Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের নেপথ্যে

Icon

ড. জন স্ফাকিয়ানাকিস

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের নেপথ্যে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর শুধু একটি আনুষ্ঠানিক সফর ছিল না। এটি ছিল কৌশলগত প্রক্ষেপণের একটি সুপরিকল্পিত বিষয় : অংশত অস্ত্রবাজার, অংশত ভূ-রাজনৈতিক নাটক এবং অংশত বাণিজ্য মিশন।

সময়কালটিও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাবের বিষয়টিকে আর স্বাভাবিক অনুমান হিসাবে ধরা হয় না, এবং এ অঞ্চলের আকাঙ্ক্ষাগুলো ঐতিহাসিক নির্ভরশীলতাকে ছাড়িয়ে গেছে। চীন যখন তার প্রভাব বিস্তার করছে এবং উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো সাহসী রূপান্তরের ভিশন অনুসরণ করছে, তখন এই সফর বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে ওয়াশিংটনের অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতাকে পরীক্ষা করল।

একজন ডিল-মেকার হিসাবে ট্রাম্পের যে পরিচিতি, তিনি সেটাকে সত্য প্রমাণ করে তার সফরের কেন্দ্রে রেখেছিলেন বাণিজ্যকে। বহু বিলিয়ন ডলারের চুক্তির ঘোষণা ছিল সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে, যার মধ্যে ছিল সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য ব্যাপক অস্ত্র বিক্রি, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি। ট্রাম্পের যুক্তি ছিল সোজাসাপ্টা : এই চুক্তিগুলো দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, বিদেশে শক্তি প্রদর্শন করবে এবং তার অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ও আমেরিকান ব্যতিক্রমবাদের প্রচারণার গল্পকে শক্তিশালী করবে।

উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর জন্য ট্রাম্পের সফর মার্কিন কৌশলগত হিসাব-নিকাশের কেন্দ্রস্থলে তাদের গুরুত্বকে পুনর্ব্যক্ত করল। এটি এমন একটি অঞ্চল, যা ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। সেখানে তার উপস্থিতি একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে : যুক্তরাষ্ট্র এখনো এখানে বিজড়িত আছে। উপসাগরীয় নেতারা শুধু প্রতীকীভাবেই নয়, আরও অনেক কিছু অর্জন করেছেন। ট্রাম্পের এই সফর তাদের ব্যাপক জাতীয় এজেন্ডার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, যেমন সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শিল্প বৈচিত্র্যকরণ এবং কাতারের দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ। ট্রাম্পের অনুমোদন এই অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলোর জন্য রাজনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করে, পাশাপাশি পশ্চিমা সমালোচনা থেকে তাদের রক্ষা করে।

তবে এটি স্নায়ুযুদ্ধের দ্বিমেরুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পুনরায় প্রত্যাবর্তন নয়। উপসাগরীয় দেশগুলো বুঝতে পারছে যে, মার্কিন গ্যারান্টির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করা ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষত আজকের যুগে, যখন যুক্তরাষ্ট্র একাকীত্ববাদের দিকে ধাবিত। উপসাগরীয় দেশগুলোর কৌশল বাস্তবমুখী : জোটবদ্ধতাকে বৈচিত্র্যময় করা, অংশীদারত্ব বিস্তৃত করা এবং স্বায়ত্তশাসন গভীর করা।

ট্রাম্পের উপসাগরীয় সফরের পেছনে ছিল চীনের ক্রমবর্ধমান ছায়া। গত দশকে বেইজিং এ অঞ্চলে নিজেকে গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বন্দর, লজিস্টিকস, ডিজিটাল অবকাঠামো এবং জ্বালানি সরবরাহ শৃঙ্খলে বিনিয়োগ করেছে। এটি দ্রুত মূলধন প্রয়োগ, অবকাঠামোগত দক্ষতা এবং কূটনৈতিক হস্তক্ষেপহীনতা প্রদান করে, যা পশ্চিমাদের শর্তসাপেক্ষ যুক্তির বিকল্প হিসাবে আকর্ষণীয়।

উপসাগরীয় দেশগুলোকে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করা হয়নি। তারা উভয়পক্ষকেই ব্যবহার করছে সর্বোচ্চ কৌশলগত মূল্য আহরণের জন্য। ট্রাম্পের মিশন ছিল চীনের স্থান দখলে নেওয়া নয়, বরং আমেরিকার প্রতিযোগিতামূলক প্রান্ত পুনর্ব্যক্ত করা, যা বেইজিং দিতে পারে না : উন্নত সামরিক সক্ষমতা, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি কাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা সহযোগিতার ঐতিহ্য। এই সফরের সময় স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক চুক্তিগুলো অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় আমেরিকার নতুন আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়, পরিত্যাগের নয়।

একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে : উপসাগরীয় দেশগুলো এই অঙ্গীকারগুলোর ক্ষেত্রে কীভাবে অর্থায়ন করবে, যখন জ্বালানি তেলের দাম দীর্ঘদিন ধরে নিচে রয়েছে? যদিও গত দুই দশকে এ অঞ্চলগুলো উল্লেখযোগ্য সার্বভৌম সম্পদ সঞ্চয় করেছে, তবে আর্থিক চাপ বাড়ছে। বাজেট ঘাটতি বাড়ছে, ভর্তুকি কাটছাঁট রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল।

যদিও ট্রাম্পের সফরের সময় এটি শিরোনাম হয়নি যে, জ্বালানি রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃপ্রবাহে রয়েছে। সামরিক জোট এবং কূটনৈতিক সমন্বয় অপরিহার্যভাবে তেল উৎপাদন কৌশলগুলোকে প্রভাবিত করে। পুনরুজ্জীবিত আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্ক উৎপাদন নীতিতে অনানুষ্ঠানিক সমন্বয় সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার এ সময়।

তবুও সবচেয়ে গভীর পরিবর্তনটি কাঠামোগত ক্ষেত্রে। উপসাগরীয় অর্থনীতি হাইড্রোকার্বন থেকে তাদের রূপান্তর ত্বরান্বিত করছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ভিত্তিকে পরিবর্তন করছে। বিনিয়োগ, উদ্ভাবন এবং শিল্প সহযোগিতা নতুন সম্পৃক্ততার স্তম্ভ হয়ে উঠছে। এই রূপান্তর বিশ্বব্যাপী মূলধন প্রবাহ পুনঃসংজ্ঞায়িত করবে, পেট্রোডলারের গুরুত্ব হ্রাস করবে এবং আগামীতে জ্বালানি কূটনীতিকে পুনর্গঠন করবে।

কৌশলগত দিক দিয়ে ট্রাম্পের সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। ট্রাম্প অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিজয় হিসাবে চুক্তিগুলো প্রচার করতে পারবেন। উপসাগরীয় নেতারা দৃশ্যমানতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চুক্তি, বিনিয়োগ এবং তাদের কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করেছেন।

কিন্তু গভীর অনিশ্চয়তাগুলো রয়ে গেছে। অনেক চুক্তি উচ্চাকাঙ্ক্ষামূলক বা দীর্ঘমেয়াদি এবং ভবিষ্যতে মার্কিন নীতির পরিবর্তনের ফলে বিঘ্নিত হতে পারে। একটি একক, বিভাজক ব্যক্তির সঙ্গে আঞ্চলিক কৌশল অত্যধিক সম্পৃক্ত হলে, আমেরিকান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হলে অস্থিরতার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আরও মৌলিকভাবে বললে, সফরটি বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের ক্রমবর্ধমান গতিপথ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র এখন একটি জনবহুল কৌশলগত মঞ্চের খেলোয়াড়, যেখানে রয়েছে চীন, ইউরোপ এবং স্বায়ত্তশাসিত উদীয়মান আঞ্চলিক অনুঘটকরা।

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করেছে। কিন্তু এটি খেলা শেষ করেনি। সেই প্রতিযোগিতা এখনো চলছে ওয়াশিংটন, বেইজিং এবং আরব উপসাগরীয় রাজধানীগুলোয়।

আরব নিউজ থেকে ভাষান্তরিত

ড. জন স্ফাকিয়ানাকিস : গালফ রিসার্চ সেন্টারের প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং অর্থনৈতিক গবেষণা বিভাগের প্রধান

ডোনাল্ড ট্রাম্প

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম