জমিদারতন্ত্রের অভিশাপ : সমৃদ্ধির শীর্ষ থেকে নিপীড়নের অতলগহ্বরে

মীর সালমান শামিল
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ১৩৩৮ সালে স্বাধীন বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পরের দুশ বছর স্বাধীনভাবে টিকে ছিল। ১৫৭৬ সালে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সুবাহ বাংলায় রূপান্তরিত হয়। মুঘলদের শাসনে বাংলায় শিল্পায়ন হয়, বাণিজ্যে আরও সমৃদ্ধ হয় এবং উপমহাদেশের সবচেয়ে ধনী প্রদেশে পরিণত হয়। বাংলা সালতানাত এবং মুঘল আমলে করের নিয়ম ছিল কৃষকবান্ধব ও উৎপাদননির্ভর। খারাপ আবহাওয়া বা দুর্ভিক্ষ হলে কর কমানো হতো এবং জমিদাররা সাধারণত কৃষকের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করত না। সালতানাতে বাংলা এবং মুঘল আমলের অধিকাংশ জমিদার ছিল মুসলমান। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘আওরঙ্গজেবের আমল, ইন্ডিয়ার মানিটারি সিস্টেম যে কোনো ইউরোপীয় দেশের চেয়ে অনেক বেশি সুপিরিয়র আছিল।’
শুধু আর্থিক ব্যবস্থা নয়-শিক্ষা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে মুসলমান বাংলা উৎকর্ষ অর্জন করেছিল। ১৭০০ সালে বাংলা ছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী ও শিল্পায়িত অঞ্চল। এটি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সমুদ্র বাণিজ্য, উন্নত কৃষিব্যবস্থা এবং বিশেষত বস্ত্রশিল্পের মাধ্যমে বাংলা নিজেকে একটি অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করেছিল। এ সময়ের বাংলার রাজধানী ঢাকা ছিল প্রায় ১০ লাখ মানুষের আবাসস্থল, যা অধিকাংশ ইউরোপীয় নগরীর চেয়ে জনবহুল ছিল। বাংলার বস্ত্রশিল্প, বিশেষত মসলিন কাপড় ছিল বিশ্ববাজারে অতি মূল্যবান পণ্য, যা ইউরোপীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের অভিজাতদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। ১৭০০ সালের সবচেয়ে উন্নত শহরগুলোর র্যাংকিংয়ে ঢাকার অবস্থান ছিল পঞ্চম (১. টোকিও, ২. বেইজিং, ৩. ইস্তাম্বুল, ৪. লন্ডন)। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ ছিল এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের প্রধান কারণ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং একসময়কার সমৃদ্ধ অঞ্চলকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়।
বাংলার মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩ ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চালু করা একটি ভূমিব্যবস্থা, যা বাংলার কৃষি ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনে। এ ব্যবস্থায় জমিদারদের ভূমির মালিকানা স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং তাদের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। যদিও ব্রিটিশরা এ ব্যবস্থা চালুর মূল কারণ হিসাবে কর সংগ্রহের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার কথা বলেছিল, বাস্তবে এটি বাংলার মুসলমানদের জন্য এক ভয়াবহ ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায়।
মুঘল আমলে ছিল কৃষকবান্ধব ও উৎপাদননির্ভর সমন্বিত ও নমনীয় করব্যবস্থা। মুসলিম জমিদাররা রাজস্ব আদায় করত, তবে তারা কৃষকের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং সাধারণত কৃষকের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করত না। রাজস্বের বেশির ভাগ অংশ প্রশাসন, সৈন্যবাহিনী ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় হতো। অন্যদিকে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ব্রিটিশরা নির্ধারিত কর আরোপ করে, যা কৃষকের জন্য আরও কঠোর হয়ে ওঠে এবং তা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ছিল না। ব্রিটিশদের নির্ধারণ করা উচ্চ রাজস্ব দিতে হলে প্রজাদের ওপর অত্যাচার অবশ্যম্ভাবী। কৃষকের ওপর অত্যাচার করে অতি উচ্চ কর সংগ্রহ করতে অধিকাংশ মুসলমান জমিদার অক্ষম হয়। তারা দ্রুত জমির মালিকানা হারাতে থাকে, যা পরে নিলামে বিক্রি করা হয়। এসব নিলামে সাধারণত হিন্দু ব্যবসায়ী ও মহাজনরা অংশগ্রহণ করত এবং তারা সস্তায় জমি কিনে নিত। ফলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুসলিম জমিদার শ্রেণি বিলুপ্ত হতে থাকে, আর সেই জায়গা দখল করে নতুন এক হিন্দু জমিদার শ্রেণি, যারা ব্রিটিশদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখত। এভাবে মুসলমানদের শত শত বছরের জমিদারি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়, যা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে দুর্বল করে ফেলে।
নতুন জমিদারি পেয়ে হিন্দু জমিদাররা কৃষকের ওপর উচ্চ কর আরোপ করে। সম্ভবত আমেরিকার স্লেভ মাস্টারদের পরেই বাংলার জমিদাররা ছিল ইতিহাসের নৃশংসতম শাসকগোষ্ঠী। তারা যেসব কর গরিব প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করত, তা ছিল অবিশ্বাস্য। কার্যত সাধারণ মানুষ ছিল জমিদারদের ক্রীতদাস। স্বপন বসু তার ‘গণঅসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ’ বইতে এর কিছু নমুনা উল্লেখ করেছেন। যেমন-১. গরুর গাড়ি করে মাল পাঠালে ধুলো উড়ত, তাই গাড়ির মালিককে যে কর দিতে হতো, তার নাম ‘ধুলট’। ২. প্রজা নিজেদের জায়গায় গাছ লাগালেও তাকে একটি কর দিতে হতো, তার নাম ‘চৌথ’। ৩. গরিব প্রজারা আখের গুড় তৈরি করলে যে কর লাগত, তা ‘ইক্ষুগাছ কর’। ৪. কোনো প্রজার গরু-মোষ মরে গেলে ভাগাড়ে সেই মৃত পশু ফেলার পর যে কর লাগত, তা হলো ‘ভাগাড়ে কর’। ৫. নৌকায় মাল উঠালে বা নামালে সে করের নাম ছিল ‘কয়ালী’। ৬. ঘাটে নৌকা ভিড়ালে একটি কর লাগত, তার নাম ‘খোটাগাড়ৌ কর’। ৭. জমিদারের সঙ্গে দেখা করতে হলে একরকমের কর দিয়ে সম্মান জানাতে হতো, তার নাম ‘নাজরানা’। ৮. জমিদার কোনো কারণে হাজতে গেলে তাকে ছাড়িয়ে আনতে প্রজাদের একটি কর দিতে হতো, তার নাম ‘গারদ সেলামি’ ইত্যাদি। ৯. মুসলমান দাড়ি রাখলে কর দিতে হতো। ১০. কোনো মুসলমান গোঁফ খাটো করলেও কর দিতে হতো। ১১. যে কোনো ধরনের মসজিদ নির্মাণের আগে মসজিদের আকারের বিচারে ন্যূনতম পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা হারে কর দিতে হতো। ১১. মুসলমান নাম রাখলে নামের জন্য কর দিতে হতো। ১২. মুসলমানদেরও বাধ্যতামূলকভাবে কালি পূজায় চাঁদা দিতে হতো। এছাড়া জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতি মাথায় দিয়ে কিংবা জুতা/স্যান্ডেল পরে হাঁটার অনুমতি ছিল না।
জমিদারি শেষ হওয়ার পর এবার মুসলমান কৃষক ভূমিহীন হতে থাকে। যারা জমি হারান, তারা পরে কৃষিশ্রমিকে পরিণত হন বা ঋণের জালে আটকে যান। ফলে মুসলমান কৃষকের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যেতে থাকে। বাংলার মুসলমানরা শুধু আর্থিকভাবেই নয়, রাজনৈতিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়ে। জমিদারি হারানোর ফলে মুসলিম অভিজাত শ্রেণির শক্তি কমে যায়, কৃষকের দারিদ্র্য বাড়ে, ব্যবসা ও প্রশাসনে তাদের অংশগ্রহণ কমতে থাকে। ফলে মুসলমানরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে, যা তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে। ডব্লিউডব্লিউ হান্টার ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইতে উল্লেখ করেছেন, পলাশীর আগে বাংলায় কোনো মুসলমান দরিদ্র পরিবার ছিল না এবং তার ১০০ বছর পরে কোনো অবস্থাসম্পন্ন পরিবার ছিল না।
জমিদারদের শাসনে ৫০টির বেশি ছোট-বড় দুর্ভিক্ষ হয়েছে দেশে। এসব দুর্ভিক্ষে ২ কোটিরও বেশি মানুষ মারা গেছে। আমরা এর দায় বহন করে চলছি, আগামীর সন্তানরাও এ দায় নিয়ে জন্মাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ফিজিওলজি বিভাগ গবেষণা করে দেখিয়েছিল, ১০০ বছর পরও আমাদের অঞ্চলে যে শিশুটি জন্মাবে, সে ৬ গুণ বেশি ডায়াবেটিস এবং আড়াইগুণ বেশি হার্টের রোগের ঝুঁকি নিয়ে জন্মাবে। কারণ আমাদের শরীর প্রোগ্রাম্ড হয়েছে, ফ্যাট জমিয়ে রাখার ব্যাপারে, যদিও মাস্ল লিনিং হালকা। অমর্ত্য সেন তার রিসার্চে দেখিয়েছেন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বাদ দিয়ে এত বেশি ভাত খাওয়ার যে অভ্যাস, তাও আমরা গড়ে তুলেছি ঔপনিবেশিক খাদ্য ঘাটতির সময়ে।
১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা ছিল জমিদারতন্ত্রের অবসান। ১৯৫০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ পরিষদে জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব বিল পাশ হয়। পরদিন এ খবর ছাপিয়ে দৈনিক আজাদ শিরোনাম করে-‘পূর্ববঙ্গের সাড়ে ৪ কোটি অধিবাসীর বুকের উপর হইতে জমিদারি প্রথার জগদ্দল পাথর অপসারিত : দেশের শোষিত ও নিগৃহীত জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির সূচনা; বৃহস্পতিবার পূর্ববঙ্গ পরিষদে জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব বিল গৃহীত’।
এ গৃহীত বিলটিই ১৯৫১ সালের ১৬ মে গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিন এক সরকারি আদেশে অ্যাক্টে পরিণত করেন। ২০০ বছর পর বাংলার মুসলমানরা আবার জমির মালিক হন। ২০০ বছর পর বাংলার মুসলমানরা কলকাতার হিন্দু জমিদারের প্রজা থেকে নাগরিক হন।
মীর সালমান শামিল : গবেষক, ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি