পশ্চিমকে অবশ্যই ইসরাইলের প্রতি সমর্থন বন্ধ করতে হবে
হামজা ইউসুফ
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইসরাইলের গাজায় চরম নৃশংস অপরাধের বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক বিবৃতি একটি স্বাগতযোগ্য উপলব্ধি যে, তাদের বিশ্বস্ত মিত্র ইসরাইল গাজার জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি গত ২০ মে হাউজ অব কমন্সে দাঁড়িয়ে গাজার ওপর ইসরাইলের অবরোধকে ‘নৈতিক দিক থেকে ভুল’ এবং ‘ব্রিটিশ জনগণের মূল্যবোধের অবমাননা’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছেন। এবং এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিনি ইসরাইলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাকে স্থগিত করেছেন। পাশাপাশি কিছু নির্বাচিত এবং তুলনামূলকভাবে ছোটখাটো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এর একদিন আগে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কায়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি যৌথভাবে সতর্ক করেছিলেন যে, যদি ইসরাইল তার পুনঃনবায়নকৃত সামরিক আক্রমণ বন্ধ না করে এবং গাজায় সাহায্য প্রবাহিত করতে না দেয়, তবে ‘জোরালো পদক্ষেপ’ নেওয়া হবে।
এ বিবৃতিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা মিত্রদের ইসরাইলের প্রতি সবচেয়ে স্পষ্ট সমালোচনা, তবুও এসব দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা, যেখানে ২০২৩ সাল থেকে ৫০ হাজারেরও বেশি গাজাবাসী নিহত হয়েছে, যার মধ্যে কয়েক হাজার নারী ও শিশুও রয়েছে, এর পরে এসেছে। পশ্চিমা মিত্ররা সেসময় ইসরাইলের এমন নৃশংসতার সমালোচনা করলে অন্তত শিশুসহ এত নিরপরাধ মানুষের জীবন রক্ষা পেত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত দেরিতে তাদের এমন উপলব্ধি? খুব কাছের বন্ধু হিসাবে যারা দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের এমন ভয়াবহ আচরণ দেখেও না দেখার ভান করেছে, তারা আজ হঠাৎ করে কেন মানবিকতার কথা বলছে? তাদের এ পরিবর্তিত আচরণের পেছনে মানবিকতা নয়, বরং ভূ-রাজনীতি এবং বিশ্বব্যাপী জবাবদিহিতার যে উপলব্ধি জাগ্রত হচ্ছে, বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত বলেই সন্দেহ করা যেতে পারে।
জানা গেছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি গাজা নিয়ে ইসরাইলি নেতার কৌশলকে নিজের চুক্তি সম্পাদনার জন্য ঝুঁকি হিসাবে দেখছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ট্রাম্প সম্প্রতি নেতানিয়াহু সরকারের তীব্র চাপ সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য সফর থেকে ইসরাইলকে বাদ দিয়েছেন; যা ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের মধ্যে দূরত্ব বাড়ারই ইঙ্গিত দেয়। এ ফাটল যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সকে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সুরক্ষা দিয়েছে, যাতে তারা ইসরাইলের আচরণ সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে।
গত ১৩ মে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ব্রিফিংয়ে, জাতিসংঘ জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী টম ফ্লেচার গাজায় চলমান ‘একবিংশ শতাব্দীর বর্বরতা’ বন্ধ করার জন্য সংস্থাটিকে সতর্ক করে জোর গলায় বলেছেন, গাজা অঞ্চলে ১০ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কোনো সাহায্য পৌঁছেনি এবং সেখানকার ২১ লাখ মানুষ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। তিনি ইসরাইলের সমর্থকদের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন একটি সহজ প্রশ্ন দিয়ে : আপনারা কি গণহত্যা রোধ করতে এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করতে সিদ্ধান্তমূলকভাবে পদক্ষেপ নেবেন? অথবা আপনারা কি বলবেন, আমরা যা করতে পেরেছি তা করেছি?
এরপর ফ্লেচার একটি মর্মান্তিক আবেদন জানান : ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গাজার পরিবারগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে প্রায় ১৪ হাজার শিশু মারা যেতে পারে। যদি এ ব্যাপারটি আপনার নৈতিক বিবেককে দংশন না করে, তবে অবশ্যই কিছু হবে না। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কয়েক দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন কূটনীতিক ও মানবতাবাদীর এ স্পষ্ট সাক্ষ্য আমাদের আরও অনেকের বক্তব্যকেই তুলে ধরে। ফলে কেবল নৈতিক ক্ষোভই যথেষ্ট নয়। যদি পশ্চিমা সরকারগুলো সত্যিই বিশ্বাস করে, ইসরাইলের কর্মকাণ্ড ‘ভয়াবহ’, ‘অসহনীয়’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য’, যেমনটি যুক্তরাজ্য সরকার গত ৪৮ ঘণ্টায় বলেছে, তাহলে তাদের মুষ্টিমেয় নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরিবর্তে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
যুক্তরাজ্য ও পশ্চিমা মিত্রদের অবশ্যই দ্রুত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে, ইউরোপীয় মিত্রদের তথা আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেনের পথ অনুসরণ করে। যদি যুক্তরাজ্য সত্যিই বিশ্বাস করে, দুটি রাষ্ট্রের সমাধানই শান্তির পথ, তাহলে তারা শুধু কথার মাধ্যমে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে একমাত্র একটি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে তাৎপর্যহীন সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারে না। আমরা জানি, ফিলিস্তিন/ইসরাইল সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান নেই। এটি কেবল কূটনীতি ও আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে। এক জনগোষ্ঠীর অধিকার সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করলে শান্তির পথে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আসতে পারে না। গাজার মৃত হাজার হাজার মানুষের জন্য, অসংখ্য আহত ও যারা বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে, তাদের জন্য যদিও এটা অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবুও, পশ্চিমা সমালোচনার এ প্রবণতা ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরাইলের প্রতি এ সরকারের অবিচল সমর্থন ইতিহাসের ভুল পাশে অবস্থান করছে এবং এ ভুলের জন্য ভবিষ্যতে তাদের জবাবদিহি করতে হতে পারে। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে থাকা ১৪ হাজার শিশুর স্বার্থে আমি আশা করি, এ পদক্ষেপটি দেরি না করে দ্রুত নেওয়া হবে।
আল জাজিরা থেকে ভাষান্তরিত
হামজা ইউসুফ : স্কটল্যান্ডের সাবেক ফার্স্ট মিনিস্টার
