Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিক্ষা সমাজ দেশ

অন্তহীন নিরাশায় নিমজ্জিত মানবজাতি

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অন্তহীন নিরাশায় নিমজ্জিত মানবজাতি

ছবি: সংগৃহীত

আমরা মানবসভ্যতার গর্বিত দোলনায় চড়ে দোল খাচ্ছি। তাহলে এখন সর্বত্র আসল মানুষের সন্ধান করতে হচ্ছে কেন? কারণ বিশ্ব আজ বড্ড দুর্বিষহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। মানুষকে নিয়েই এ বিশ্ব, মানুষই চরাচর। এ মানুষই সুর-অসুর। অসুরের পদভারে আজ বিশ্ব মথিত, ভয়ে প্রকম্পিত, কুটিল কৌশলে নিষ্পেষিত। এ বিশ্বে মানুষের অস্তিত্ব যদি না থাকে, বিশ্বটা তখন বিবর্ণ-বিমথিত বা সুবর্ণ শস্য-শ্যামলা-দৃষ্টিনন্দিত হলো কিনা, তাতে মানুষের কী এসে যায়! মানুষ বাঁচে বড়জোর একশ বছর। সময়টা সুন্দর, সুখ-শান্তির সঙ্গে বাসযোগ্য হতে হলে এ বিশ্বে আসল মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে, যারা সুস্থ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী; বিশেষ করে যাদের মুখের কথায়, চিন্তা-চেতনায়, সব কর্মে সাধারণ মানুষ, সব দেশ ও সমাজ নিরাপদ। পক্ষান্তরে রাক্ষস-দানব ও দানবীয় চিন্তা-চেতনা কমাতে হবে। বাস্তবে কি তা হচ্ছে? আসল মানুষ হওয়ার সুশিক্ষা কি তারা আজন্ম পাচ্ছে?

মানুষ কে? মানুষের ঘরে জন্ম নিলেই কি মানুষ হওয়া যায়? দেখতে মানুষরূপ ধারণ করলেই কি তাকে মানুষ বলা যায়? এখানেই আমরা বড় ভুলটা করে বসি। এ বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখানেই সমস্যা। এ ধরনের শতেক প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। উত্তরের জন্য কার কাছে যাব! যার মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা নেই, বা আত্মজিজ্ঞাসার ধার একেবারেই ভোঁতা হয়ে গেছে, বিবেকবোধ নিষ্ক্রিয়, পশুত্ব জেগে উঠেছে, তাকে মানুষ না বলে পশু বলাই তো শ্রেয়। পশু পোশাকে সজ্জিত হয় না। পোশাক পরলেই তো মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য এখানেই।

আসল মানুষ হতে গেলে মনুষ্যত্ব আগে থাকা দরকার। মানুষ রূপে জন্মেছি বলেই মনুষ্যত্ব থাকবে, তা নয়। মনুষ্যত্ব বা মানবতাবোধ আছে বলেই আমাদের মানুষ বলা হয়। বিবেক সবসময় জাগ্রত থাকতে হবে। আত্মজিজ্ঞাসাও মানুষ হওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য। আসল মানুষ হতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি এবং প্রতিটি সৃষ্ট জীবের প্রতি অবিমিশ্র মমত্ববোধ একটা আবশ্যকীয় উপাদান। ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানুষ ও জীবের প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টি করে এ গুণ থাকাও অপরিহার্য। ন্যায়নিষ্ঠা ও সততা মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে। এ দুটি গুণও আসল মানুষের মধ্যে থাকতে হয়। এসব গুণ ছোটবেলা থেকে শিক্ষার মাধ্যমে মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হয়। তথাকথিত মানুষের মধ্যে এসব গুণের অভাব আছে বলেই তারা পৃথিবীতে বসেও রকেট ছুঁড়ে প্রকৃতিকে কলুষিত করছে, মানবসভ্যতাকে নিত্য-নতুনভাবে অবিরাম আরও বিপর্যস্ত-নাস্তানাবুদ করে চলেছে। সেক্যুলারিজম মতবাদের ধুয়া তুলে ধর্ম-কর্মের মূল-মানবতার জাগরণ, মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবজাতির কল্যাণ ও ন্যায়নিষ্ঠাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমরা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কী না করছি! সূর্যের আলো তো সবার জন্য উন্মুক্ত। কোনো শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা খাটিয়ে সূর্যের আলো পেতে আমাদের যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কেমন হবে? প্রকৃতি প্রদত্ত ধারায় বিভিন্ন দেশের ওপর দিয়ে অবিরাম বয়ে যাওয়া নদীর পানি-প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে অন্যের ক্ষতি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অভিন্ন চুয়ান্নটি নদীর পানির এ অবস্থা কেন? এক দেশ অন্য দেশের প্রতি প্রতিহিংসায় মেতে সেদেশকে নিজ স্বার্থে গ্রাস করতে বদ্ধপরিকর হচ্ছে, কোনো প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়কে বোমা মেরে বসতবাটি থেকে সমূলে উচ্ছেদ করে বিশ্বের মানচিত্র থেকে বিলীন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। রাশিয়া ও আমেরিকা কর্তৃক পর্যায়ক্রমে আফগানিস্তান দখল ও অধীন করে সেখানকার খনিজ সম্পদ লুট করার চেষ্টা, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ, পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের নিজ ভূমি থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় উচ্ছেদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নিগ্রহ-অত্যাচার, সিরিয়ার ভ্রাতৃঘাতী প্রতিপক্ষ দমন, মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনি নিধনযজ্ঞ-এ হলো হাতেগোনা কয়েকটা উদাহরণ। পরিতাপের বিষয়, ফিলিস্তিনি নিধনযজ্ঞে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমগোষ্ঠী জ্ঞাত কারণে নিশ্চুপ। ঘটনাগুলো কত মর্মন্তুদ! মন থেকে ভাবার অবকাশও আমাদের নেই।

দানবের দানবীয় কর্মে, প্রতিহিংসায়, উদগ্র স্বার্থপরতায় কত কোটি নিরীহ মানুষ যে ইতিহাসের অলক্ষ্যে বাস্তহারা, পঙ্গু বা চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তার কি কোনো হিসাব আছে! হিংস্রতা, বিকারগ্রস্ততা ও মানসিক বিকলতা আজ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য স্থানীয় নেতা, আঞ্চলিক নেতা ও বিশ্ব-ক্ষমতাধর দেশচালকদের অন্তর্নিহিত মনব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। মানুষ হয়ে মানুষ হন্তারক, এ কোন রক্তপিপাসু জিঘাংসা! এ কোন মানবকুলনাশী অনির্বার নেশা! বিষয়গুলো আমাদেরও ক্রমেই গা-সওয়া হয়ে গেছে। সবই বিকৃত অমানুষসুলভ মানসিকতার ফসল। এসব মানবসভ্যতার ললাটে কলঙ্কের তিলক তো বটেই।

দেশচালকদের কেউ কেউ দেশীয় মোড়ল, কেউবা আঞ্চলিক মোড়ল, কেউবা বিশ্ব-মোড়লের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। কোনো কোনো বিশ্ব-মোড়লের কার্যকলাপ ও চিন্তা-চেতনার মধ্যে ধর্মে বর্ণিত কলিযুগের দজ্জালের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তাদের কর্মকাণ্ড ও চিন্তা-চেতনার মধ্যে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই; তাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থই প্রধান। অথচ আঞ্চলিক নেতা বা বিশ্বনেতা হয়ে বসে আছে। প্রতিহিংসায় মনটা ভরপুর। অথচ মানবকুলে এদের বসবাস। ‘তুমি কি মনে করো যে, তাদের অধিকাংশ লোক শোনে অথবা বোঝে? তারা তো চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তারা আরও বেশি পথভ্রষ্ট’ (সূরা আল ফুরকান, ২৫:৪৪)।

কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ হত্যায়, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সবল উচ্ছেদে, অন্য দেশ লুটপাটে, মারণাস্ত্র ব্যবসায় কোনো কোনো দলনেতা, গোষ্ঠীনেতা, গোত্রনেতা এ বিশ্বে জোটবদ্ধ হয়েছে। তাই সৃষ্টির সেরা মানুষের আজ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। অনেক দেশের নির্জীব পরিচালকরা ভালো মানুষ সেজে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। মানবসমাজে এ আবার কোন অনাসৃষ্টি-অবিচার?

মানুষের ভাঁজে ভাঁজে দানবের সদম্ভ উপস্থিতি মানবজাতির অস্তিত্ব ও বসবাস দুর্বিষহ করে তুলেছে। সব দেশেই একই মানুষ, একই রঙের রক্ত শরীরে নিয়ে বসবাস করছে। দানবদের নিজ দেশের জন্য সুনজর, ভিনদেশের মানুষের প্রতি অনিষ্ট চিন্তা। মানবতাবোধ, ঔচিত্যবোধ, গণতন্ত্রের প্রকৃত মূল্যবোধ কোথায়? ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মেকি দেশপ্রেম দেখিয়ে কিংবা বিপক্ষ কারও প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া। তারপর নিজ স্বার্থে বিশ্বলুটের মওকা খোঁজা, সাম্রাজ্য বিস্তারের ধান্ধা, ক্ষমতায় টিকে থাকার অজুহাত আবিষ্কার করা। সুস্থ চিন্তার, মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন আসল মানুষ কোথায়! যারা মরছে, তারা মরে মরে বিপুল সংখ্যাতীত হচ্ছে; যারা মারছে, তারা মেরেই চলেছে। কৌটিল্যের কুটিলতার যেন শেষ নেই! মানবজাতি আজ অন্তহীন নিরাশায় নিমজ্জিত। এ থেকে বেরিয়ে আসারও সুচারু পথ ও পাথেয় আছে, সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ করার ফুরসত নেই। দানব হস্তীমূর্খ হওয়ায় কাঁধে জোয়াল নিতে অনীহা। সব সমস্যারই সমাধান আছে। আমরা দানব তৈরির শিক্ষা দিচ্ছি। বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এতে কমপক্ষে আশি শতাংশ মানবগোষ্ঠী দানব না হয়ে আসল মানুষ হবে। জাতিসংঘের নীতিমালা ও পরিচালন-ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে পৃথিবীটা মানুষের বাসযোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে পারে।

ড. হাসনান আহমেদ : সাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ

pathorekhahasnan.com

মানবজাতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম