Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

মওলানা ভাসানী যদি বেঁচে থাকতেন!

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মওলানা ভাসানী যদি বেঁচে থাকতেন!

মওলানা ভাসানী। ফাইল ছবি

মওলানা ভাসানী যদি বেঁচে থাকতেন!

গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ভারতে নদীটির নাম গঙ্গা আর বাংলাদেশে পদ্মা। পদ্মা মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

ভৌগোলিকভাবে গঙ্গা নদীর উৎপত্তি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে। শীত মৌসুমে হিমবাহটি বরফ জমে স্ফীত হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে বরফ গলে গঙ্গা নদীতে পড়ে। মৌসুমি বৃষ্টির সময় গঙ্গার প্রবাহ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে। তারপর বৃষ্টিক্ষীণ অথবা বৃষ্টিহীন দিনগুলোতে এ নদীর প্রবাহ হ্রাস পায়।

পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, গঙ্গার উৎপত্তি মহাদেবের জটা থেকে। পশ্চিমবঙ্গের এক গায়ক গেয়েছেন, ‘নেমেছিল গঙ্গা নদী মহাদেবের জটা থেকে, দুঃখ পেলেম হেথায় তাকে কলের জলে বন্দি দেখে।’ গানটির রচয়িতার দুঃখ, গঙ্গার পবিত্র জলকে পৌর করপোরেশন শহরে জল সরবরাহের জন্য পাইপের মধ্যে বন্দি করেছে। এ গীতিকার ফারাক্কা বাঁধের কথা ভাবেননি। ফারাক্কায় গঙ্গা নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত নদীটির স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে শেষ বিচারে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের জনগণের জন্য মহাসর্বনাশ ডেকে এনেছে। ভূ-রাজনীতির কূটচালে উভয় দেশের জনগণই বন্দি। তার সঙ্গে বলিদান করা হয়েছে দুই দেশের জনগণের মধ্যকার বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতিকে।

ভারত আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না। তাই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান নিকট ভবিষ্যতে আশা করা দুরাশামাত্র। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো নেতা যদি আজও বেঁচে থাকতেন, তাহলে স্লোগান তুলতেন, ‘মরণবাঁধ ফারাক্কা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কাজে লাগাতে তার জুড়ি ছিল না।

ভারতের একতরফা গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের কারণে যে শুধু বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়; বরং এর ফলে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, বন ও নৌপরিবহণ ব্যবস্থাও ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এ বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২৯ অক্টোবর ১৯৫১ সালে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গ্রীষ্মকালে গঙ্গা নদী থেকে বিপুল পরিমাণ পানি পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদী পুনরুজ্জীবত করার জন্য অপসারণ করার ভারতীয় পরিকল্পনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারত জবাব দেয়, তাদের এ পরিকল্পনা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং এর ফলাফল সম্পর্কে পাকিস্তানি উদ্বেগ একটি তত্ত্বীয় ব্যাপার। সেই থেকে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা শুরু। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান এ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আলোচনা করে। কিন্তু এ আলোচনা যখন চলছিল, তখন ভারত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখে এবং ১৯৭০ সালে এর কাজ সমাপ্ত করে। বাঁধটির অবস্থান বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। যদিও বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২১ এপ্রিল ১৯৭৫ থেকে ২১ মে ১৯৭৫ ভারতকে গঙ্গা থেকে ৩১০ থেকে ৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণের অনুমতি দেয়। কিন্তু তারপর ভারত এ নিয়ে কোনো রকম আলোচনা করতে অরাজি থাকে। সেই যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গঙ্গা থেকে ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দেওয়া হয়, তা ভারত আজও অব্যাহত রেখেছে।

মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অন্যতম একটি প্রধান ঘটনা হচ্ছে ফারাক্কা লংমার্চ সংঘটিত করা। মওলানা সাহেব যখন ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দেন, তখন তার বয়স ৯০ বছরের বেশি। ১৯৭৬ সালের গোড়ার দিকে মওলানা ভাসানী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ’৭৬-এর ১৮ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ফেরার পর তিনি ঘোষণা দেন, ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে তিনি লংমার্চ করবেন। তার এ কর্মসূচি জনগণকে চমকে দিয়েছিল। তার যে বয়স, সে বয়সে কারোর লংমার্চের মতো কর্মসূচি পালনের কথা নয়। তিনি ঘোষণা দেন ১৬ মে রাজশাহী শহর থেকে লংমার্চ শুরু করবেন। প্রাথমিকভাবে ১৯৭৬ সালের ২ মে মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ‘ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা জাতীয় কমিটি’ গঠন করা হয়। এরপর এ কমিটির সংখ্যা আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফারাক্কা মিছিলকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। মিছিল শুরু করার আগে তার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একাধিক পত্র বিনিময় হয়েছিল। এ চিঠিগুলো কূটনৈতিক পরিশীলতায় ঋদ্ধ এবং যার যার অবস্থান থেকে অনড়। ভারত ও বাংলাদেশের কূটনীতির ইতিহাসে এ চিঠিগুলোর গুরুত্ব কখনোই হারিয়ে যাবে না। মওলানা ভাসানী সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার ফারাক্কা মিছিল চালিয়ে যান।

রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে মিছিলটি শুরু হয় এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের পার্শ্ববর্তী একটি নদীতে নৌকার মাধ্যমে ব্রিজ সৃষ্টি করে মিছিলকারীদের নদী পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দীর্ঘ মিছিলের পথে মিছিলকারীদের সম্বল ছিল কিছু শুকনো খাবার। মিছিল রাজশাহীর কানসাটে গিয়ে সমাপ্ত হয়। পরদিন পত্রিকায় দেখা গেল, ভারত সীমান্তে বিএসএফ বাহিনী মাটিতে শুয়ে বাংলাদেশের দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। তারা ভেবেছিল, মওলানা সাহেব সীমান্ত অতিক্রম করে অনুসারীদের নিয়ে ভারতে ঢুকে পড়বেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।

মওলানা ভাসানী ফারাক্কা মিছিল সংঘটিত করার ফলে তৎকালীন জিয়াউর রহমানের সরকার ফারাক্কার পানিবণ্টনের প্রশ্নে দরকষাকষিতে বিশাল শক্তি অর্জন করে। একেই বলে রাষ্ট্রীয় কূটনীতির সঙ্গে জনগণের কূটনীতিকে সংযুক্ত করা। মওলানা ভাসানী বলতেন, জনগণের শক্তি এটম বোমার চাইতেও শক্তিশালী হতে পারে। জিয়াউর রহমানের সরকার পানিবণ্টনের প্রশ্নটি জাতিসংঘে উত্থাপন করলে ভারত আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিতে বাধ্য হয়। এরপর ৫ বছর মেয়াদি একটি পানিবণ্টন চুক্তি হয়। এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশ ও ভারত পরবর্তী ৫ বছরের (১৯৭৮-৮২) জন্য শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে। এ চুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গ্যারান্টি ক্লজ। অর্থাৎ চুক্তিমাফিক পানি দিতে হবে, এর নড়চড় করা চলবে না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের জন্য ৩০ বছরের একটি চুক্তি করে। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, অধিকাংশ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ চুক্তিতে উল্লিখিত পরিমাণ পানি পায়নি। এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে।

১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন হবে সমতা ও অনুল্লেখযোগ্য ক্ষতির ভিত্তিতে (No significant harm)। ভারত কি এই নীতি মেনে সুসভ্য দেশের মতো আচরণ করবে? আমার অন্তত মনে হয় না। অথচ মেকং অববাহিকার দেশগুলো একটি চমৎকার চুক্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নদীর পানিবণ্টনে পানির গুণগত মান একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এ ছাড়া নদীর প্রবাহ চালু রাখতে নদীর জন্য সুনির্দিষ্ট একটি হিস্যা (২০-৩০ শতাংশ) নদীকে ছেড়ে দিতে হবে। নয়তো নদীর মৃত্যু হবে। ভারতের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য তাদের পূজিত নদী গঙ্গারও একদিন মৃত্যু ঘটতে পারে।

ড. মাহবুব উল্লাহ্ : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ভারত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম