Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শহীদ জিয়ার পানিচুক্তি বনাম শেখ হাসিনার পানিচুক্তি

Icon

মোবায়েদুর রহমান

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শহীদ জিয়ার পানিচুক্তি বনাম শেখ হাসিনার পানিচুক্তি

গতকাল ১৬ মে ছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ৪৯ বছর আগে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে লংমার্চ করেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ৯৫ বছর বয়সেও বার্ধক্যের ভার উপেক্ষা করে বিশাল মিছিল নিয়ে ফারাক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন মওলানা ভাসানী। কথা ছিল, রাজশাহী থেকে এ মিছিল শুরু হয়ে ফারাক্কা পয়েন্টে গিয়ে শেষ হবে। কিন্তু তখন সংগতভাবে মওলানা সাহেবকে পরামর্শ দেওয়া হয়, ফারাক্কা পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ নিয়ে গেলে মিছিল হয়তো ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দিতে চাইবে। সেই সুযোগ নেবে ভারত। তাই সবার পরামর্শে রাজশাহীর কানসাটে এ বিশাল লংমার্চের সমাপ্তি ঘটানো হয়।

এ লংমার্চের একটি তাৎক্ষণিক সুফল হলো, যে ভারত বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার জন্য নানা ফন্দি-ফিকির করছিল, সেই ভারতের টনক নড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়। শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি দেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। মাত্র ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা থেকে ট্রায়াল রান হিসাবে পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিলেও ভারত ট্রায়াল রানের মৌখিক চুক্তি ভঙ্গ করে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে। এর প্রতিবাদ হিসাবে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা ভাসানী সেই ঐতিহাসিক লংমার্চ করেন। এ লংমার্চের পর বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর এ ইস্যুটি জাতিসংঘে উত্থাপন করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। অবশেষে জাতিসংঘের প্রস্তাব মোতাবেক ভারত এবং বাংলাদেশ ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দৃঢ়তা এবং বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞ মরহুম বিএম আব্বাসের বিপুল অভিজ্ঞানের কারণে এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে সমর্থ হয়।

১৯৯৬ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি এক চুক্তি সম্পাদন করেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন পরলোকগত জ্যোতি বসু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দেব গৌড়া। আমি এখন পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাব যে, শহীদ জিয়া ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা থেকে অধিক পানিপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ ভারতের কাছে সম্পূর্ণ বিসর্জন দেন।

১৯৭৭ ও ১৯৯৬ সালের ফারাক্কা চুক্তিতে বাংলাদেশের পানিপ্রাপ্তি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত এবং তুলনামূলক পর্যালোচনা নিচে তুলে ধরা হলো-

২.

১৯৭৭ সালের ফারাক্কা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫ বছরের মেয়াদে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের পানিপ্রাপ্তির ভিত্তি হিসাবে ফারাক্কা পয়েন্টে তিনটি সম্ভাব্য পানিপ্রাপ্তির প্রবাহকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ তিনটি সম্ভাব্য প্রবাহ হলো সর্বোচ্চ প্রবাহ, মধ্যম প্রবাহ ও সর্বনিম্ন প্রবাহ। এ তিনটি পরিস্থিতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বরাদ্দের চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুম ধরা হয় জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত। এ ৫ মাসকে সমান সমান ১৫টি স্লটে ভাগ করা হয়। ফলে প্রতি মাসে ১০ দিন করে তিনটি স্লট এবং ৫ মাসে ১৫টি স্লটে পানি বরাদ্দ করা হয়। এ বরাদ্দের ভিত্তি ছিল গঙ্গার পানি প্রবাহ। যদি প্রবাহ ৭০,০০০ কিউসেকের নিচে নেমে যায়, তখন দু’দেশ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বণ্টন নির্ধারণ করবে। এ সমস্যার একটি যৌক্তিক সমাধানের জন্য একটি যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৭৭ সালের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চুক্তিতে রাখা হয় গ্যারান্টি ক্লজ। অর্থাৎ পানি প্রবাহ যাই হোক না কেন, বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানির নিচে কোনো পানি দেওয়া হবে না।

পক্ষান্তরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে যে চুক্তি করেন, সেটি ছিল স্থায়ী এবং তার মেয়াদ ৩০ বছর। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১২ ডিসেম্বর এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। প্রশ্ন হলো, চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে সেটিকে রিনিউ বা নবায়ন করা হবে কিনা সে ব্যাপারে ভবিষ্যৎ সরকার কী করবে, সেটি এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, শেখ হাসিনার চুক্তি ছিল পানির ব্যাপারে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা ভারতের কাছে বিসর্জন। তাই এ চুক্তি কোনো অবস্থাতেই নবায়ন করা যাবে না। বরং নতুন করে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। কারণটি নিচে বর্ণনা করছি।

জানুয়ারি থেকে মে মাস-এ ৫ মাস হলো দুই দেশের পানিবণ্টনের চুক্তির মেয়াদকাল। প্রতি মাসে ১০ দিন করে ৫ মাসে ১৫টি স্লটে পানি বরাদ্দ করার চুক্তি হয়। ১৯৭৭ সালের শহীদ জিয়ার চুক্তি অনুযায়ী, ন্যূনতম পানি প্রবাহের গ্যারান্টি ছিল ৮০ হাজার কিউসেক।

কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার চুক্তিতে কোনো গ্যারান্টি ক্লজ ছিল না। যদি কোনো যুক্তিসংগত কারণে পানি প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে যায়, তাহলে দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে পানি ভাগ করে নেবে। সে ক্ষেত্রেও শহীদ জিয়ার চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেকের নিচে পানি দেওয়া যাবে না। হাসিনার চুক্তি অনুযায়ী, যদি গঙ্গার পানি প্রবাহ হয় ৭৫ হাজার কিউসেক, তাহলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক এবং বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক। আর যদি প্রবাহ হয় ৭০ হাজার কিউসেক, তাহলে উভয় দেশ সমান সমান ভাগে ৩৫ হাজার কিউসেক করে পাবে।

শহীদ জিয়ার ১৯৭৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ১৫টি স্লটের প্রতিটিতেই বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় কম করে হলেও ১৪ থেকে ১৫ হাজার কিউসেক পানি বেশি পেয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে ১৫টি স্লটের মধ্যে তিনটিতে ভারত বেশি পানি পাচ্ছে। ৬টি স্লটে সমান সমান পানি পাচ্ছে। আর অবশিষ্ট ৬টি স্লটে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি বরাদ্দ পেলেও সেই বেশি বরাদ্দ ছিল মাত্র ১ হাজার কিউসেক থেকে ৪ হাজার কিউসেকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ একটু আগেই আমরা দেখিয়েছি, শহীদ জিয়ার চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতিটি স্লটে কম করে হলেও ১৪ থেকে ১৫ হাজার কিউসেক পানি বেশি পাচ্ছে। জানুয়ারি থেকে মে-এ ৫ মাসের ১৫টি স্লটের স্লটওয়ারি বরাদ্দ আমাদের কাছে রয়েছে। এত বিস্তারিত পরিসংখ্যান দিলে লেখাটি ভারী হয়ে যাবে বলে আপাতত বিস্তারিত দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম। তবে কোনো মহল যদি সেটি চান বা দাবি করেন, তাহলে ১৯৭৭ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫টি করে ৩০টি স্লটের পানি বরাদ্দ আমরা তাৎক্ষণিকভাবে দেব।

৩.

শেখ হাসিনার চুক্তিতে যে ভারত বিজয়ী হয়েছে এবং বাংলাদেশ তার স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে, সেটি সেই সময়কার অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে ভারতীয় সংবাদপত্রে চোখ বুলালেই পরিষ্কার হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এ চুক্তির পক্ষে একশ’ একটি সাফাই গাইলেও খোদ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মরহুম জ্যোতি বসু, অর্থমন্ত্রী অসীম দাসগুপ্ত, বিহারের পানিমন্ত্রী জগনানন্দ সিংসহ কলকাতার এক শ্রেণির পত্র-পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গের একক বিজয়ের জয়ধ্বনি দেওয়া শুরু করেন।

ওই সময় ভারতের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী মি. অসীম দাসগুপ্ত সোল্লাসে বলেছেন, ১৯৭৭ সালের চুক্তির তুলনায় বর্তমান চুক্তি একটি বিরাট বিজয়। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ’৭৭ সালের চুক্তিতে ১৫টি স্লট বা পর্বের মধ্যে ১টি মাত্র পর্বে ভারত পেত ৪০ হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু বর্তমান চুক্তিতে ভারত একটি পর্বের স্থলে ৭টি পর্বে ৪০ হাজার কিউসেক পানি পাবে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে কলকাতা বন্দরে যে পানি সমস্যা ছিল, তা আর থাকবে না।

একই সময় তৎকালীন প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রণয় শর্মা নয়াদিল্লিতে বলেন, এ চুক্তির খসড়া এমন নিপুণতা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রণয়ন করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ পুরোপুরি সংরক্ষিত হয়েছে। ’৭৭ সালের চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের এত অনুকূলে ছিল না।

তৎকালীন বিহারের পানিমন্ত্রী বাবু জগনানন্দ সিং এ চুক্তির পটভূমি সম্পর্কে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছিলেন দ্য টেলিগ্রাফের পাটনার প্রতিনিধি ফয়জান আহমেদের কাছে। বিহারের পানিমন্ত্রী মিস্টার জগনানন্দ সিং এ তথ্য ফাঁস করে বলেন, ভেতরে ভেতরে পশ্চিমবঙ্গের জন্য পানি বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার কিউসেক। এটুকু পানি পেলেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ খুশি হতো। কিন্তু জ্যোতি বাবু একটি চাল দিলেন। আর সেই চাল সফল হলে দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গের বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ৪০ হাজার কিউসেক। আর বিহার, বাংলাদেশ ইত্যাদি ভাগীদারের বরাদ্দ কমে গেছে।

৪.

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৫২ মিনিটে চুক্তিটি সই করার পর দুই প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া ও শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে মিলিত হন। ১২ তারিখ বেলা তিনটার সময় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ইংরেজি নিউজ বুলেটিনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়ার একটি মন্তব্য এবং উক্তি প্রচারিত হয়। এ উক্তি শুনে বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ চমকে ওঠেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়, এ চুক্তি তো হয়ে গেল, এরপর কী? উত্তরে মিস্টার দেব গৌড়া বলেন, এ চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানের দুয়ার খুলে গেল। তিনি আশা করেন, অবিলম্বে এসব দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান হবে। সাংবাদিকরা জানতে চান, প্রধান প্রধান দ্বিপাক্ষিক সমস্যা কী? উত্তরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ট্রেড এবং ট্রানজিট। যখন মিস্টার দেব গৌড়া সাংবাদিকের কাছে এ মন্তব্য করেন, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার পাশেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি দেব গৌড়ার উক্তির প্রতিবাদ করেননি। দিল্লিতে সেদিন যে পানিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, তার সঙ্গে ট্রানজিট নেই, একথা কীভাবে বলা যায়?

উপরের এ দীর্ঘ আলোচনার পর একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জনকারী ১৯৯৬ সালের ফারাক্কার কালো চুক্তি আর নবায়ন করা যাবে না। তার পরিবর্তে সরকারকে একটি কম্প্রিহেনসিভ অ্যাপ্রোচ নিতে হবে। এ অ্যাপ্রোচে থাকবে তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সমস্যা। ভারত যদি রাজি না হয়, তাহলে করিডরসহ ভারতকে প্রদত্ত সব ধরনের সুবিধা পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

মোবায়েদুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক

journalist15@gmail.com

ফারাক্কা দিবস লংমার্চ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম