Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি

Icon

এলাহী নেওয়াজ খান

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি

যে কোনো যুদ্ধ ছোট বা বড়, সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ, তা মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবেই। সেটা নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক, দুটোই হতে পারে। যার ফলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সমাজে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। যুদ্ধে যে দেশ বিজয়ী হয়েছে কিংবা পরাজিত, উভয় ক্ষেত্রেই পরিবর্তনটা যেযন অনিবার্য হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পরাজিত দেশে সে লক্ষণ দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য সেটা বিজয়ীর ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ইংরেজ জাতির মহাবীর হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধোত্তর নির্বাচনে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন।

গত ৭-১০ মে সংঘটিত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। এ যুদ্ধে পরিষ্কারভাবে পাকিস্তান বিজয়ী হয়েছে। সেজন্য দেশটি ১১ মে বিজয় উৎসব পালন করে। আর এ উপলক্ষ্যে পাকিস্তানের একজন সাংবাদিক লিখেছেন, একমাত্র বলিউডের সিনেমাই এ বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারে। মূলত কথাটা এসেছে কারগিল যুদ্ধের ওপর নির্মিত বলিউড ছবির ঘটনা থেকে। সেই যুদ্ধে কে বিজয়ী কে পরাজিত, তা নির্ধারণ করা একটা লম্বা বিতর্কের বিষয়। ওই যুদ্ধ নিয়ে ভারতে কমপক্ষে ছয়/সাতটা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যা ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয়গাথা ছাড়া আর কিছুই নয়।

১৯৯৯ সালের ওই যুদ্ধটা সংঘটিত হয়েছিল কারগিলে। যে এলাকাটি নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের ১১ কিলোমিটার ভেতরে, প্রায় ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। অর্থাৎ পাকিস্তান বাহিনী ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের ১১ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে কারগিল দখল করে নেয়। ভারতের সেনাবাহিনী এটা জানার পর উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এটা ছিল মারাত্মক এক যুদ্ধ। যুদ্ধে পাকিস্তান একটু সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হন। আর পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহারের পরই ভারতীয় বাহিনী ওই স্থান পুনঃদখল করে। তৎকালীন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এ প্রত্যাহার মেনে নিতে পারেননি। যার ফলে সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে।

আমি তখন পরিবেশবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে ইসলামাবাদ গিয়েছিলাম। সেখানে একটা হোটেলে অবস্থান করছিলাম। সম্ভবত সেই দিনটি ছিল ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর। হঠাৎ শুনলাম, নওয়াজ শরিফ সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে বরখাস্ত করেছেন। তার স্থলে সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন তৎকালীন আইএসআই প্রধানকে।

সেদিন পারভেজ মোশাররফ শ্রীলংকা সফর শেষে ইসলামাবাদ ফিরছিলেন। কিন্তু তাকে বহনকারী বিমানটিকে করাচি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতে দেওয়া হচ্ছিল না। তখন অত্যন্ত উত্তেজনাকর একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। টেলিভিশনের সামনে বসে সবাই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় পার করছিল। এরই মধ্যে শোনা গেল, করাচির কোর কমান্ডার লে. জেনারেল আজিজ করাচি বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন। ওখানেই পারভেজ মোশাররফের বিমান অবতরণ করেছে। ততক্ষণে সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে গ্রেফতার করে ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে। অন্যদিকে নওয়াজ শরিফের নিয়োগকৃত সেনাপ্রধান সেনাসদর দপ্তরে ঢুকতে ব্যর্থ হন। এটা ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী একটি পরিস্থিতি বা পরিবর্তন যা যুদ্ধের পর অনেক দেশেই ঘটে থাকে।

এবারের যুদ্ধের সময়ও নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। অপরদিকে সেনাপ্রধান হচ্ছেন জেনারেল অসীম মনির। এবারও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও কেন আমেরিকার চাপে এত দ্রুত যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়া হলো, তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন ওঠা শুরু করেছে। তা কতদূর গিয়ে দাঁড়াবে, এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে সেনাপ্রধান জেনারেল অসীম মুনির গত ১৫ এপ্রিল যে আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে বড় কিছু অর্জন করার স্বপ্ন ছিল। মনে হচ্ছে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন অপূর্ণ রয়ে গেছে। জেনারেল মুনির তার ভাষণে কাশ্মীরকে ‘জগুয়ার শিরা’ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, কাশ্মীরের লড়াকু বীর জনগণকে কখনোই পরিত্যাগ করবেন না বলে উল্লেখ করেছিলেন। সুতরাং কোথায় যেন একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে, এ দ্রুত যুদ্ধবিরতির ফলে সেনাপ্রধান যে লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিলেন, তা হয়তো অর্জিত হয়নি। সুতরাং দ্বন্দ্বের একটা জায়গা রয়ে গেছে। তা ভবিষ্যতে কী রূপ নেয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। ইমরান খানকে মুক্তি দিয়ে সেটা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সেনাপ্রধান, শরিফ ব্রাদার ও পিপিপির মিলিত শাসকচক্র ইমরান খানকে কোণঠাসা করতে গিয়ে জাতিকে যেভাবে বিভক্ত করেছে, তা জাতীয় অনৈক্যের পক্ষে গেছে। খুব শিগগিরই বিজয়ের উচ্ছ্বাস শেষ হয়ে যাবে। পাকিস্তানের রাজনীতি আরেকটি বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। অন্যদিকে ভারত এ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ব্যাকফুটে চলে গেলেও শাসকগোষ্ঠীর প্রোপাগান্ডা মেশিন অর্থাৎ গদি মিডিয়া যে কোনো একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়ে বিজয়ের জয়গান গাইতে পারবে। তবে তারা বুঝতেই পারছে না যে, প্রোপাগান্ডা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য চা ও কাপের মধ্যকার পার্থক্যের মতো। ইতোমধ্যে অলীক শক্তির অধিকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দলবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য নিন্দা ও সমালোচনায় ভাসছেন। আগে থেকেই ভারতের বামপন্থিরা মার্কিনবিরোধী। তাই বামপন্থিরা এ যুদ্ধবিরতি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। মধ্যপন্থিরাও না। ইতোমধ্যে মোদি, অমিত শাহ ও রাজনাথ সিংয়ের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠবে সামনে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দুত্ববাদীদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে আরও বড় যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েই গেছে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুত্ববাদ এক বিষয় না।

পরিশেষে, এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ওপর ভারত নানা ধরনের চাপ সৃষ্টির বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সেজন্য যে কোনো ধরনের খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুত থাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

এলাহী নেওয়াজ খান : সিনিয়র সাংবাদিক

ভারত পাকিস্তান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম