Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

খান, মুহম্মদ, কালিমুদ্দিন : জেল জরিমানা হাজত?

Icon

অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অধ্যাপক আলী খান মাহমুদাবাদ আপাতত জেলে। সবে জামিন দেওয়া হয়েছে তাকে সুপ্রিম কোর্ট থেকে। তিনি হয়তো জেল থেকে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু তাকে থানায় হাজিরা দিতে হবে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে। তদন্তের জন্য আলাদা দলও গঠন করা হয়ে গেছে। তাকে বলা হয়েছে পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে। তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগও আছে। তিনি নাকি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভোমিকা সিং আর কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে অপমান করেছেন!

ওদিকে মধ্যপ্রদেশের ক্যাবিনেট মন্ত্রী বিজয় শাহ, যিনি কর্নেল সোফিয়া কুরেইশিকে সন্ত্রাসবাদীদের বোন বলেছিলেন, তিনি এখনো মন্ত্রী। তার বিরুদ্ধে একই ধারায় মামলা আছে, অনেক কিছুই বলা হচ্ছে; কিন্তু বটম লাইন হলো, তিনি এখনো মন্ত্রী। কেবল তিনি তার টুইটার হ্যান্ডেলে একটা ক্ষমা চেয়েছেন, ব্যস। তো কেন বিজয় শাহ এখনো জেলের বাইরে শুধু নয়, মন্ত্রী পদেও বহাল তবিয়তেই বসে আছেন; আর কেন অধ্যাপক আলী খান মাহমুদাবাদ জেলে? কারণ খুব সোজা-এখানে ধর্ম স্থির করে দিচ্ছে অপরাধের মাত্রা আর সাজা। হ্যাঁ, এটাই আপাতত ভারতের নিও নর্মাল।

তো অশোকা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী খান মাহমুদাবাদ ঠিক কী বলেছেন? কেন, কার অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি জেলে? এই অধ্যাপক এক ফেসবুক পোস্ট করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন ‘অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানকে একটা বার্তা দিয়েছে যে, যদি তোমরা তোমাদের সন্ত্রাসবাদের সমস্যাটা না সামলাও, তাহলে আমরা সামলাব!’ আমাদের প্রত্যেকের কথা, আমাদের দেশে সন্ত্রাসবাদীদের পাঠিয়ে আমাদের নাগরিকদের হত্যা করলে আমরা জবাব দেব, যে কোনো দেশ, যে কোনো সভ্য মানুষ তার কথার সঙ্গে একমত হবেন। তারপর তিনি লিখেছেন, ‘উভয় পক্ষের বেসামরিক মানুষের জীবনহানি খুব দুঃখজনক এবং এ কারণেই যুদ্ধ এড়িয়ে চলা উচিত। যারা নির্বোধের মতো যুদ্ধের পক্ষে কথা বলছে, তারা কেউই যুদ্ধ দেখেনি, এমনকি যুদ্ধ অঞ্চলে থাকেনি বা সেখানে যায়ওনি...।’

এটাও নতুন কোনো কথা নয়, কারণ ক’দিন আগেই সামরিক বাহিনীর সাবেক ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ নারাভানে বলেছেন, ‘বেশ কয়েকজন সামরিক অভিযান স্থগিত করার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এই যুদ্ধবিরতি ঠিক না ভুল? এমন কৌতূহলও তাদের রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, যুদ্ধ কোনো রোমান্টিক বিষয় নয়। কিংবা এটা বলিউড সিনেমা নয়। যুদ্ধ বা হিংসার পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত দেওয়ালে একেবারে পিঠ ঠেকে গেলে তবেই অবলম্বন করা উচিত। ঠিক যে কারণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটা যুদ্ধের যুগ নয়। যদিও কিছু অজ্ঞ লোক চাইছেন, আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে; তবে আমি আবারও বলব, যুদ্ধ নিয়ে এত উল্লাস করা উচিত নয়। এই অবস্থা সত্ত্বেও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সতর্ক ছিল যাতে সামরিক বা বেসামরিক স্থাপনা বা পরিকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু না করা হয়, যাতে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা না বাড়ে।’ এই কথাটা বলেছেন জেনারেল নারাভানে। অধ্যাপক মাহমুদাবাদ সেই কথাই বলেছেন। এ কথাটা বলার পর অধ্যাপক মাহমুদাবাদ আবার লিখেছেন, ‘দুজন মহিলা সৈনিকের তাদের তথ্য উপস্থাপন করাটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এই অপটিক্স বা বাহ্যিক চাকচিক্যকে বাস্তবতায় রূপান্তরিত হতে হবে, না হলে কেবল এটাই হলে এটা শুধুই ভণ্ডামি হবে।’

হ্যাঁ, যে সরকারি দলের নেতারা, তাদের মাথায় আরএসএস প্রধান, মনে করেন যে, নারীদের জায়গা রান্নাঘরে আর সন্তান পালনে, যারা এই কদিন আগেও নারীদের সেনাবাহিনীতে এই জায়গা দিতে রাজিই ছিলেন না, তারা আজ দুজনকে এনে দাঁড় করিয়েছেন, ভালো করেছেন; কিন্তু তার আসল চেহারাটা পালটাতে হবে, নারী সম্পর্কে মনোভাব পালটাতে হবে, না হলে এটা কেবল এক চোখ ধাঁধানো অপটিক্স হয়েই থাকবে, দেখতে ভালো লাগবে, অপারেশন সিঁদুর নামের সঙ্গে মানাবে ভালো, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না। একজাক্টলি এই কথাটাই তিনি বলেছেন, একটাও ভুল কথা বলেননি। তাহলে কিসের জন্য জেল? এবং তারপরে যা তিনি লিখেছিলেন তা হলো, ‘কর্নেল সুফিয়া কুরেশিকে এত দক্ষিণপন্থী ভাষ্যকারদের প্রশংসা করতে দেখে আমি খুব খুশি। কিন্তু হয়তো তারা গণপিটুনি, নির্বিচারে বুলডোজার চালানো এবং বিজেপির ঘৃণা ছড়ানোর শিকার অন্য ভারতীয় নাগরিকদের সুরক্ষার দাবিটাও সমান উচ্চস্বরে করতে পারতেন।’

হ্যাঁ, অর্ণব গোস্বামী থেকে এ রাজ্যে ডিমের নয়, কীসের যেন কুসুম অ্যাঙ্কর বা ক্ষণে ক্ষণে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়া অ্যাঙ্করনিরা বলছেন, দেখেছেন একজন মুসলমানও আমাদের দেশ রক্ষা করছেন। ভালো কথা। করারই তো কথা, অস্বাভাবিকতাটা কোথায়? তিনি মুসলমান, আমাদের দেশের নাগরিক। কিন্তু এই এরাই যখন মব লিঞ্চিং হয়, যখন কেবল মুসলমান বলে বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙা হয়, তখন কোথায় থাকেন? এই প্রশ্ন করাটা কি স্বাভাবিক নয়? আমিও তো আমার চ্যানেলে এই প্রশ্ন করেছি, একবার নয়, বারবার করেছি। আমি দেশদ্রোহী? নাকি আমার নামের পেছনে চ্যাটার্জি আছে আর ওনার নামের আগে খান আছে, আলী আছে, তাই ফারাক হয়ে গেল?

অধ্যাপক মাহমুদাবাদ এরপরে লিখেছেন, ‘যখন একজন বিশিষ্ট মুসলমান রাজনীতিবিদ পাকিস্তান মুর্দাবাদ বললেন, এবং পাকিস্তানিরা এজন্য তাকে ট্রল করল, ভারতীয় দক্ষিণপন্থি ভাষ্যকাররা তাকে রক্ষা করে বললেন সে আমাদের মোল্লা। এটা যদিও মজার, কিন্তু এটাও দেখার যে, ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা কতটা গভীর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।’ সত্যি কথা। এবং সব শেষে ওই অধ্যাপক লিখেছেন, ‘এই প্রেস কনফারেন্সটা প্রমাণ করে দিয়ে গেল যে বৈচিত্র্যে ভরা একটি ঐক্যবদ্ধ ভারত ধারণাটা পুরোপুরি মরে যায়নি। জয় হিন্দ।’

এই কথাগুলোর মধ্যে এমন কী আছে, যা একবারের জন্যও সামান্য সন্দেহের জন্ম দেয় যে এই লোকটি দেশদ্রোহী? তিনি সেনাবাহিনীর ওই দুই মহিলা অফিসারকে অপমান করেছেন-একটা শব্দেও এমন কিছু পাওয়া যাবে না। আর সেটা না পেলে একটা বিষয় বাকি থাকে, তা হলো হিজ নেইম ইজ খান অ্যান্ড হি ইজ এ টেররিস্ট।

হ্যাঁ, তাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অশোকা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকরাসহ দুই হাজারেরও বেশি অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী লিখে জানিয়েছেন, অধ্যাপক আলী খান মাহমুদাবাদকে মুক্ত করা হোক। বহু মানুষ বলেছেন, ইয়েস, হি ইজ খান অ্যান্ড হি ইজ নট এ টেররিস্ট। কিন্তু তিনি জেলে।

আপনারা বলতেই পারেন যে, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। না, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত ১০-১২ বছর ধরে এটাই নিও নরমাল। দেশের সংখ্যালঘু মানুষদের অবস্থার দিকে একটু নজর দিলে আমরা কী দেখতে পাব? উত্তরপ্রদেশের সম্বলে কোর্ট গার্বি এলাকায় ২৩ বছরের একজন ইমাম তার মসজিদে আজান দিচ্ছিলেন। তার আজান নাকি উচ্চগ্রামে ছিল। তাই তাকে দুই লাখ টাকা ফাইন করা হয়েছে। এই জরিমানা করেছেন এলাকার সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট। গোপনে করা হয়নি। প্রকাশ্যে জরিমানা করা হয়েছে। কোন মুখে আমরা অন্য আরেক দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলব।

গত মঙ্গলবার সকালবেলায় ৮ হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করা হয়েছে। তাদের সমস্ত ঝুপড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তারা নাকি বাংলাদেশি। তারা বাংলায় কথা বলে, সেজন্য তারা বাংলাদেশি। আসলে বিজেপি-আরএসএসের মাথায় এক হিন্দুরাষ্ট্রের চিন্তা আছে, যেখানে সংখ্যালঘুরা হবেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আপনারা ভাবছেন, কেবল সংখ্যালঘুরা। না, এখন তাদের লক্ষ্য সংখ্যালঘু, এরপর তাদের লক্ষ্য হচ্ছে গিয়ে হিন্দিভাষী ছাড়া প্রত্যেক মানুষ, তারপর তাদের লক্ষ্য হচ্ছে গিয়ে যে কোনো গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। যেখানে তাদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। আর আপাতত এই জিগিরের ফলে হিন্দু-মুসলমান এক তীব্র মেরুকরণ হবে। আর সেই মেরুকরণের রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে আরএসএস-বিজেপি মসনদে চিরটাকাল থেকে যাবে। আরএএস তাদের দলিলে সারসাংরা খুব পরিষ্কার বলে গেছেন, এই দেশের নাগরিক তারাই যাদের পিতৃভূমি-কর্মভূমি কেবল নয়, পুণ্যভূমি হবে এই দেশ। কাজেই যারা মক্কা যাবে হজ করতে, জেরুসালেম, ভ্যাটিকানে যাবে, তারা দেশের নাগরিক নয়। এটাই হিন্দুরাষ্ট্রের চেহারা। তারা লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়, মুসলমানদের এদেশে থাকতে গেলে মক্কা-মদিনা-কাবা ছাড়তে হবে, এই দেশের কোনো ভগবানকে মেনে পুজো করতে হবে। খ্রিস্টানদের জানিয়ে দেয়, বেথেলহেম বা ভ্যাটিকান হতেই পারে না তাদের পুণ্যভূমি। তাহলে তারা ভারতীয় নয়। কাজেই নামের পেছনে আলী, খান, মুহম্মদ থাকলে জেলে যাওয়া হয়ে উঠেছে এক নিও নরমাল। এবং তারা কারা? তারা আমার দেশের ১৭-১৮ শতাংশ সহ-নাগরিক। আমার দেশের ১৭-১৮ শতাংশ মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখে আমরা বেঁচে থাকব-যদি কোনো মূর্খ এ ধরনের ভাবনা ভাবতে পারে, তাহলে তার মাথা দেখানো উচিত। যা চলছে, আমাদের এখনই এ নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদেরকে রাস্তায় নামতে হবে।

বাংলা বাজার ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে

অনিকেত চট্টোপাধ্যায় : সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম