জলজল্লাদদের ফারাক্কা বাঁধ : ভুবন কুন্ডু এবং আমি
আবদুল হাই শিকদার
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এক.
ফারাক্কা বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের যে দু-একজন চর্মচক্ষে ভারত কর্তৃক গঙ্গা নদীর একতরফা পানি লুণ্ঠন দেখেছেন, দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন-আমি তাদের একজন। আমার স্বল্পায়তন জীবনের যা কিছু অর্জন, তার মধ্যে ফারাক্কা বাঁধ এবং এই পানি লুণ্ঠন দর্শন অনিবার্য কারণেই চিরকালের জন্য আলাদা এবং অসহনীয় অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে রইল।
১৯৯১ সালে সর্বশেষবারের মতো আমার ভারত গমনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার স্বাধীনতার সমাধি ভূমি পলাশীর প্রান্তর, সিরাজউদ্দৌলার রক্তমাখা মুর্শিদাবাদ এবং জাতীয় কবির জন্মভূমি চুরুলিয়া সফর। সর্বশেষবারের মতো বললাম এই কারণে যে, এরপর ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন আমাকে আর ভিসা প্রদান করেনি। এমনকি ১৯৯৪ সালে কলকাতায় আয়োজিত প্রথম বাংলাদেশি বইমেলায় সরকারি প্রতিনিধি হয়েও ভিসা পাইনি। সেই দলে আমাদের দলনেতা ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী এবং মরহুম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ। যাক সে প্রসঙ্গ।
মুর্শিদাবাদ সফরের শেষ পর্যায়ে জানলাম বহরমপুর থেকে সরাসরি স্টেট বাসে ফারাক্কা যাওয়া যায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভ্রমণ। সকালে যাত্রা করলে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসা যাবে বহরমপুর। ঝট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আগামী ভোরেই ফারাক্কা বাঁধ দেখতে যাব। ভারত সরকার সেখানে আমার সঙ্গে কী রকম আচরণ করবে আমি জানি না। একজন বিদেশি নাগরিকের জন্য আদৌ ফারাক্কায় যাওয়া বৈধ কিনা, তা-ও জানি না। কিন্তু আমার ভিসার সঙ্গে এমন কোনো শর্ত না থাকায় আমি দ্রুত মনস্থির করে ফেলি। হোটেলে বিছানায় শুয়ে সারা রাত এপাশ-ওপাশ করি। সব প্রকার আইন-কানুন যেখানে হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত; মানুষ ও তার সভ্যতার বিরুদ্ধে যেখানে প্রতিমুহূর্তে সংঘটিত হচ্ছে জঘন্য অপরাধ; লক্ষ শহিদের রক্তে ভেজা শ্যামল, কোমল, ছায়াঘন নয়নাভিরাম, এত বড় মহাবিশ্বে আমাদের একমাত্র ঠিকানা; ১২ কোটি মানুষের সব সাধ ও স্বপ্ন সর্বসময়ে আবর্তিত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই এক রত্তি দেশটির অস্তিত্ব ধ্বংস করার কাজটি যেখানে সম্পাদিত হচ্ছে; যেখানে স্রেফ প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে জল্লাদরা শুষে নিচ্ছে আমাদের সোনার দেশের রক্ত ও রস; সেই ফারাক্কা বাঁধ দেখতে যাব। আমাদেরকে স্থানীয়ভাবে পঙ্গু, নতজানু, ভিখারি করে রাখার জন্য আধিপত্যবাদের আগ্রাসী থাবা যেখানে অসম্ভব ব্যস্ত-যে প্রক্রিয়া আমাদের দেশের এক-তৃতীয়াংশকে ঠেলে দিয়েছে মরুভূমিতে, আমাদের পদ্মা, গড়াই, মধুমতি, কপোতাক্ষ, আড়িয়ালখাঁর বুক থেকে উধাও করেছে পানির ধারা, উপহার দিয়েছে নিষ্করুণ বালুকারাশি, আমাদের স্বপ্ন থেকে কেড়ে নিয়েছে সবুজ, ভূমি থেকে মুছে নিয়েছে ফসলের সমাহার, আমাদের অর্থনীতিকে করেছে বিকলাঙ্গ, আমাদের চলার পথকে করেছে কণ্টকাকীর্ণ, কণ্ঠ থেকে হরণ করেছে সংগীত, দুপুরকে করেছে মলিন, রাতকে করেছে নির্ঘুম আর আমাদের ভুবন ভরে উগড়ে দিয়েছে বিদীর্ণ হাহাকার-সেই ফারাক্কা বাঁধ দেখতে কেমন? হৃৎপিণ্ডের ওপর চেপে বসা সেই জগদ্দল পাথরটিকে আমার চোখ শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে পারবে তো?
দুই.
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের স্টেট বাসগুলো বেশ সুপরিসর। চলেও বেশ দ্রুত। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে আমার দু’ঘণ্টা গেছে দুলুনিতে। তারপর এক সময় কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে উঠল ‘নিউ ফারাক্কা’ বলে। তখন তাকিয়ে দেখি ছোটখাটো একটা ছিমছাম শহরে আমাদের বাস থেমে আছে। চমকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে বাস থেকে নেমে নিউ ফারাক্কা শহরের কালো পিচের ওপর পা রাখি। কীভাবে কোথায় যাব, ভাবতে ভাবতে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ি। ওয়েটার এলে চা-নাস্তার অর্ডার দিয়ে জিজ্ঞেস করি ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে। ওয়েটার বলে, ‘আপনি কি কলকাতা থেকে এসেছেন?’ বলি, ‘হ্যাঁ’।
ছেলেটি এর বেশি কিছু জানতে চায়নি। আর আমি যে কলকাতা থেকে এসেছি, তা-ও সত্য।
ফারাক্কা বাঁধের একপাশে নিউ ফারাক্কা শহর। এটা মুর্শিদাবাদ। অপর পারে কালিয়াচক। ওটা মালদহ। মাঝখানে গঙ্গা নদীর ওপর বাংলাদেশের সব দুঃখ, দুর্গতি ও দুর্ভাগ্যের কারণ ভয়াবহ ফারাক্কা বাঁধ। ফারাক্কার উপর ট্রেন লাইন ও বাস লাইন রয়েছে পাশাপাশি। আলাদা আলাদাভাবে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইনেরও রয়েছে ব্যবস্থা। বাস লাইনের দু’পাশেই হাঁটার পথ। এ পথে নিরাপত্তা নিষেধাজ্ঞার বাইরে দিনের বেলায় রিকশা, সাইকেল, মোটরসাইকেল ও পথচারী হরদম আসা-যাওয়া করছে।
পুরো ফারাক্কা বাঁধ ঘিরে রয়েছে নানা কায়দার নিরাপত্তা বেষ্টনী। আপাতদৃষ্টিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের তেমন একটা চোখে না পড়লেও ভেতরে ভেতরে সবাই জানে, ফারাক্কা বাঁধের প্রতি সেন্টিমিটার জায়গার জন্য রয়েছে সর্বাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত একজন করে ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রহরী। পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে দু’প্রান্তেই। তীব্র ফ্লাড লাইটের দাপটে ফারাক্কা অমাবস্যার রাতেও ড্রাকুলার দাঁতের মতো জ্বলজ্বল করে। জল-স্থল এবং অন্তরীক্ষ সর্বত্র বিচরণ করছে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা। সেই ক্যামেরাকে ফাঁকি দিয়ে একটা পাখিরও সাধ্য নেই ফারাক্কার উপর দিয়ে উড়ে যায়। ফারাক্কাকে মাঝখানে রেখে যতদূর চোখ যায়, পূর্বে-পশ্চিমে, উত্তরে-দক্ষিণে নানা পদ্ধতির নিরাপত্তা ব্যবস্থা চোখে পড়ে। পানির জন্য আলাদা ব্যবস্থা। সেখানে মাঝেমধ্যে চক্কর দেয় স্পিডবোট ও অন্যান্য দ্রুতগামী ছোট ছোট জলযান। এক অর্থে নিউ ফারাক্কা শহর একটা মিনি ক্যান্টনমেন্ট। এই শহরের অধিবাসীদের কমবেশি সবাই কোনো না কোনোভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। কালিয়াচক সম্পর্কেও একই কথা। এই দুটো শহরের নানা স্থানে রয়েছে ভারতের জল বিভাগের নানা কারবার। পানি প্রকৌশলীদের বহু বিচিত্র যন্ত্রপাতি। বিভিন্ন ধরনের স্লুইচ গেট। ফিডার ক্যানেল। ফারাক্কা বাঁধসংক্রান্ত কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বিরামহীন ছোটাছুটি। তাদের আবাসস্থল। সব মিলিয়ে আশপাশের দশ-বারো মাইল এলাকাজুড়ে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এবং এমন এক কর্মযজ্ঞ, যার প্রধান বিষয়গুলো যাই থাক, প্রধান উদ্দেশ্য হলো একটি ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে দাবিয়ে রাখা, শুকিয়ে মারা এবং শায়েস্তা করা। যাতে সে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে মহাভারতে বিলীন হতে বাধ্য হয়।
তিন.
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ফারাক্কা বাঁধের উপর দিয়ে কালিয়াচক যাওয়ার জন্য রিকশা নিলাম। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, ফারাক্কা বাঁধের দুপাশে মাইলের পর মাইল নদীর তীর বরাবর পিচঢালা সড়কগুলো জালের মতো ছড়িয়ে আছে। দু-একটা সড়ক জট পেরিয়ে আমার রিকশা ফারাক্কা বাঁধের উপর উঠে এলো। ফারাক্কা বাঁধের উপর আমি। আমার ভেতরে চিৎকার করে উঠে হাজার হাজার বাংলাদেশ। আমার ভেতরে-বাইরে, আমার সামনে-পেছনে তৃষ্ণার্ত-ক্ষুধার্ত কোটি কোটি মানুষের অন্তহীন মিছিল যেন চলতে থাকে। আমার চারদিকের আকাশ, বাতাস, অন্তরীক্ষ জুড়ে যেন শুরু হয় এক ভয়ংকর তোলপাড়, এই সেই ফারাক্কা বাঁধ, এই সেই ফারাক্কা বাঁধ! দিগন্ত রেখার ওপর থেকে মওলানা ভাসানীর বজ্রনির্ঘোষ শুনতে পাই। গড়াই নদী বলতে থাকে এই সেই ফারাক্কা বাঁধ। পদ্মার শুষ্ক, রুক্ষ, বিস্তৃত বিশাল বক্ষের প্রতিটি বিরহী বালুকণা বলতে থাকে, এই সেই ফারাক্কা বাঁধ। মূঢ় ম্লান জেলেপাড়ায় প্রতিটি উনুন থেকে শূন্যে বিস্ফোরিত হয় ধ্বনি। এই সেই ফারাক্কা বাঁধ। খান আতাউর রহমানের ‘গ্যানজেস ও গ্যানজেস’ ছবির সেই অবোধ কিশোরী, যে তার মুমূর্ষু মায়ের মুখে এক ফোঁটা পানি তুলে দেওয়ার জন্য শূন্য কলস হাতে ধুধু বালুচরের ওপর দিয়ে ছুটছে, আর ছুটছে-তার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। শূন্য গোয়াল, খাঁ খাঁ মাঠ, পত্রহীন বৃক্ষ আমার ভেতরে ক্রন্দন করতে থাকে। কিন্তু আমি কিছুই শুনি না। শুনতে পারি না। এক অক্ষম কবি, সকল কালের, সকল মানুষের, সকল আর্তনাদ বুকের মধ্যে চেপে ধরে, আমার ঝাপসা চোখ আমি প্রাণপণ মেলে রাখি।
ধীরলয়ে চলতে চলতে এক সময় আমার রিকশা ফারাক্কা বাঁধ পেরিয়ে পৌঁছে যায় কালিয়াচক শহরে। রিকশা থেকে নেমে আমি এলোমেলো হাঁটতে থাকি। পুরো কালিয়াচক শহর ঘুরে বেড়াই। কিন্তু আমি কিছুই দেখি না। ১৯৯১ সালের মধ্য জুনের আকাশ আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আমরা কেউ কথা না বলে নীরব, নিস্তব্ধ ও নিমগ্ন হয়ে থাকি। শুধু আমার বুকের স্পন্দন আমাদের কারও দিকে না তাকিয়ে আপন মনে কাজ করে যায়।
চার.
কালিয়াচক থেকে নিউ ফারাক্কার উদ্দেশে সেই একই রিকশা নিয়ে আবার ফারাক্কা বাঁধের উপর উঠে আসি। বাঁধের মাঝ বরাবর এসে রিকশা থামাতে বলি। রিকশাওয়ালা বলে, ‘বাবু এখানে থামালে অন্যায় হবে।’
আমি কথা না বলে রিকশা থেকে নেমে বাঁধের উপর দাঁড়াই। আমার পায়ের নিচে এখন শুধু আমার জুতার তলা এবং ফারাক্কা বাঁধ।
যতদূর চোখ যায়, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। একদিকে পানি ফুলে-ফেঁপে গর্জন করছে। মাইলের পর মাইল এলাকাজুড়ে সমুদ্রের চেহারা। অথৈ পানির শান্ত প্রসন্নতায় বাতাস দিচ্ছে দোলা। উঠছে ঢেউ। ঢেউয়ের পর ঢেউ। তারপর ছড়িয়ে পড়ছে। সে দোলা গিয়ে লাগছে দূরে-বহু দূরে। উপরের নীল নির্জন আকাশ বারবার উঁকি দিচ্ছে নিচের সফেন পানির কল্লোলে। ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি চলে যাচ্ছে বিহারে। উত্তর প্রদেশে, রাজস্থানে। সেখানে বিরান মরুভূমির বুকে মাথা তুলছে সবুজ গমের খেত। গৌরবে ফেটে যাচ্ছে সব খেত। গড়ে উঠছে নতুন নতুন বসতি। লতা মুঙ্গেশকরের গান পাচ্ছে নতুন মাত্রা। মাধুরী দীক্ষিতের লীলায়িত ছন্দে মাতাল হয়ে উঠছে নব্য ভারতীয়রা। বাল থেকারের হিংস্র খড়্গ ক্রমাগত আকাশে উঠছে আর নামছে। আদভানি, বাজপেয়িদের নখ আর দাঁতগুলো বাড়তে বাড়তে পাচ্ছে দানবীয় অবয়ব। ভয়াল-বিকট বিভীষিকা নিয়ে রামায়ণ থেকে নেমে আসছে বানর বাহিনী। মহাভারতের শকুনীর অশুভ ডানা ক্রমাগত বিস্তার লাভ করতে করতে ছেয়ে ফেলেছে দক্ষিণ এশিয়ার মেঘমেদুর আকাশ। ঘনায়মান অন্ধকারে শুধু শকুনী, গৃধিনী ও শ্বাপদের বর্বর উল্লাস। স্বার্থান্ধ দানবের নৃশংস লালসার লালায় স্তব্ধ হয়েছে সব চেতনা।
রিকশাওয়ালার ডাকে ঘোর কাটে আমার। বলে, ‘বাবু যাবেন না?’
আমি ফারাক্কা বাঁধের অন্যদিকে তাকাই। ছ্যাৎ করে বুকটা। যেন একটি উত্তপ্ত লৌহ শলাকাকে কেউ জোর করে আমার কণ্ঠনালির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। যেন কেউ এক বালতি এসিড নিক্ষেপ করেছে আমার ওপর। মানুষ, মানবতা আর সভ্যতার বিরুদ্ধে জলজল্লাদরা এ কী করেছে! প্রায় পানিশূন্য নদীবক্ষ। বাঁধের মাঝ বরাবর মাত্র একটা গেট দিয়ে পানি যাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। আর সব গেট বন্ধ। পানিশূন্য পদ্মার ওপর বালু আর বাতাসের মিলিত মর্সিয়া ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরছে। আকাশ-পাতাল বৈষম্য বাঁধের দুদিকে। মাঝে সামান্য একটা বাঁধ। তাতেই এতটা! একদিকে পানি আর পানির পৃথিবী। অন্য পাশে বালু, বালু আর বালু। একদিকে সবুজ আর সবুজের অন্তহীন বিস্তার। অন্যদিকে মৃত, জীর্ণ, ধূসর, রুক্ষ জনপদ। একদিকে আশা আর স্বপ্নের গুঞ্জন। অন্যদিকে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের আর্তনাদ। একদিকে দম্ভ, অহংকার, হিংসা ও হিংস্রতার পৈশাচিক পরিতৃপ্তি, অন্যদিকে ভয়ে-আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া মানুষ আর মানবতার অস্তিত্ব।
এ তো ফারাক্কা বাঁধ নয়। এ হলো মানবসভ্যতার বধ্যভূমি। দক্ষিণ এশিয়ার কসাইখানা। হিটলারের নাজি ক্যাম্প। এ হলো সীমারের ছুরিকা, ক্লাইভের খঞ্জর। এ এক নতুন কারবালা। মানুষ, মানবতা, সত্য ও ন্যায়ের বিরুদ্ধে ইয়াজিদের নির্মম ঘাতক বাহিনী। এ হলো চেঙ্গিস খানের প্রেতাত্মা। এ হলো হালাকু খানের কুৎসিত অট্টহাসি। হিংস্র দাঁতের ঘষটানি। সেই হাসি আর ঘষটানি বিকট বীভৎসতা নিয়ে হামলে পড়ছে বাঁধের পানিশূন্য এ পারে। পদ্মার ওপর আরেক সখিনা যেন সেই বিরূপ বিষণ্ন অন্ধকারে, নির্মম বালুর ওপর কাশেমের রক্তাক্ত লাশ সামনে নিয়ে বোবা বেদনায় স্তব্ধ হয়ে আছে। আশাহীন-ভাষাহীন।
যেন আমার চোখ সহসা ধারণ করে সেই দৃশ্য। মানুষ আর মানবতার সেই বিপর্যয়ের সামনে তড়িতাহত পাখির মতো কঁকিয়ে উঠি আমি। আমার চোখ ছাপিয়ে নেমে আসে অবিরল পানির ধারা। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি, হে আমার প্রতিপালক! হে আসমান ও জমিনের মালিক। হে ভারত ও বাংলাদেশের মালিক-তুমি কি আমার এই রোদন, এই প্রার্থনা শুনতে পাচ্ছ? তোমার সৃষ্ট প্রকৃতির স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে এই বাঁধ এক অন্ধ দৈত্যের ঔদ্ধত্য। এই বাঁধ তোমার সভ্যতাকে করতে চায় পদদলিত। তোমার মানুষকে করতে চায় হত্যা। এরা তোমার রহমতের ধারা নদীর পানির গতিকে করেছে রুদ্ধ।
সত্য ও ন্যায়ের বিরুদ্ধে এই বাঁধ এখন এক ভয়াবহ মারণাস্ত্র। এই বাঁধ সুন্দর ও কল্যাণের প্রতিপক্ষ। প্রভু! এই বাঁধ যারা নির্মাণ করেছে, তারা নিশ্চয়ই সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। তারা নিঃসন্দেহে নাফরমান। যারা তোমার সৃষ্টিকে ধ্বংস করার জন্য মেতে উঠেছে উন্মত্ত প্রতিহিংসায়। তুমি নিশ্চয়ই সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ কর না। আদ ও সামুদ জাতিকে তুমি সমুচিত শাস্তি দিয়েছিলে। আগ্রাসী আবরাহার হস্তী বাহিনীকে ছোট ক্ষুদ্র আবাবিল পাখির দ্বারা ভক্ষিত তৃণ সদৃশ করেছিলে। মুসার পেছনে ধাবমান ফেরাউনের পরিণতির কথা আমরা জানি। এখন ইমানদারদের জন্য তোমার ওয়াদার কথা আমরা স্মরণ করছি। প্রভু! এবার আমরা তোমার ক্রোধকে এখানে দেখতে চাই। তোমার সংহারক লানত এখানে নামুক। নামুক তোমার সেই গজব, যে গজব নূহের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করেছিল। হে মানুষের পালনকর্তা! এই সন্ধিক্ষণে বজ্রের মতো নেমে আসুক তোমার ধ্বংসের বার্তাবাহী ফেরেস্তা ইসরাফিলের শিঙার মহাহুংকার। তারপর ফারাক্কার রাহুমুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে আকাশে নামুক তোমার শান্তির জোছনা।
তারপর ফারাক্কা বাঁধের উপর আমার সব শক্তি দিয়ে ক্রমাগত পদাঘাত করতে লাগলাম।
পাঁচ.
ফারাক্কা বাঁধকে পেছনে ফেলে আসি। নিউ ফারাক্কা শহরের ওপর দিয়ে এগোচ্ছি বাসস্ট্যান্ডের দিকে। বহরমপুর হয়ে ফিরব কলকাতায়। আস্তে আস্তে রিকশা এগোচ্ছে।
হঠাৎ আমার রিকশাওয়ালা বলে, ‘দাদা আপনার বাড়ি কি বাংলাদেশে?’
বললাম, ‘হ্যাঁ।’
কিছুক্ষণ থেকে তারপর বলে, ‘আপনাদের পদ্মা কি সত্যি সত্যি শুকিয়ে গেছে?’
বললাম ‘হ্যাঁ।’
বললো, ‘ফারাক্কা বাঁধ কি সত্যি আপনাদের খুব ক্ষতি করেছে?’
বললাম, ‘খুব ক্ষতি করেছে।’
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে রিকশাওয়ালা। তারপর হঠাৎ করে বলে, ‘আমাদের বাবুরা কেন যে এই ফারাক্কা বাঁধ বানালেন, বুঝি না। অন্যকে কষ্ট দিয়ে কি কোনো আনন্দ পাওয়া যায়? যায় না। সব মানুষই ভগবানের সৃষ্টি। ভগবান সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতে বলেছেন। ঝগড়া-বিবাদ তিনি পছন্দ করেন না। আমাদের ঠাকুর বলেন, ভুবন সবারে ভালোবাসতে হবে। নইলে মনের অন্ধকার ঘুচবে না। তাই তো বলি, আরে বাপু বাঁধ দিয়েছ ভালো কথা, এবার যার যা পাওনা, তাকে তা দিয়ে দিলেই হয়। শুনতে পাই, আপনাদের ওখানে খেতে ফসল হয় না। গাছপালা মরে যাচ্ছে। এসব শুনতে কার ভালো লাগে বলুন। কেন যে আমাদের বাবুরা এরকম হয়ে গেলেন।’
কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে রিকশাওয়ালা।
বললাম, ‘তোমার নাম কি ভাই?’
বলল, ‘আর নাম, বাবা-মা আদর করে ছোট বেলায় নাম রাখল ভুবন। ভুবন কুন্ডু। আমাদের ঠাকুর বলে দিয়েছিলেন এই নাম রাখতে। সারা দিন রিকশা চালাই। বিরাট পোষ্য বাড়িতে। বৃদ্ধ বাবা-মাসহ ৯ জন লোকের খাবার জোগাই এই রিকশা চালিয়ে। বড় মেয়েটার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। ছোট ছেলেটার খুব অসুখ। অসুখ আবার বাবারও। কিন্তু উপায় কী? চিকিৎসা করব কী দিয়ে? খাবারই জোটাতে পারি না।’
আমার মনটা বড় ভারী হয়ে ওঠে। এক ধরনের মায়া অনুভব করি ভেতরে। আমার চোখের সামনে থেকে যেন একটা কালো পর্দা সরে যায়। তাই তো, ভুবন কুন্ডুদের মতো মানুষ পৃথিবীর যে দেশের, যে ধর্মেরই হোক না কেন, তারা সবাই এক। এক জাতের মানুষ। বাংলাদেশের আবদুল, একাব্বর কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার পিটার কিংবা ফার্নান্দেজদের সঙ্গে ওর তো কোনো পার্থক্য নেই। এরা সবাই তো একই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়ছে। একই দুঃখ, একই বেদনার অংশীদার এরা সবাই। এই ফারাক্কা বাঁধ যারা করেছে, তারা তো এসব মানুষের কথা ভাবেনি। এই মরণ বাঁধের সঙ্গে তো ভুবনের মতো মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই।
বললাম, ‘ভুবন তোমার বাড়ি কোথায়?’
ভুবনের গলা বুজে আসে। বলে, ‘এই যে বাঁধের এ পাশে জলের বিশাল লেক দেখলেন। ওইখানে ছিল আমাদের দশ পুরুষের ভিটেমাটি। সব কিছু তলিয়ে গেছে জলের নিচে। একদিন সব কিছু ছিল আমাদের। এখন কিছুই নেই। থাকি একটা বস্তিতে।’
বললাম, ‘সে কী!’
ভুবন আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ‘বলুন কী লাভ হলো এই ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে। ওই বাঁধের কারণে আজ আমরা নিঃস্ব।’
বললাম, ‘তা তোমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পাওনি?’
ভুবন গলা খাখারি দিয়ে একদলা কফ ফেলে পথে। বলল, ‘ক্ষতিপূরণ! সে আর কী বলব। কিছু হয়তো দিয়েছিল, তাও বারো ভূতে লুটেপুটে খেয়েছে।’
বাসস্ট্যান্ডে এসে থামে ভুবনের রিকশা। ভাড়া মিটিয়ে দেই আমি। তারপর ভুবন আর আমি দাঁড়িয়ে থাকি মুখোমুখি। কেউ কোনো কথা বলি না। কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
আবদুল হাই শিকদার : কবি; সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর
