Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কলকাতার চিঠি

ফারাক্কার প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গেও অন্ধকার

Icon

সৌমিত্র দস্তিদার

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফারাক্কার প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গেও অন্ধকার

বলি তো অনেক সময়। লিখেছিও দু-এক জায়গায়। তবুও ১৬ মে এলে আরও মনে হয়, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে রাজনীতিবিদ অনেকেই এসেছেন। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতেও আসবেন। ভবিষ্যতের কথা এখনই হলফ করে বলতে না পারলেও নিশ্চিন্তে বলা যায়, পরিবেশসচেতন রাজনীতিক অন্তত এ মুহূর্ত পর্যন্ত এশিয়ায় একজনই, তিনি আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আমি মূলত ফিল্ম মেকার। ফলে ১৬ মে এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের টুকরো টুকরো অজস্র দৃশ্যকল্প। দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তের সিনেমা পরিচালকের কাছে দুর্লভ যে দৃশ্যকল্প সেলুলয়েডে ধরে রাখা পরম আহ্লাদের, ১৯৭৬ সালে তা-ই বাস্তবে ঘটেছিল। ৯৬ বছরের এক বৃদ্ধ জননেতা পথে নেমেছেন বড় বাঁধের বিপদ, ইকো সিস্টেমের নিরাপত্তার জন্য জনগণকে সতর্ক করতে। যাই যাই সূর্যের আলোয় স্পষ্ট-বৃদ্ধের চোয়াল শক্ত, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখের ভাষা। মিছিলে ঢল নেমেছে লাখো জনতার। মুহুর্মুহু স্লোগান উঠেছে-মওলানা ভাসানী জিন্দাবাদ।

কিছু পরে অঝোরে বৃষ্টি নামল। মিছিল এগোচ্ছে। যাবে ভারত সীমান্তে, কানসাট পর্যন্ত। সবাই চিন্তিত বৃদ্ধ নেতার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে। তিনি ভ্রুক্ষেপহীন। স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন বড় বাঁধ আগামী প্রজন্মের কাছে বিপজ্জনক হতে পারে এই দাবি নিয়ে। সাধারণভাবে লোকে ভাসানীকে বলে মজলুম জননেতা। সঠিক সম্বোধন। তবে কখনো কখনো আমার মনে হয়, তিনি ছিলেন পরিবেশ যোদ্ধাও। ক্রুসেডার। নদীর সঙ্গে তার সখ্য আশৈশব। জন্মেছেন যমুনা নদী তীরবর্তী সিরাজগঞ্জের সয়াধনগড়া গ্রামে। ধলেশ্বরী, লৌহজং, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদীপথ ছিল ভাসানীর বড় পছন্দের। আনন্দ-বিষাদে তিনি ঘুরে বেড়াতেন নদীর চরে চরে। জলে হাত দিয়ে তিনি বুঝতে পারতেন বৃষ্টি আসতে পারে অথবা এখানে মাছ পাওয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গের ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য আপত্তি তুলেছিলেন, ফারাক্কা বাঁধ হলে জনজীবনে অশান্তি বাড়বে বলে। কেউ সে সময় তার কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। মওলানা ভাসানী সরাসরি রাস্তায় নামলেন ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে।

বাঁধের পরিকল্পনা তো হচ্ছিল ১৯৬০-৬১ সাল থেকেই। নেহেরু-সমাজতন্ত্রের একটা অন্যতম দিক ছিল বড় বাঁধ। নদী বেঁধে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচের জলের পরিমাণ বৃদ্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে পাঞ্জাবের ভাকরা নাঙ্গাল, দামোদর ভ্যালি করপোরেশন ও ফারাক্কা নির্মাণ-মোটের ওপর একই চিন্তাপ্রসূত। তখনো ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, সরকারি অর্থ বিনিয়োগ করে ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার কাল। পরবর্তী সময়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন নেহেরু লিগাসিরই সার্থক উত্তরসূরি।

ষাটের দশকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে হতে পঁচাত্তর সাল অবধি ভারতকে অপেক্ষা করতে হয়। তার আগে পর্যন্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সীমান্তে কোনোরকম বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাবের অনুমতি দিতে রাজি ছিল না। বাংলাদেশ হওয়ার পর শেখ মুজিব পরীক্ষামূলকভাবে ভারতকে এক মাসের জন্য ফিডার ক্যানেল দিয়ে জল সরবরাহের অনুমতি দেন। ভারতের যুক্তি ছিল, কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ জরুরি। গঙ্গার উপর বাঁধ দিয়ে তার নির্দিষ্ট কিউসেক জল সরবরাহ না করলে কলকাতা বন্দর শেষ হয়ে যাবে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ক্রমে ক্রমে ধ্বংস হবে। যদিও ততদিনে এমনিতেই কেন্দ্র-রাজ্য মাসুল সমীকরণ নীতির ফলে এ রাজ্যের অর্থনীতি বেশ কোণঠাসা। ফারাক্কা করার পেছনে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিও একটি কারণ। কোনো সন্দেহ নেই, যে কোনো উন্নয়নশীল দেশে নতুন নতুন শিল্প গড়তে বিদ্যুৎকেন্দ্রের গুরুত্ব অপরিসীম। ফারাক্কা উপনগরীতে গড়ে তোলা হলো এনটিপিসি বা ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন।

যা হোক, মূল কথা, প্রস্তাবিত ফারাক্কা হলো উন্নয়নের মডেল। তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের মতোই আমাদের দেশেও বাঁধ বলুন বা ভারী কারখানা গড়তে জমি লাগে। জমি ছাড়া শিল্প অসম্ভব। জমি অধিগ্রহণ তখন বাধ্যতামূলক। ভারতে আজ অবধি যত জমি অধিগ্রহণ হয়েছে, তার নব্বই শতাংশ গরিব মানুষের। আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করেই এলিট ভারত নির্মিত হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভিযোগ-এ নীতি বৈষম্যমূলক। ভারত ন্যায্য পানি না দেওয়ায় শুকনা মৌসুমে বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকায় নদীতে চর পড়ে। চাষের, পানীয়ের বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পানির অভাবে নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ মানুষের। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের এই ‘পানি সন্ত্রাস’ দুই দেশের সম্পর্কে বড় সমস্যা। সত্যি এই স্পর্শকাতর বিষয়টির নিষ্পত্তি কীভাবে সম্ভব তার মীমাংসা একমাত্র রাজনীতিকদের হাতে। কত কিউসেক পানি বাংলাদেশের প্রাপ্য, কতটা সে পায়, কতটা না পেলে সে চরম বিপদে পড়বে, তা নিয়ে আলোচনা হোক। কিন্তু আমরা যখনই ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে, মওলানা ভাসানীর লংমার্চ নিয়ে কথা বলি, তখন মূলত মিছিলের রাজনৈতিক দিক নিয়েই শুধু আলোচনা করি। কিন্তু মওলানা ভাসানীর পদযাত্রার ফলে যে বিষয়টি উঠে এসেছিল, তা হচ্ছে বড় বাঁধ নির্মাণের বিপদ। আজ দেশে দেশে এ বিপদ নিয়ে পরিবেশবাদীরা বিপুল সোচ্চার। আমাদের দেশেও মেধা পাটেকর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সর্দার সরোবর ড্যামের বিরুদ্ধে। কিন্তু ভাসানীর পদযাত্রার সময় এ ড্যাম জনজীবনের পক্ষে বিপজ্জনক হবে, উন্নত দেশে তখন তা নিয়ে কেউ সতর্ক করেননি।

ভাসানী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, সব সময় আমলা ও প্রযুক্তিবিদনির্ভর হলে জানতে পারবেন না পানি শুধু মানুষের নয়, জলজপ্রাণীর কত পরিমাণ লাগে। এমন সংবেদনশীল নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী। কোনো কোনো মানুষের জন্ম নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে হলেও আসলেই তিনি বিশ্ব নাগরিক। উন্নয়নের চিরাচরিত পথে না হেঁটে ভাসানী বিকল্প পথের খোঁজ করতেন। নদীর জলস্রোতের সঙ্গে যে বিপুল পরিমাণ পলি ভেসে নদীগর্ভ ভরাট করে দেবে, তা ভাসানী বুঝতেন। নদীর সঙ্গে দীর্ঘদিন মেলামেশা করার শিক্ষা ভাসানী হুজুরকে যথার্থ পরিবেশবাদী করে তুলেছিল। কদিন আগে বিদেশি এক ইউনিভার্সিটির গবেষকদের সঙ্গে সুন্দরবন, জলঙ্গী নদী হয়ে ধূলিয়ান গঙ্গার চরে চরে খোঁজ করছিলাম পরিবেশ নিয়ে। সব জায়গার ছবি এক। চরা পড়ছে। শেষ হয়ে যাচ্ছে বহু দুষ্প্রাপ্য মাছ ও জলজসম্পদ। বিশেষজ্ঞ থেকে জেলে, মাঝি, ছাত্র সবার ক্ষোভ ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে।

আমার মনে পড়ছিল, বেশ কয়েক বছর আগে বিহারের তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট অনিল কথায় কথায় বলেছিলেন, ফারাক্কা ব্যারেজ তোড় দো, এক ধাক্কা আউর দো। অর্থাৎ এক ধাক্কা দিয়ে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দাও। ফারাক্কার কাছের নগর শামশেরগঞ্জের এক তরুণ গবেষক বোঝাচ্ছিলেন, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগেও ভাঙন ছিল। তার প্রকৃতি আর এখনকার চিত্র ভিন্ন। আগেও-১৯২৩, ’২৮, ’২৯, ’৩৫, ’৩৮, ’৪৯-এ একাধিক ভাঙন ফারাক্কা সন্নিহিত এলাকায় হয়েছে। কিন্তু ১৯৬০ সালে যখন দ্বিতীয় ফিডার ক্যানেলের সাহায্যে গঙ্গা-ভাগীরথী জুড়ে দেওয়া হলো, তখন থেকেই পদ্মার অপমৃত্যু ঘটতে লাগল। আর এরপর থেকেই মালদা, মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকা বিধ্বংসী ভাঙনের কবলে পড়ল। মালদার রতুয়া, কালিয়াচক, পঞ্চানন্দপুর, মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা, ধূলিয়ান, সুতি, শামশেরগঞ্জ, ঔরঙ্গাবাদ, জিয়াগঞ্জ, আখরিগঞ্জ, জলঙ্গির ভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ। একদিন ফারাক্কা অঞ্চল ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল প্রধানত কৃষি। বাঁধের পুবদিকে জাফরগঞ্জের হালদার পাড়ায় ছিল বিরাট এক জেলে বস্তি। চৌকি গ্রাম, নয়ন সুখ ও বামুন গ্রামে ছিল গোয়ালা সম্প্রদায়ের বাস। এ ছাড়া তেলি, তাঁতি, ধুনিয়া, কুমোর, কামার, খোট্টা মুসলমানদের বাসভূমি ছিল এসব অঞ্চল। বেনিয়া গ্রামের আশপাশে আজও দেখা যায় ইংরেজ আমলের কিছু পরিত্যক্ত নীলকুঠি। এদিকে এক সময় চল ছিল ধান, গম, ভুট্টা চাষের। বিদ্যুৎকেন্দ্রে কিছু লোক চাকরি পেয়েছেন। দু-চারটি সিমেন্ট কারখানা এদিকে হয়েছে। তবে বেশিরভাগ লোকজন এখান থেকে জীবিকার জন্য দেশের অন্যান্য রাজ্যে চলে যান।

এখানকার অর্থনীতি আজ বিড়িনির্ভর। ঘরে ঘরে মেয়েরা বিড়ি বাঁধেন। হাজার বিড়ি বাঁধতে পারলে দুশ’ টাকা আয়। একদার কৃষিসমৃদ্ধ অর্থনীতি বাঁধের কল্যাণে আজ বিড়িশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। পানিতে মাছ নেই। কৃষক জমিচ্যুত। সব মিলিয়ে ফারাক্কার প্রভাবে এপারেও আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি। তবুও ১৬ মে এলে এপারেও কখনো সখনো কেউ হয়তো স্মৃতিচারণ করেন ভাসানীর লংমার্চ ও তার দৃপ্ত ভঙ্গিতে পথচলার।

সৌমিত্র দস্তিদার : প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক

দক্ষিণ এশিয়া ফারাক্কা বাঁধ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম