তীব্র পুষ্টিহীনতার জন্য চিকিৎসা দিচ্ছে। পর্যাপ্ত পুষ্টি বা পরিষ্কার পানির অভাবে অনেক শিশু সহজে প্রতিরোধযোগ্য রোগে মারা যাবে, এমনকি ডায়রিয়ার মতো সাধারণ কারণে।
গাজায় আহত লক্ষাধিক মানুষ, বিশেষ করে ইসরাইলি বোমাবর্ষণে অগণিত পুড়ে যাওয়া রোগী তাদের ক্ষত সারাতে পারেন না যথাযথ খাদ্য ও পরিষ্কার পানি ছাড়া। ইনফেকশন ছড়িয়ে অনেকের মৃত্যু হবে, যাদের বেঁচে থাকার কথা ছিল। পুষ্টিহীন মায়েরা স্তন্যদান করতে পারছেন না, অনেক নবজাতক মৃত্যুর মুখে। যারা বেঁচে থাকবে, তারা সারাজীবন তাদের কষ্টের স্মৃতি বহন করবে। ওষুধের অভাবে সহজে নিরাময়যোগ্য রোগ এবং ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ গাজায় মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
গাজায় যা ঘটছে তা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, ভূমিকম্প নয়, ঝড় নয়। এটা একটি মানবসৃষ্ট দুঃস্বপ্ন। এবং এর পক্ষে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। গাজায় যা ঘটছে, তা বিশ্বের সামষ্টিক বিবেকের ওপর চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে থাকবে। ইতিহাস কখনো ভুলবে না যে, আমরা এটাকে ঘটতে দিয়েছি এবং আমেরিকান হিসাবে আমরা এ বর্বরতাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছি। নিশ্চিতভাবেই হামাস ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে ইসরাইলে বর্বর হামলা চালিয়ে এ ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু করেছে, যে ঘটনায় ১২০০ নিরপরাধ মানুষ নিহত এবং ২৫০ জন আটক হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং হামাসের অন্যান্য নেতাকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে অভিযুক্ত করেছে। স্পষ্টতই ইসরাইলের নিজেকে রক্ষা করার অধিকার ছিল। কিন্তু নেতানিয়াহুর উগ্রবাদী সরকার শুধু হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। এর পরিবর্তে তারা ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে এক পরিপূর্ণ বর্বরতা ও ধ্বংসযজ্ঞের যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে গাজায় মানুষের জীবনযাপন অসম্ভব করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত ইসরাইল ৫২ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং ১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে, যাদের ৬০ শতাংশই নারী, শিশু ও বয়স্ক। ১৫ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। ইসরাইলের নির্বিচার বোমাবর্ষণে গাজার সব স্থাপনার দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে, যার মধ্যে ৯২ শতাংশ আবাসিক ইউনিট। এখন অধিকাংশ মানুষ তাঁবু বা অন্যান্য অস্থায়ী আশ্রয়ে বসবাস করছে। গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছে। গাজার বেসামরিক অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশ সড়ক ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। শত শত স্কুল বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছে, ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮ মাস ধরে গাজায় বিদ্যুৎ নেই।
এ বাস্তবতা বিবেচনা করলে কারও কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, নেতানিয়াহু একজন যুদ্ধাপরাধী। হামাসের মতোই তার হাতেও নিরীহ মানুষের রক্ত রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। এবং এখন নেতানিয়াহু ও তার উগ্রবাদী মন্ত্রীরা একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে : সম্পূর্ণ গাজা আবারও দখলে নেওয়া, বাকি কয়েকটি দাঁড়িয়ে থাকা ভবন ধ্বংস করা এবং ২২ লাখ মানুষের পুরো জনসংখ্যাকে একটি ছোট্ট এলাকায় আবদ্ধ করা, যেখানে নিয়োজিত মার্কিন নিরাপত্তা ঠিকাদাররা বেঁচে থাকা মানুষদের খাদ্য সরবরাহ করবে।
ইসরাইলি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে স্পষ্ট যে, তারা ফিলিস্তিনিদের অন্যান্য দেশে চলে যাওয়ার জন্য বাধ্য করতে চায়, যেমন ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গাজার জন্য পরিকল্পনা’র কথা এক ইসরাইলি কর্মকর্তা এ সপ্তাহে বলেছেন। ইসরাইলি অর্থমন্ত্রী স্মোট্রিচ এ সপ্তাহে বলেছেন, ‘গাজা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে,’ এবং এর অধিবাসীরা ‘বৃহৎ সংখ্যায় চলে যাবে।’ নেতানিয়াহুর উগ্রবাদী সরকারের অনেকেরই এ পরিকল্পনা ছিল শুরু থেকেই। এটিকেই বলা হয় জাতিগত শুদ্ধিকরণ। এটি যে কোনো পরিস্থিতিতে একটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডি হবে, তা স্পষ্ট। কিন্তু আমেরিকার জন্য এ ট্র্যাজেডিটা করুণ, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে ইসরাইলের সহযোগী। গত বছরই যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক সাহায্য হিসাবে ১৮ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এ বছর ট্রাম্প প্রশাসন আরও ১২ বিলিয়ন ডলারের বোমা ও অস্ত্র অনুমোদন করেছে। মাসের পর মাস ধরে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছেন। তার চেয়েও বেশি, তিনি বারবার বলেছেন, যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র গাজার দখল নেবে, ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেবে এবং গাজা পুনঃনির্মাণ করবে; যেটাকে ট্রাম্প ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন-ধনকুবেরদের জন্য একটি খেলার মাঠ!
এ যুদ্ধ গাজায় ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা বা আহত করেছে। গত বছর এজন্য আমেরিকান ট্যাক্সদাতাদের ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ হয়েছে। এবং এখন হাজার হাজার শিশু ক্ষুধার্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট সক্রিয়ভাবে ২২ লাখ মানুষের জাতিগত শুদ্ধিকরণকে উৎসাহ দিচ্ছেন। এ বাস্তবতা বিবেচনা করলে কেউ ভাবতে পারেন, সিনেটে জোরালো আলোচনা হওয়া উচিত : আমরা কি সত্যিই আমাদের ট্যাক্সদাতাদের কোটি কোটি ডলার গাজার শিশুদের ক্ষুধার্ত করার জন্য ব্যয় করতে চাই? আপনি আমাকে বলুন, কেন নেতানিয়াহুর যুদ্ধকে সমর্থন করে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করা এবং গাজার শিশুদের ক্ষুধার্ত করা একটি ভালো ধারণা। আমি শুনতে আগ্রহী। কিন্তু আমরা সেই আলোচনা করছি না। কারণ আমাদের একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রচারাভিযান অর্থায়ন ব্যবস্থা আছে, যা AIPAC-কে ওয়াশিংটনে এজেন্ডা নির্ধারণের সুযোগ দেয়। গত নির্বাচনি চক্রে AIPAC-এর PAC এবং সুপার PAC প্রায় ১২৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এবং সত্য হলো, আপনি যদি কংগ্রেস সদস্য হন এবং গাজায় নেতানিয়াহুর যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে AIPAC লাখ লাখ ডলারের বিজ্ঞাপন দিয়ে আপনাকে পরাজিত করার চেষ্টা করবে। কেউ ভাবতে পারেন, গণতন্ত্রে এমন গুরুতর বিষয়ে জোরালো আলোচনা হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রচারাভিযান অর্থায়ন ব্যবস্থার কারণে মানুষ সত্যিকার অর্থে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে। যদি তারা দাঁড়ায়, হঠাৎ করে আপনার নির্বাচনি এলাকায় বিপুল বিজ্ঞাপন প্রবাহিত হবে আপনাকে পরাজিত করার জন্য। দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হয়, এ রাজনৈতিক দুর্নীতি কাজ করে। আমার অনেক সহকর্মী গোপনে নেতানিয়াহুর যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে তাদের ভয় প্রকাশ করেন, কিন্তু প্রকাশ্যে খুব কম কিছু করেন বা বলেন।
ইতিহাস আমাদের এ দুঃস্বপ্নে সহযোগিতার জন্য ক্ষমা করবে না। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নেতানিয়াহুর ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি আমাদের সমর্থন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। আমরা নেতানিয়াহুর যুদ্ধযন্ত্রে আরেকটি পয়সাও ঢুকিয়ে দিতে পারি না। আমাদের অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি করতে হবে, মানবিক সাহায্য বাড়াতে হবে, বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং গাজাকে পুনর্গঠন করতে হবে-ধনকুবেরদের জন্য নয়, ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য।
কাউন্টারপাঞ্চ থেকে ভাষান্তরিত
বার্নি স্যান্ডার্স : মার্কিন সিনেটর, কংগ্রেসের ইতিহাসে দীর্ঘদিনের স্বতন্ত্র সদস্য
