সাহসী সন্তানদের সম্মান ও নিরাপত্তা দিতে হবে

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) রোকন উদ্দিন
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাসের গৌরব ও বর্তমান সংকট : জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ছিল নিপীড়ন, দুঃশাসন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক অনন্য প্রতিরোধ। এই তরুণ ছাত্ররা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ কিছু মহল তাদের সংগ্রামের গুরুত্ব কমিয়ে দেখানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। বিভিন্নভাবে তাদের বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে, তাদের ত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে এবং তাদের ঐক্য বিনষ্টের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এর চেয়েও শঙ্কার বিষয় হলো, এই সাহসী ছাত্রদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। তাদের অনেকে এখনো সেই আন্দোলনের জন্য ভোগান্তির শিকার, অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দেশের শত্রুরা সব সময়ই সক্রিয় থাকে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে এবং বীরদের ইতিহাস মুছে ফেলতে। তাই এখনই সময়, জাতি হিসাবে আমাদের দায়িত্ব পালন করার-এই বিপ্লবী সন্তানদের যথাযথ সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ভুলপথে পরিচালিত করার ষড়যন্ত্র : জুলাই বিপ্লবের অনেক মুরব্বি ও নীতিনির্ধারক হয়তো প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেননি। কিছু মহল তাদের ভুলপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে, বিভ্রান্ত করছে এবং তাদের প্রকৃত লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক, কারণ জাতির ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতেই। যদি তারা পথভ্রষ্ট হয়, তবে জাতির অগ্রগতি ব্যাহত হবে। সাহসী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের উপহাসের পাত্রে পরিণত হতে দেওয়া যায় না। তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং একটি শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপ হিসাবে কাজ করতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতেও জাতীয় স্বার্থে লড়াই করতে পারে।
প্রেসার গ্রুপ হিসাবে সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা : ঐক্যবদ্ধ শক্তি কখনোই পরাজিত হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য যে, একতা থাকলে যে কোনো স্বৈরাচারী শক্তি পরাজিত হয়। তাই জুলাই বিপ্লবের সাহসী সন্তানরা যদি নিজেদের শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপে পরিণত করতে পারেন, তবে তারা ভবিষ্যতে জাতীয় সংকটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। এ গ্রুপের কাজ হবে-
নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা : জুলাই বিপ্লবের সাহসী সন্তানরা দেশের জন্য লড়াই করেছেন, কিন্তু আজ তাদের জীবন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে। ইতিহাস সাক্ষ্য যে, যখন কোনো পরিবর্তনের আন্দোলন সফল হয়, তখনই তার নেতাকর্মীদের বিভিন্নভাবে দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়। কিছু মহল তাদের ভয় দেখাতে চায়, হুমকি দেয়, এমনকি শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি করার চেষ্টাও চালায়।
ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা রুখে দেওয়া : জুলাই বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা সাহস, আত্মত্যাগ এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেকেই ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করছে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ বিপ্লবের প্রকৃত চেতনা ভুলে যায় এবং ভুল তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করা যায়। এ ধরনের অপচেষ্টা রুখতে প্রামাণ্য তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। আন্দোলনের সত্যিকারের ইতিহাস সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। যারা সেই সময়ের সাক্ষী, তাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে হবে। সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে। ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে সত্য প্রচার করা প্রয়োজন।
যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলা : যে কোনো বড় আন্দোলনের পরই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। যারা ক্ষমতা হারিয়েছে বা তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে চায়, তাদের বদনাম করতে চায়, এমনকি ভিন্নপথে পরিচালিত করার ষড়যন্ত্র চালায়। এ ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে দৃঢ় মনোবল রাখতে হবে।
জাতীয় স্বার্থে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা : গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন কখনোই শেষ হয় না। একবার স্বৈরাচার পতন হলেই যে দেশ চিরকাল গণতান্ত্রিক থাকবে, তা নয়। তাই জাতীয় স্বার্থে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতেও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায়। এ ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল করতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে।
শিক্ষার গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব : একটি জাতির ভবিষ্যৎ তার শিক্ষিত জনগণের হাতে থাকে। শুধু আন্দোলন করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য যোগ্যতা অর্জন করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং তা অর্জনে মনোযোগ দিতে হবে। নেতৃত্বের জন্য জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার জন্য শুধু সাহস থাকলেই হবে না, যোগ্যতাও থাকতে হবে। তাই রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। কেবল একাডেমিক শিক্ষা নয়, নেতৃত্বের জন্য যোগাযোগ দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে অভিজ্ঞতা নিতে হবে।
সরকারের দায়িত্ব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা : সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হলো দেশের সাহসী সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যারা জাতির জন্য লড়াই করেছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল নৈতিক দায়িত্বই নয়, এটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্যও জরুরি। সরকারের উচিত, এই ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের সঠিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা বন্ধ করা এবং তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি প্রদান করা।
জুলাই বিপ্লবের সাহসী সন্তানদের লড়াই একদিনে শেষ হওয়ার নয়। তারা দেশের জন্য বড় একটি আত্মত্যাগ করেছেন, কিন্তু এখন তাদের সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ইতিহাস রক্ষা করা, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা, জাতীয় স্বার্থে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করা এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য শিক্ষিত হওয়া-এ পাঁচটি দিকের প্রতিটির ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এই প্রজন্মের ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের বাংলাদেশ। যদি তারা সঠিক পথে থাকে, তাহলে জাতি উপকৃত হবে; আর যদি তারা বিভ্রান্ত হয়, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই এখনই সময়, ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এবং জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখার।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) রোকন উদ্দিন, পিএসসি : সাবেক কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক