
আমার দাদি খাদিজা আম্মার ১৯৪৮ সালের মে মাসে যখন তাদের বাড়ি থেকে শেষবারের মতো বের হন, তিনি তখন একাকী এক যাত্রা শুরু করেছিলেন। যদিও তার সঙ্গে ছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনি-যারা জায়োনিস্ট মিলিশিয়া কর্তৃক সৃষ্ট ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে তাদের প্রিয় বাড়ি ও জমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল-তবুও বিশ্বের কেউ তাদের দেখছিল না। তারা একসঙ্গে ছিল, তবে সম্পূর্ণ একা। তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য কোনো শব্দও ছিল না। ফিলিস্তিনিরা মে ১৯৪৮-এর ঘটনাগুলোকে নাকবা, অর্থাৎ বিপর্যয় হিসাবে উল্লেখ করতে শুরু করে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের বিপর্যয় কখনোই শেষ হয়নি। আমার দাদির নির্বাসনের সাতাত্তর বছর পরও আমরা শিকারে পরিণত হয়েছি, শাস্তি পেয়েছি এবং মেরে ফেলা হচ্ছে, শুধু আমাদের ভূমিতে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করার জন্য বা সেখানে ফিরে যাওয়ার অধিকার দাবি করার জন্য।
কারণ এটি কখনো সত্যিকারের শেষ হয়নি, নাকবাকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে স্মরণ করা সব সময়ই কঠিন ছিল। কিন্তু আজ একটি নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এসেছে যখন আমরা নাকবা বুঝতে, আলোচনা করতে বা স্মরণ করতে চাই : এটি একটি নতুন এবং ভয়াবহ পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এটি আর শুধু সাতাত্তর বছর আগে শুরু হওয়া ভয়ের ধারাবাহিকতা নয়।
‘নাকবা’ শব্দটি আজ আমার জনগণ এবং আমার মাতৃভূমির ওপর যা করা হচ্ছে, তা বর্ণনা করার জন্য যথেষ্ট নয় বা যথাযথ নয়। একটি নতুন ভাষার প্রয়োজন-নতুন পরিভাষা, যা ফিলিস্তিনের এ নতুন বিপর্যয়ের বাস্তবতা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে।
গাজার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয়েছে। নব্বই শতাংশ স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং জাদুঘর এসবও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আরেকটি শব্দ যা আমি উদ্দীপক এবং অর্থবহ মনে করি তা হলো গাজাসাইড। এটি জনপ্রিয় করেছেন রামজি বারুদ এবং এটি শতাব্দীজুড়ে চলমান বাস্তুচ্যুতি ও গণহত্যার প্রচারণাকে নির্দেশ করে। এই শব্দটির শক্তি তার অপরাধকে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে সঠিকভাবে অবস্থান নির্ধারণ করার ক্ষমতায় নিহিত, সরাসরি গাজাকে গণহত্যার কেন্দ্রীয় স্থান হিসাবে নামকরণ করে। যদিও এ প্রতিটি শব্দই শক্তিশালী এবং অর্থবহ, এগুলো খুবই নির্দিষ্ট হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণতা ধারণ করতে অক্ষম।
বর্তমানে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ‘ধ্বংস’ শব্দটি আর গোপনে বলা হয় না। সামরিক কমান্ডার থেকে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক থেকে শিক্ষাবিদ, ইসরাইলের জনসাধারণের বিশাল অংশ এখন ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ ধ্বংসকেই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে প্রকাশ্যে গ্রহণ করেছে। পুরো পরিবারগুলো মুছে ফেলা হচ্ছে। সাংবাদিক, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী এবং নাগরিক সমাজের নেতাদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। অনাহারে বাধ্য করা-অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পিতামাতারা তাদের সন্তানের মৃতদেহ ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসেন, হত্যাকাণ্ডের দলিল হিসাবে। সম্প্রচার চলাকালীন সাংবাদিকরা নিহত হচ্ছেন। আমরা হচ্ছি শহীদ, আহত, সাক্ষী।
আমার গর্ভবতী এক কাজিন এবং তার পরিবারসহ তাদের নয়জন প্রতিবেশী ১৩ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে নিহত হন। তখন ৭ অক্টোবরের কয়েকদিনের মধ্যেই ডজনখানেক পরিবার সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলা হয়েছিল। ২৬ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে আমাদের ৪৬ জন আত্মীয় নিহত হন। গত গ্রীষ্মে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪০০-এ। তারপর আমি গোনা বন্ধ করে দিয়েছি। আমার চাচাতো ভাই মোহাম্মেদ আমাকে বলে তারা ঘুম থেকে বিরত থাকে ভয়ে যে, সময়মতো জেগে উঠে বাচ্চাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। গত মাসে মোহাম্মেদ একটি বিমান হামলায় আহত হয়েছিল, যেখানে আমাদের চাচাতো ভাই জিয়াদ, একজন ইউএনআরডব্লিউএ সামাজিক কর্মী এবং জিয়াদের ভাবি নিহত হন। একই আক্রমণে ১৫ বছরের নিচে পনেরো শিশু আহত হয়েছিল। সেই রাতে গত ১৮ মাসে অসংখ্যবারের মতো, মোহাম্মেদ ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল। সে আমাকে বলে, মৃতদের মুখ প্রতিদিন রাতে তার কাছে আসে-পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী। দিনে সে একটি পুরোনো ছবির অ্যালবাম উলটে দেখে, কিন্তু এখন প্রতিটি ছবিতেই একটি শূন্যতা বিরাজ করে। কোনো একটি ছবিই হতাশার ছায়া ছাড়া থাকে না। রাতে তারা তার কাছে ফিরে আসে-কখনো কোমল স্বপ্নে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় দুঃস্বপ্নে।
এই মাসে-৭ মে, গাজা শহরের একই সড়কে সব সময় ভিড় থাকে এমন এক রেস্তোরাঁ ও বাজারে ইসরাইলি হামলায় কয়েক ডজন মানুষ কয়েক মিনিটের মধ্যে নিহত হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন এক সাংবাদিক (ইয়াহিয়া সুবেইহ), যার প্রথম সন্তান, এক শিশু মেয়ে, সেই সকালে জন্মগ্রহণ করেছিল। সে তার স্ত্রীর জন্য বাজার থেকে জরুরি পণ্য আনতে গিয়েছিল এবং আর ফিরে আসেনি। তার মেয়ে তার জন্মদিন পালন করবে, ঠিক সেই দিন যেদিন তার বাবা নিহত হয়েছিল-একটি ভয়ংকর স্মৃতি সদ্য শুরু হওয়া জীবনে গভীরভাবে ছাপ ফেলে। অন্য এক সাংবাদিক (নূর আবদো) এই যুদ্ধে নিহত আত্মীয়দের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন। তিনি ৬ মে একটি মানবাধিকার সংস্থায় তালিকাটি পাঠিয়েছিলেন। ৭ মে, সেই তালিকায় তিনিও যুক্ত হন।
একটি রেস্তোরাঁর কর্মচারী, যেখানে হামলা হয়েছিল, দুই তরুণী একটি পিজ্জা অর্ডারের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি তাদের কথোপকথন শুনেছিলেন। ‘এটা খুবই দামি,’ একজন অন্যজনকে বলল। ‘ঠিক আছে’, সে জবাব দিল, ‘আমাদের স্বপ্ন পূরণ করি এবং মারা যাওয়ার আগে পিজ্জা খাই। কেউ জানে না।’ তারা হাসল এবং অর্ডার দিল। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের অর্ডার এসে পৌঁছায়, কিন্তু রেস্তোরাঁটি গোলাবর্ষণে বিধ্বস্ত হয় এবং তরুণীদের একজন নিহত হন। কর্মচারী আরেকজনের ভাগ্য জানেন না। তবে তিনি লক্ষ করেছেন তাদের পিজ্জার একটি স্লাইস খাওয়া হয়েছে।
‘এই সবটাই আল-ইবাদাহ। এটি ধ্বংসযজ্ঞ।/বিশ্বজনীন নীরবতার সামনে আমরা অসহায়।/আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের কান্না, আমাদের আর্তনাদ সবই বৃথা হয়ে গেল।/ আমরা এখন কেবল কথাই বলতে পারি। এর শক্তিও কম নয়।’
আইরিশ নাটক ‘ট্রান্সলেশনস’-এ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কর্তৃক আইরিশ ভাষার ধ্বংসের কথা তুলে ধরে নাট্যকার ব্রায়ান ফ্রিয়েল বহু আগেই ব্যাখ্যা করেছিলেন, কোনো কিছুকে নামকরণ করে আমরা তাকে শক্তি প্রদান করি, আমরা ‘তাকে বাস্তব করে তুলি।’ সুতরাং এক চূড়ান্ত হতাশার মধ্যে, চলুন এই বছরের নাকবার স্মরণে আমরা বিষয়টিকে নতুন নাম দিয়ে একে আরও বাস্তব করে তুলি: আল-ইবাদাহ, ধ্বংসযজ্ঞ।
(আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মোহাম্মদ কবীর আহমদ)
ঘাদা আগিল : অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক